“সুধাম শ্রীরামপুর শোভা অবিরাম,
হাতে ঝুলী, নামাবলী, মুখে হরিনাম।
এই স্থানে আদি মিশনারী নিকেতন,
দিনামার-নরপতি-সদনে স্থাপন।
কিবা কালেজের বাড়ী দেখিতে সুন্দর,
অগণন বাতায়ন, দীর্ঘ কলেবর।“
দীনবন্ধু মিত্র (সুরধুনী কাব্য)
কথিত আছে, ‘গঙ্গার পশ্চিম উপকূল বারাণসী সমতুল’। কলকাতার অনতিদূরে ভাগীরথীর (স্থানীয় ভাবে যা গঙ্গা নামেই পরিচিত) পশ্চিমপাড়ের শহর শ্রীরামপুরও ঐতিহাসিক গরিমায় সমৃদ্ধ। সম্প্রতি ডেনমার্কের জাতীয় সংগ্রহশালা এবং কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে শ্রীরামপুর শহরের ইতিহাস নিয়ে একটি ছোট তথ্যচিত্র তৈরি করা হয়। সেখানে নিপুণ ভাবে তুলে ধরা হয়েছে স্বল্পখ্যাত এই মফঃস্বলের অতীত আখ্যান।
উত্তরে ভাগীরথী, দক্ষিণে রিষড়া, পূর্বে ভাগীরথী এবং পশ্চিমে ইস্টার্ন রেলওয়ের লাইন পরিবেষ্টিত হয়ে শ্রীরামপুর শহরের বর্তমান অবস্থান। 1612 খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের সম্রাট চতুর্থ ক্রিশ্চিয়ানের আমলে ভারতে বাণিজ্য করার উদ্দেশ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠন করা হয়। 1755 খ্রিস্টাব্দে দিনেমাররা প্রথম শ্রীরামপুরে আসেন এবং অনতিদূরে চন্দননগরে অবস্থিত ফরাসি প্রশাসনের সহায়তায় শ্রীরামপুরে 60 বিঘা জমিতে বসবাস শুরু করেন। ডেনমার্কের সিংহাসনে এই সময়ে যিনি বসেছিলেন, সেই রাজা পঞ্চম ফ্রেডরিকের নামানুসারে শ্রীরামপুরের নয়া নামকরণ হয় ফ্রেডরিক নগর। দিনেমাররা এই দেশে তিনটি স্থানে তাদের কুঠি নির্মাণ করেছিল। তার একটি ছিল দক্ষিণ ভারতের ত্রিবাঙ্কুরে, একটি ওড়িশার বালেশ্বরে এবং আর একটি এই শ্রীরামপুরে। তবে ব্যবসায়িক মুনাফার দিক থেকে শ্রীরামপুরের কুঠি অন্য দুটি কুঠির তুলনায় অনেক বেশি লাভজনক ছিল। দিনেমারদের সঙ্গে ব্যবসা করে শ্রীরামপুরের স্থানীয় দে, সাহা এবং গোস্বামী পরিবারও যথেষ্ট প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী হয়ে ওঠে। এই সব পরিবারগুলির অতীতের বৈভব বর্তমানে অক্ষুণ্ণ না থাকলেও, খিলান দেওয়া রাজবাড়িগুলি এখনও অতীতের সুদিনকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এই প্রসঙ্গে দে বাড়ির প্রবীণ সদস্য তাপস কুমার দে বলছিলেন, ‘অতীতের সেই গরিমা না থাকলেও এখনও বাড়ির পুরনো ঠাকুর দালানে ধুমধাম করে দুর্গাপুজো হয়। এই বছর সেই পুজো 272 বছরে পা দেবে। একইভাবে পালিত হয় রাস, দোলের মতো উৎসবগুলিও।’ তাপস বাবু জানাচ্ছিলেন, শ্রীরামপুরের স্টেশন সংলগ্ন বড় রাস্তাটিও এই বাড়ির সদস্য প্রয়াত বড়দা প্রসাদ দে-র নামাঙ্কিত।
দিনেমাররা কিন্তু অন্যান্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিগুলোর মতো শুধু ব্যবসা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা পাকাপাকিভাবে শ্রীরামপুরে বসতি স্থাপন করতেও চেয়েছিল। শ্রীরামপুরের দিনেমার গভর্নর কর্ণেল বাই 1805 সালে শহরের বুকে সেন্ট ওলাফস গির্জা নির্মাণ করেন। যে সমস্ত ইউরোপীয়রা শ্রীরামপুরে বেড়াতে আসতেন তাদের কথা ভেবেই এই গির্জা তৈরি করা হয়। পরবর্তীকালে অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি আর ভোলা ময়রার কবিগানের লড়াইয়ে আমরা শুনতে পাই, ভোলা ময়রা অ্যান্টনিকে বিঁধে গান বাঁধছেন-
“তুই জাত্ ফিরিঙ্গী জবড়জঙ্গী, আমি পারবো নারে তরাতে।
যিশুখ্রীষ্ট ভজ্-গা তুই শ্রীরামপুরের গির্জাতে।।“
শ্রীরামপুরের গির্জা বলতে ভোলা ময়রা এই সেন্ট ওলাফস গির্জার কথাই বলেছেন, যেখানকার সাপ্তাহিক প্রার্থনায় অ্যান্টনি কবিয়াল অংশ নিতেন। শহরের বিশপ হেবার সেই সময়ের শ্রীরামপুরকে ইউরোপীয় শহরের সঙ্গে তুলনা করে বলেন- ‘It looked more of a European town than Kolkata.’
