আসাম আর বাংলার এই দুই নেতার মধ্যে গত কয়েকদিন ধরেই বেশ সখ্য দেখা যাচ্ছে। বাংলার ভোট-পরবর্তী হিংসা নিয়ে একজন একটি সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিকে লম্বা প্রবন্ধ লিখেছেন। অন্যজন সপ্রশংস মন্তব্যে সেটি শেয়ার করেছেন। আবার একজন অন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ায় অপরজন রীতিমতো উল্লসিত। আসাম আর বাংলায় নিজেদের খুঁটি আরও শক্তপোক্ত করতে বিজেপি আপাতত এই দুই নেতার ওপরেই ভরসা রাখছেন৷ এঁদের একজন বাংলার সদ্য নির্বাচিত বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, অপরজন আসামের নব নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা।
আরও পড়ুন: প্রধানমন্ত্রীকে চরমপত্র বিরোধী দলগুলির, বিপাকে বিজেপি
এই দু'জন নেতার মধ্যে মিল অনেক। তবে অমিলও কিছু আছে বইকি। এঁদের দু'জনেরই পুরনো রাজনৈতিক সাকিন জাতীয় কংগ্রেস। করিৎকর্মা যুবনেতা হিসাবে অনুগামী মহলে তাঁদের বেশ গ্রহণযোগ্যতাও আছে। অমিল বলতে একজন তাঁর 'নতুন' দলকে শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দ্বিতীয়বার রাজ্যের ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। অন্যজন সম্প্রতি দল ছেড়ে, রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে গরম গরম কথা বলেও তাঁর দলকে ক্ষমতায় আনতে পারেননি। নিজে অবশ্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে হারিয়ে জয়ী হয়েছেন এবং তার প্রতিদানে বিরোধী দলনেতাও হয়েছেন।
এই দুই নেতা কোথাও গিয়ে রাজনৈতিক সমীকরণের সরলরেখায় একই বিন্দুতে এসে মিলে যাচ্ছেন। এঁদের কেউই সংঘ অনুগত পুরনো স্বয়ংসেবক নন। স্রেফ কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার কৌশলে বিজেপি এঁদের পুরনো দল থেকে নিজেদের দলে নিয়ে এসেছিল। সেই কৌশল আসামে সফল, বাংলায় সফল না হলেও বিজেপি এই প্রথম বাংলায় 77 জন বিধায়ককে বিধানসভায় পাঠিয়ে প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ।
আরও পড়ুন: মেরুকরণের শাখা পল্লবিত হল না বাংলায়
হিমন্ত বিশ্বশর্মার রাজনৈতিক জীবনের শুরু ছাত্র সংগঠন অল ইন্ডিয়া আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (আসু)-র হাত ধরে। আসামে ভূমিপুত্র রক্ষার আন্দোলন এবং জঙ্গিবাদী "বঙ্গালি খেদাও' অভিযানে এই সংগঠন আগাগোড়া নেতৃত্ব দিয়েছিল। পরে এই সংগঠন আসাম গণপরিষদ নামে একটা পুরোদস্তুর রাজনৈতিক দল তৈরি করে অসমিয়া জাত্যাভিমানকে আরও উস্কে দেয়। এতে তারা রাজনৈতিক ভাবে লাভবানও হয়। হিমন্ত অবশ্য নয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ রাজনৈতিক গতিপথের ট্র্যাক বদলান— যোগ দেন কংগ্রেসে। কংগ্রেসের তরুণ গগৈ মন্ত্রীসভার গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী এবং দল ও সংগঠনের ক্রাইসিস ম্যানেজার হিসাবে পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রীত্বের দাবিদার ছিলেন তিনিই। কিন্তু গগৈ তাঁর পুত্র গৌরব গগৈ-এর জন্য সেই আসন তুলে রাখতে চেয়েছিলেন। এতেই দুই নেতার মনোমালিন্য এবং রাজনৈতিক বিচ্ছেদ। এরপর কংগ্রেস ত্যাগ করে হিমন্ত বিজেপিতে যোগ দেন এবং আসামকে কংগ্রেস-মুক্ত করার পণ করেন। কিন্তু বিজেপিতে এসেও তাঁর দীর্ঘলালিত রাজনৈতিক স্বপ্নের বাস্তবায়ন হয়নি। বিজেপি ততদিনে তাঁদের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে সর্বানন্দ সোনোয়ালের নাম ঘোষণা করে দিয়েছিল— যিনি আবার হিমন্তের সঙ্গে আসু করতেন এবং "বঙ্গালি খেদাও' অভিযানের চরমপন্থী মুখ হিসাবেই তিনি পরিচিত ছিলেন। তাই হিমন্তকে ধৈর্য ধরতে হয়। কিন্তু তিনি তাঁর কাজ থামাননি। একের পর এক কূটকৌশলে গোটা উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে কংগ্রেসকে প্রায় মুছে দেন। আসামে কংগ্রেসের যে আলি (মুসলিম), কুলি (চা-শ্রমিক) এবং বাঙালি ভোটব্যাঙ্ক, তাকে তছনছ করে দেন। 2016-তে ক্ষমতাচ্যুত অশীতিপর তরুণ গগৈ তাঁর প্রগাঢ় রাজনৈতিক জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা নিয়েও হিমন্তের কূটকৌশলের কাছে হার মানতে বাধ্য হন।
