মাথায় ফেজ টুপি আর লুঙ্গি, ফতুয়া পরিহিত এক যুবক বঙ্গ রাজনীতিতে শোরগোল ফেলে দিয়েছেন। বঙ্গবাসী তার ঐতিহ্য অনুসারেই এই যুবককে নিয়ে আড়াআড়ি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। যুবকের নাম পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিক্কি। যিনি ভোটমুখর বাংলায় তাঁর নতুন দল ‘ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট’কে নামিয়ে দিয়ে অনেক সমীকরণকে রীতিমতো ঘেঁটে দিয়েছেন। ঘেঁটে দিয়েছেন আরও অনেক কিছুই। রাজনৈতিক ভাবগাম্ভীর্যে অটল এবং মতাদর্শ আঁকড়ে থাকা বামেরাও এই নবীন রাজনৈতিক তপস্বীকে সোৎসাহে বরণ করে নিয়েছেন। আব্বাসও বাম-কংগ্রেসের যৌথ মঞ্চের মধ্যমণি হয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, বাংলার রাজনীতিতে তিনি একটা নির্ণায়ক শক্তি হতে চান।
সম্প্রতি গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে এই বহুচর্চিত আব্বাস জানিয়েছেন, বিরুদ্ধমতের ব্যক্তিকে প্রহার করার মধ্যে অন্যায়ের কিছু নেই। তিনি নাকি জানতেনও না যে, পুলিশি হেফাজতে অভিযুক্তকে প্রহার করলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্ন ওঠে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আব্বাস সক্রিয় রাজনীতিতে আসার বহু আগে থেকেই ধর্মপ্রচারক হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। গ্রামের ধর্মীয় জলসায় তাঁর ইসলাম সম্পর্কিত ব্যাখ্যা শোনার জন্য কাতারে কাতারে মানুষ ভিড় করছেন, এমন দৃশ্যও দেখা গেছে। আব্বাস ঊনবিংশ শতাব্দীর সুফি সাধক আবু বকর সিদ্দিকির উত্তরসূরী। আব্বাস কতটা সুফি সহজিয়া ধারণাকে আত্মস্থ করেছেন জানা নেই, কিন্তু তাঁর আগের বহু বক্তব্যেই ধর্মীয় গোঁড়ামির মনোভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। মন্দিরে যাওয়ার ‘অপরাধে’ জনৈক মুসলমান সাংসদকে গাছে বেঁধে পেটানোর নিদান দিয়েছিলেন তিনি। ইসলাম আর আল্লাকে নিয়ে তাঁর স্পর্শকাতরতা এতটাই যে, তিনি ‘শার্লি এবদো’র সাংবাদিকদের ‘জাহান্নমে’ পাঠানোর জন্য কুর্নিশ জানিয়েছিলেন ঘাতকদের। আব্বাস অবশ্য রাজনৈতিক মঞ্চে অবতীর্ণ হয়ে তাঁর যাবতীয় প্রগলভতায় রাশ টেনেছেন। আব্বাস ভবিষ্যতে কোন পথে চলবেন, তা সময় বলবে। কিন্তু ইতিহাসের কিছু বাঁক অবিকল এমনই দেখতে হয় যে, পরের বাঁকটা সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হয়ে যায়। তবে এইসবই সম্ভাব্যতার প্রশ্ন। সেই সম্ভাব্যতাই আমাদের আগামীতে চলার পাথেয়।
স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষে তখন স্বতন্ত্র পাঞ্জাবি সুবার জন্য লড়াই চলছে। লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তরুণ স্কুল শিক্ষক, শিখ গুরুদ্বার প্রবন্ধক কমিটির প্রধান মাস্টার তারাচাঁদ সিং। স্বতন্ত্র পাঞ্জাবি সুবার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছিল মূলত ভাষাকেন্দ্রিক দাবিদাওয়া নিয়ে। পাঞ্জাবের পূর্বাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন হিন্দুরা। তাঁরা পাঞ্জাবি ভাষার সঙ্গে হিন্দির ব্যবহারও চালু রাখতে চেয়েছিলেন। একইসঙ্গে দেবনগরী হরফে পাঞ্জাবি লেখার দাবি জানিয়েছিলেন। অপরদিকে শিখরা গুরুমুখী লিপিতে লিখিত পাঞ্জাবিকেই স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানালেন। কিন্তু, অচিরেই ভাষাগত দাবিদাওয়া সাম্প্রদায়িক দাবিদাওয়ায় পরিণত হল। সুবক্তা হিসেবে পরিচিত তারা সিং তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যে সার্বভৌম শিখ রাষ্ট্র গড়ার দাবি জানালেন। উস্কানিমূলক বক্তব্য রাখার দায়ে গ্রেপ্তারও হলেন কয়েকবার। নেহরু স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, সম্প্রদায়গত দাবিদাওয়া পরিত্যাগ না করলে তিনি কোনও আলোচনাতেই বসবেন না।
