অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সচল রাখতে ধাপে ধাপে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হচ্ছে। 6 মাসের বিরতির পর গত 13 সেপ্টেম্বর থেকে কলকাতা মেট্রোও সচল হয়েছে। কিন্তু লোকাল ট্রেন কবে থেকে চলবে সে বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি কেন্দ্র বা বিভিন্ন রাজ্য সরকার। গ্রাম ও শহরতলি থেকে শহরে কর্মস্থলে যেতে নিত্যদিন বিপাকে পড়তে হচ্ছে হাজার হাজার যাত্রীকে। অথচ সড়ক পথে একই গন্তব্যে যেতে বাস চলছে প্রায় অবাধে এবং সেখানে বিধিবিধানের তোয়াক্কা করছে না কেউই। লোকাল ট্রেনের অপেক্ষায় হয়রান মানুষের প্রশ্ন, করোনা কি ট্রেনে চড়তে ভাসবাসে আর বাসে ওঠে না?
লোকাল ট্রেন অবশ্য সামান্য কয়েকটি করে চলছে, যার পোশাকি নাম ‘স্পেশাল'। মূলত রেল কর্মচারীদের যাতাযাতের জন্যই এই ট্রেন চালানো হচ্ছে। হাওড়া-আরামবাগ এবং হাওড়া-বর্ধমান দু'টি রেলপথেই রেল কর্তৃপক্ষ এমন বিশেষ কিছু ট্রেন চালাচ্ছে। সেখানে রেল কর্মচারী হওয়ার প্রমাণপত্র দেখাতে পারলে, তবেই ট্রেনে প্রবেশাধিকার মিলছে। কিন্তু হুগলি অথবা হুগলি লাগোয়া পূর্ব বর্ধমান জেলার বহু মানুষকে কর্মস্থলে পৌঁছতে এই লোকাল ট্রেনের উপরেই ভরসা করতে হয়। এদের অনেকেই বেসরকারি সংস্থায় স্বল্প বেতনে চাকরি করেন। মোটা টাকা ব্যয় করে এদের পক্ষে যেমন প্রাইভেট গাড়িতে কর্মস্থলে যাওয়া সম্ভব নয়, তেমনই করোনার দোহাই দিয়ে কাজ থেকে অব্যাহতি নেওয়াও সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে তাদের চাকরিটিই চলে যেতে পারে। অগত্যা, অনেকেই রীতিমতো ‘আইনবিরুদ্ধ' ভাবে এই স্পেশাল ট্রেনগুলোতে উঠে পড়ছেন। এদের প্রায় প্রত্যেকেই জানেন আরপিএফ কর্মচারীদের হাতে ধরা পড়লে তাদের অর্থ এবং মান দুইই খোয়া যেতে পারে। অনাদায়ে শ্রীঘর-বাসও হতে পারে। কিন্তু পেটের টান যে বড় টান।
এই বিচিত্র ট্রেন যাত্রার হালহকিকত জানতে-বুঝতেই পৌঁছে গিয়েছিলাম স্থানীয় এক রেলস্টেশনে, এদের সকলের কথা শুনতে। প্রত্যেকেই কেমন যেন সন্ত্রস্ত হয়ে প্ল্যাটফর্মে বসে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছেন। ভয়টা কীসের প্রশ্ন করতে কয়েকজন বলে উঠলেন, ‘দেখছেন না চারদিকে বাবুরা ঘুরছে?' প্রশ্ন করলাম কারা? ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘আরপিএফ স্যারেরা!' এদের অনেকেরই মুখে পূর্ব রেলওয়ে লেখা মাস্ক। দাদা, রেলে চাকরি করেন নাকি? উল্টোদিক থেকে আমতা আমতা করে উত্তর এল, ‘না, তা ঠিক নয়। আমি বেসরকারি চাকুরে। রেলের আইডি কার্ড নেই। তবু, এই মাস্কটা পরলে আরপিএফ ঘাঁটায় না। তাই পরা।' ট্রেন এলে পকেট থেকে প্রেসকার্ড বার করে তাতে উঠতে যেতেই বাধা পেলুম। খাঁকি পোশাকের দু'জন বললেন, ‘প্রেসকে অ্যালাও করা হচ্ছে না। অনলি ফর রেল এমপ্লয়িজ।' এভাবে প্রেসের কাজে বাধা দেওয়া যায় না বলাতে তাঁদের একজন বললেন, ‘পরে বিপদে পড়লে দায় আমাদের নয়।' এমনকী ছবি তোলাতেও তাঁদের চোখ-মুখের তীব্র বিরক্তি নজর এড়াল না।
প্ল্যাটফর্মে থাকা যাত্রীদের কাছে শুনতে চাইছিলাম তাদের রোজকার এই ট্রেন-দিনলিপির কথা। কেউই এই নিয়ে ক্ষোভ গোপন রাখল না। ব্যান্ডেল নিবাসী একজন নিত্যযাত্রীর কথায়, ‘2 ঘণ্টা দাঁড়িয়ে হাওড়া পৌঁছই। প্রাণভয়ে ট্রেনে যাতায়াত করি, যেন আমরা চোর। ধরা পড়লেই যথেচ্ছ ফাইন। ফেরার পথে হাওড়া থেকে ট্রেনে উঠতে দেয়না। ভিড় বাসে গাদাগাদি করে বাড়ি ফিরতে হয়।' সহযাত্রীটির পাল্টা প্রশ্ন ধেয়ে আসে আমার দিকে, ‘বলুন তো, যত করোনা কি ট্রেনেই আছে, বাস, অটো-টোটোয় নেই?' আর এক সহযাত্রীর মত, ‘লোকাল ট্রেন না চলায় বহু মানুষ রুজিরোজগার হারিয়েছেন। সরকার এখনও লোকাল ট্রেন না চালালে করোনায় যত মানুষ মারা গেছেন, তার চেয়ে বেশি মানুষ না খেয়ে মারা যাবেন।'