শুভেন্দু অধিকারীর রাজনৈতিক জীবন শুরু অবশ্য কংগ্রেসেই। ছাত্র সংগঠন ছাত্র পরিষদ দিয়ে শুরু, তারপর পথ বদলে তৃণমূল কংগ্রেসে। আপাদমস্তক রাজনৈতিক পরিবারে প্রায় তিনটে প্রজন্ম কংগ্রেসি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তৃণমূলে থেকে পর্যায়ক্রমে সাংসদ, বিধায়ক, মন্ত্রী, সহস্র সাংগঠনিক এবং প্রশাসনিক পদাধিকারী। তারপর ভোটের কিছুমাস আগে হঠাৎই পুরনো দলকে তোপ দেগে বিজেপিতে যোগদান।
আরও পড়ুন: রামের শত্রুর ছেলেও কিন্তু বাংলায় হিরো
হিমন্ত এবং শুভেন্দুর রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাই দু'জনকে কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। বিজেপিও নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে এই উচ্চাকাঙ্ক্ষাকেই জলহাওয়া দিয়েছে। তার জন্য বিজেপিকে যথেষ্ট আত্মত্যাগও করতে হয়েছে। দলের অন্দরে প্রাচীনপন্থীদের বিরোধিতাকে অগ্রাহ্য করে এই নবীন তপস্বীদের সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হচ্ছে। "মারি অরি পারি যে কৌশলে' নীতির প্রয়োগ ঘটাতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের আদর্শ থেকে বেরোতে হচ্ছে বিজেপিকে। নাগপুর যেখানে সংঘ শিক্ষার ধারাবাহিক অনুশীলন ও প্রসারকেই নেতা হওয়ার প্রধানতম মাপকাঠি বলে মনে করে, সেখানে বিজেপির রাজনৈতিক "চাণক্য' অমিত শাহ ঐতিহাসিক চরিত্র চাণক্যের সাম-দাম(দান)-দন্ড-ভেদ নীতির ওপরেই অটল ভরসা রাখছেন। অন্তত এখনও অবধি।
অসীম ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে কুশলী হিমন্ত আপাতত পড়শি রাজ্য আসামের কুর্সিতে আসীন। শুভেন্দু আপাতত বিরোধী দলনেতার পদেই। হিমন্তের মতোই ধৈর্য, শীতল মস্তিষ্কের কূটকৌশলে পুরনো দল তৃণমূল কংগ্রেসকে কাবু করতে পারলে, তিনিও তাঁর "হিমন্তদা'-র মতো মুখ্যমন্ত্রী হতে পারবেন কিনা, তার উত্তর দেবে সময়। শুভেন্দুকে এটাও মাথায় রাখতে হবে হিমন্তের উল্টোদিকে ছিল শতছিন্ন সংগঠনের কংগ্রেস আর তাঁর উল্টোদিকে একলা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি তরুণ গগৈ-এর মতো বিনা যুদ্ধে রাস্তা ছেড়ে দেওয়ার রাজনীতিক নন। তাছাড়া আসামের মতো বাংলায় কোনও জঙ্গি জাতীয়তাবাদী শক্তি কখনওই প্রশ্রয় পায়নি, যেখানে এনআরসি অস্ত্রে রাজনৈতিক ফায়দা মিলবে। অন্যদিকে বিজেপিও কিন্তু ক্ষুধার্ত বাঘের পিঠে আসীন। যুব রাজনীতিকদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খায় লাগাম পরানো সহজ জিনিস নয়। হিমন্তকে মুখ্যমন্ত্রী করা না হলে তিনি অনুগত বিধায়কদের নিয়ে পুরনো দল কংগ্রেসে ভিড়তে পারেন— এই আশঙ্কা থেকেই তড়িঘড়ি তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী করতে "বাধ্য' হয় বিজেপি।
দুই উচ্চাকাঙ্খী যুব রাজনীতিককেই এখন ধৈর্য এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরীক্ষা দিতে হবে। হিমন্তকে এনআরসির "ভ্রান্তি' মুছে, সিএএ নিয়ে অভয় দান করতে হবে অসমিয়াদের মধ্যে। আর শুভেন্দুকে 77 জন (কমে আপাতত 75) বিধায়ককে নিয়ে বিপুল আসন নিয়ে জিতে আসা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে লড়ে যেতে হবে— আইনসভার ভিতরে এবং বাইরে। আপাতত সংখ্যার বিচারে দুই রাজ্যেই স্থিতিশীল সরকার প্রতিষ্ঠা হয়েছে। সুতরাং পাঁচ বছর পরেই উত্তর মিলবে কে কোথায় পৌঁছাবেন এই প্রশ্নের।
আব্বাসের সমর্থকরা কি আব্বাসকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রূপে দেখতে চাইবেন?
লোকাল ট্রেনের অপেক্ষায় হয়রান মানুষের প্রশ্ন, করোনা কি ট্রেনে চড়তে ভাসবাসে আর বাসে ওঠে না?
শ্রীরামপুরের গির্জা বলতে ভোলা ময়রা এই সেন্ট ওলাফস গির্জার কথাই বলেছেন
মানুষের অন্তঃস্থলে বহমান যমুনায় প্রভু প্রকট হয়েছেন, তোমরা খুঁজে নিও।
নেহরু অনেকদিন বৃদ্ধ হয়েছেন, কিন্তু কালান্তরেও তাঁর ভাবনায় বার্ধক্য আসেনি।
শুধু আনমনেই বলে উঠেছি, ‘স্বপনদুয়ার খুলে এসো, অরুণ-আলোকে এসো স্তব্ধ এ চোখে...।'