পাঞ্জাবের প্রথম কয়েকটি নির্বাচনে তারা সিং এবং তাঁর অকালি দল বিশেষ কোনও সুবিধা করতে পারল না। এই অকালি দল বরাবরই দাবি করে এসেছে শিখদের ধর্ম আর রাজনীতিকে কখনওই পৃথক করা যায় না। তারা সিং শিখ ধর্মকে অবলম্বন করেই রাজনৈতিক দাবিদাওয়া রাখা শুরু করলেন। উচ্চবিত্ত শিখ, জাঠদের একটা বড় অংশ অকালি দলের পাশে এসে দাঁড়াল। তারা সিং-এর ক্রমবর্ধমান সাফল্যে পাঞ্জাবের সিপিআই এবং সিপিএম— দুই বামপন্থী দলই তাঁর সঙ্গে জোট করল। নেহরু সহ যে কংগ্রেসি নেতৃবৃন্দ এতকাল তারা সিং-কে পরিত্যাজ্য করে রেখেছিলেন, সেই তারা সিং এবং তাঁর সাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেল দুই বামপন্থী দলের স্বীকৃতিতে। ছয়ের দশকের পাঞ্জাবে বামপন্থীদের শক্তি যথেষ্ট পরিমাণে ছিল।
তারা সিং-কে জব্দ করতে নেহরু এবং তাঁর আস্থাভাজন, পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী প্রতাপ সিং কাঁয়রো তারা সিং-এরই একদা আস্থাভাজন ফতে সিং-কে সামনের সারিতে নিয়ে এলেন। ফতে সিং সম্প্রদায়গত দাবিদাওয়া ছেড়ে আবার ভাষাগত দাবিদাওয়ায় ফিরে গেলেন। কিন্তু 1980-র নির্বাচনে অকালি দল শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হল। অকালি নেতৃত্ব বুঝলেন নরমপন্থা দিয়ে সমর্থকদের মন জয় করা যাবে না। স্বতন্ত্র শিখ নেশনের দাবিতে জঙ্গি আন্দোলন চাই। পাঞ্জাবের বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতির নয়া ‘আইকন’ হিসাবে উঠে এলেন আর এক তরুণ, জার্নেল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে। তাঁর সাম্প্রদায়িক বক্তব্য ক্যাসেটের মাধ্যমে পাঞ্জাবের গ্রামে গ্রামে শোনানো হত। নিরঙ্করী সম্প্রদায়ের শিখ এবং হিন্দুদের নির্বিচারে খুন করল উন্মত্ত জনতা।
এত কথা বলার কারণ এই যে, ধর্মকাতর তরুণদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খা এই দেশ আগেও দেখেছে। ঘটনাচক্রে সেই অভিজ্ঞতাগুলো দেশের জন্য খুব একটা সুখকর হয়নি। নেহরু এবং কায়রোঁ সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে কড়া অবস্থান নিয়ে তারা সিং-কে রুখে দিতে পেরেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী কংগ্রেসি নেতৃবৃন্দ— বিশেষত জৈল সিং এবং স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধী অকালিদের ঘরে সিঁদ কাটার উদ্দেশ্যে ভিন্দ্রানওয়ালের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে মদত জুগিয়েছিলেন, অন্তত একটা সময় পর্যন্ত। তার মূল্য ইন্দিরা চুকিয়েছিলেন তাঁর জীবন দিয়ে, আর কংগ্রেস রাজনৈতিক মূল্য চুকিয়েছিল পাঞ্জাবের মসনদ থেকে বহুকাল দূরে সরে গিয়ে।
কাল কালান্তরে, দেশ দেশান্তরে মৌলবাদের একটা সাধারণ সমস্যা হল, সে আরও আগুন চায়। আগুনটা নিভতে দিলে চলে না। ভাষার দাবিকে শিখ সম্প্রদায়ের স্বতন্ত্র নেশনের দাবিতে পরিণত করে তারা সিং রাজনৈতিক ভাবে লাভবান হয়েছিলেন। ফতে সিং সেই উন্মাদনায় লাগাম পরাতে পারেননি। উল্টে রাজনৈতিক পুনরুজ্জীবনের জন্য অকালি রাজনীতিকে আরও জঙ্গিনীতি গ্রহণ করতে হয়েছে। শিখদের পবিত্র স্বর্ণমন্দিরকেও যুদ্ধের ঘাঁটি বানাতে হয়েছে। উদাহরণ তো আরও কত। কংগ্রেসের কাছে রাজনৈতিক পরিসর হাতছাড়া হচ্ছে দেখে ব্যক্তিজীবনে ইসলামকে না মানা জিন্নাও সাম্প্রদায়িক নেতা রূপে আবির্ভূত হয়েছেন। আবার অবিভক্ত বাংলার অসাম্প্রদায়িক চেতনার মুখ্যমন্ত্রী (তখন অবশ্য প্রধানমন্ত্রী বলা হত) ফজলুল হককে প্রথমে শ্যামাপ্রসাদের জনসংঘ, পরে সুরাবর্দির মুসলিম লিগের কাছে নীরব আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে।