নিত্যযাত্রীদের বক্তব্য যে খুব একটা অমূলক নয়, সেটা বোঝা যায় মূলত কলকাতা থেকে গ্রামীণ হাওড়া এবং হুগলির মধ্যে সংযোগকারী বাসগুলোকে দেখলেই। সরকারি বাসে আসনপ্রতি যাত্রী ফর্মুলায় আসন ভর্তি হলেই বাসের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু ব্যস্ত সময়ে সরকারি বাসের সংখ্যা তো নগণ্য। ভরসা সেই বেসরকারি বাসই। যথেচ্ছ যাত্রী বোঝাই করা সেই বাসে, করোনাবিধি রক্ষা দূরস্থান, দম নেওয়াই রীতিমতো ঝক্কির মনে হয়। জনৈক ট্রেনযাত্রীর সরস উক্তি, ‘করোনা ভাইরাস খুব ট্রেনে চড়তে ভালবাসে, বুঝলেন কিনা। তাই সরকার ওকে আটকাতে লোকাল ট্রেন বন্ধ রেখেছে। আর বাস-টোটোতে মনে হয় অ্যান্টিবডি টেস্ট করে যাত্রীদের তোলা হচ্ছে। তাই সেখানে করোনার ভয় নেই।' আর এক যাত্রীর গলায় হতাশা। ‘মাস গেলে 8000 টাকা পাই। সংসারে 4 জন সদস্য। তারকেশ্বর থেকে রোজ গাড়িভাড়া করে কাজে যাওয়া সম্ভব নয়। আবার কাজে না গেলেও কাজ থাকবে না। তাই রোজ ভয় নিয়েই ট্রেনে উঠি।'
কিন্তু যাদের এই বিচিত্র ফরমানে এই ভয়, সেই রেল কর্তৃপক্ষের কী বক্তব্য এই নিয়ে? যাত্রীদের অনেকেই ট্রেন চালানোর দাবি জানিয়েছেন তাদের কাছে। এই নিয়ে পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিকের সঙ্গে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি। ই-মেলেরও কোনও উত্তর আসেনি। রেল কর্তৃপক্ষ সেপ্টেম্বর মাসের গোড়ায় জানিয়েছিলেন, এখনই লোকাল ট্রেন চালানোর মতো অনুকূল পরিস্থিতি নেই। লোকাল ট্রেন চালানোর জন্য রাজ্য সরকারেরও সম্মতির প্রয়োজন। কলকাতা মেট্রোয় যেভাবে যাত্রী সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, লোকাল ট্রেনে তা সম্ভব কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। কিন্তু সংক্রমণের পরিমাণ কমানোর জন্যই যদি লোকাল ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখা হয়, তাহলে অন্যান্য গণপরিবহনে মাত্রাতিরিক্ত ভিড় কি সংক্রমণ বাড়িয়ে তুলবে না? লোকাল ট্রেন চললে এই ভিড়ের চাপ কিছুটা কি কমানো যেত না? কবে থেকে লোকাল ট্রেন চলতে পারে, তার কোনও ইঙ্গিত এখনও দেননি রেলকর্তারা। এই বিষয়ে রেল এবং রাজ্য সরকারের মধ্যে কোনও আলচনা হয়নি বলেই জানা গেছে। তবে, আসন্ন উৎসবের মরশুমে, আনলক প্রক্রিয়ার পঞ্চম পর্বে কিছু ছাড় দেওয়ার ঘোষণা করতে পারে কেন্দ্র। সেই ছাড়ের মধ্যে লোকাল ট্রেন চালুর ঘোষণাও থাকবে, এই আশাতেই এখন বুক বাঁধছেন নিত্য যাত্রীরা।
(ছবি:- বিভাস দত্ত, দেবম ঘোষ)
সংবিধান দিবসের স্মরণ: নাগরিকের কাছে ধর্মগ্রন্থের মতোই পবিত্র এই নথি।
পদক জিতলে দেশের গর্ব, না হলে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে বাঁচতে হয় উত্তর-পূর্ব ভারতকে।
ধর্ম যাদের সঞ্জীবনী, সেনাশাসন যাদের গণতান্ত্রিক আভরণ, তাদের পথ আমরা কেন অনুসরণ করব?
প্রবাসী সন্তানের অভাব ভুলিয়ে সন্তানের মতোই প্রবীণদের আগলাচ্ছেন তুর্ণীরা।
বন্ধ হরতালময় শহরে এমন দিনগুলোয় সচরাচর ছেলেরা পথে ক্রিকেট খেলে, স্থানীয় চায়ের ঠেকে আড্ডা জমে।
নেহরু অনেকদিন বৃদ্ধ হয়েছেন, কিন্তু কালান্তরেও তাঁর ভাবনায় বার্ধক্য আসেনি।