এদিকে মুশকিল হচ্ছে, আব্বাসের কোনও রাজনৈতিক অতীত নেই। কোনও গণআন্দোলনে যুক্ত থাকার পুরনো নজিরও খুঁজে পাওয়া গেল না। আব্বাসের সমর্থক এবং অনুগামী যারা, তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই আব্বাসের জলসার একনিষ্ঠ শ্রোতা— যাদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে আব্বাস সম্মতি নেন— ‘চিল্লায়ে কন ঠিক কিনা?’ সমস্বরে জনতা বলে ওঠে, ‘ঠিইক’! স্বভাবতই আব্বাসের সমর্থকরা তাঁর কাছে সেই কথাগুলোই শুনতে চান, যেগুলো তিনি জলসায় বলতে অভ্যস্ত। আব্বাস ব্রিগেডের মঞ্চ ছাড়লে তাই এই সমর্থকরাও আর ময়দানে থাকার কোনও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না।
আব্বাসের রাজনৈতিক অবস্থান তাঁর পূর্ববর্তী অবস্থানের তুলনায় সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁর পূর্বকৃত কাজের যাবতীয় ছাপ তুলে ফেলতে তিনি সদা তৎপর। তিনি এখন সংখ্যালঘু এবং জনজাতিদের অধিকার রক্ষার কথা বলছেন। বাংলার বর্ণহিন্দু পরিবেষ্টিত রাজনৈতিক মহলে ক'জন এমন ভেবেছেন বা বলেছেন? তবু, আব্বাসের সীমাবদ্ধতা কিন্তু আব্বাসের সমর্থকরাই। তাঁরা আব্বাসের এই রাজনৈতিক পথে কখনও হাঁটেননি, হয়তো হাঁটার কথাও ভাবেননি। তাঁরা আব্বাসের জলসার শ্রোতা হয়ে তাঁর উত্তপ্ত বাক্যে উল্লসিত হয়েছেন। এই সমর্থকরা কতদিন আব্বাসকে তাঁর পুরনো আধা মৌলবাদী অবস্থান থেকে দুরে সরে থাকতে দেবেন? এক্ষেত্রে বাম এবং কংগ্রেসকেও কিন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে হবে। ভোট-রাজনীতির স্বল্পমেয়াদি ভাবনা ছেড়ে বৃহত্তর প্রেক্ষাপটেও নিজেদের অবস্থানের মূল্যায়ন করতে হবে। ইতিহাসের ঝাঁকিদর্শনে দুই উচ্চাকাঙ্খী তরুণ কীভাবে সম্প্রদায়গত রাজনীতিকে ভিত্তি করে দেশকে বিপাকে ফেলেছিল, তার ইতিবৃত্তও তো দেওয়া হল। তখন বামেরা অজান্তেই স্ব-ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়েছিলেন। এবার নিশ্চয়ই তার পুনরাবৃত্তি হবে না। আব্বাস কতটা অসাম্প্রদায়িক, তা প্রমাণে মরিয়া চেষ্টা না করে, তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় আব্বাস মৌলবাদের দ্বারা চালিত হবেন না— এই বিষয়টি সুনিশ্চিত করার দায় বামেদের। না হলে নেহরু, কায়রোঁদের কাছে অকিঞ্চিৎকর তারা সিং-রা আবারও বামেদের ভুল পদক্ষেপে হিরো হয়ে যেতে পারেন।
ইতিহাসের বাঁকে থমকে দাঁড়িয়ে একটু ভেবে নিলে, পরের বাঁকটা একটু হলেও আন্দাজ করা যায় বৈকি।
তাঁদের খামখেয়ালিপনায় আরও অনেক মানুষকে আমাদের হারাতে হবে না তো?
সমাজ নির্মিত ‘খুনি' হিসাবে একাকী রিয়াকে যে অসম লড়াইটা লড়তে হচ্ছে, সেই লড়াইয়ে সংহতি থাকবে।
দুর্বল, প্রায় অনিচ্ছুক নেতৃত্বের পক্ষে নানা রাজ্যের সম্ভাবনাময় তরুণ নেতাদের কংগ্রেসে ধরে রাখা কঠিন।
ক্রমশ ছোট হতে থাকা পৃথিবীটা যেন হঠাৎই আবার বিশাল বড় হয়ে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফিরে যাচ্ছে
আজকের দিল্লিকে দেখলে গালিব কী লিখতেন জানা নেই। কিন্তু সমকালীন ঘটনার অভিঘাত যদি কবিমানসকে বিষণ্ণ করে
ইতিহাস শুধু অতীতের স্মৃতিচারণ নয়, সেটা বর্তমানের পটভূমিতে অতীতকে জরিপ করে নেওয়াও বটে।