তবে বাংলার নবজাগরণের ইতিহাসে শ্রীরামপুরকে সর্বাধিক পরিচিতি দিয়েছিল শ্রীরামপুর মিশন প্রেস। উইলিয়াম কেরি, জোসুয়া মার্শম্যান এবং উইলিয়াম ওয়ার্ড— তিন খ্রিস্টান মিশনারি খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ডেনমার্ক থেকে এসে শ্রীরামপুরে মিলিত হয়েছিলেন। যদিও তাঁদের এই মোলাকাত হওয়ার ব্যাপারটা ছিল যথেষ্ট কাকতালীয়। 1799-তে ভারতে এসে নিজেদের কাজ শুরু করা মার্শম্যান এবং ওয়ার্ড মালদায় বসবাস করা কেরির সঙ্গে দেখা করতে চাইলেও, ব্রিটিশ প্রশাসন এবং লর্ড ওয়েলেসলি তাঁদের বাধা দেন। শেষে কেরিই শ্রীরামপুরে এসে দু'জনের সঙ্গে দেখা করেন। তিনজনে একত্রে তৈরি করেন শ্রীরামপুর মিশন প্রেস। নতুন মুদ্রাযন্ত্রে দেশে প্রথম ছাপার অক্ষরে পুস্তক প্রকাশিত হয়। এই ছাপাখানা থেকেই বাংলা ভাষায় অনুদিত বাইবেল প্রকাশিত হয়। কেরি সাহেবের বাংলা ব্যাকরণ, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলার শিক্ষক রামরাম বসুর ‘প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ ছাড়াও প্রথম মুদ্রিত সাময়িক দিগদর্শন, সংবাদপত্র ‘সমাচার দর্পণ’-ও এই মিশন প্রেস থেকেই মুদ্রিত হয়। সেই অর্থে দেশে মুদ্রণ বিপ্লবের সূতিকাগার ছিল এই শ্রীরামপুর।
শ্রীরামপুরের এই মিশনারী ত্রয়ী 1827 খ্রিস্টাব্দে স্থাপন করলেন এশিয়ার প্রথম ডিগ্রি কলেজ, শ্রীরামপুর কলেজ। 1857 সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হওয়ার পর প্রথম যে 8টি কলেজকে এর আওতাধীন করা হয়, শ্রীরামপুর কলেজ তার মধ্যে অন্যতম। এখনও শ্রীরামপুর কলেজের গ্রিক গথিক শিল্পশৈলীতে নির্মিত মূল ভবনটি শহরের শোভাবর্ধন করে।
এখন শ্রীরামপুর শহরও কসমোপলিটান শহরে উন্নীত হচ্ছে। চারদিকে চোখ ধাঁধানো শপিং মল, রেস্টুরেন্ট। তার মধ্যে কোথাও যেন বহু দশকের ধুলো মেখে মলিন হয়ে গিয়েছিল দিনেমারদের এই স্থাপত্যকীর্তিগুলি। তাই অতীতের ধুলো সরিয়ে শ্রীরামপুরের পুরনো ইতিহাসকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতেই ডেনমার্ক প্রশাসন বিশেষ উদ্যোগী হয়ে ওঠে। বয়সের ভারে ন্যুব্জ সেন্ট ওলাফস গির্জা, ডেনমার্ক ট্যাভার্নকে বহুদিনের চেষ্টায় আধুনিক রূপে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এই আধুনিকীকরণের প্রক্রিয়াটি কীভাবে এগিয়েছে, তার কিছুটা আভাস এই তথ্যচিত্র থেকে পাওয়া যায়। তথ্যচিত্রের সঙ্গে যুক্ত, শ্রীরামপুর কলেজের অধ্যাপক ভাস্কর চৌধুরীর বক্তব্য, ‘শ্রীরামপুরের স্বর্ণোজ্জ্বল অতীতকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতেই আমাদের এই উদ্যোগ।‘
দিনেমাররা এই শহরে স্থায়ী হননি। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগেই শ্রীরামপুর শহরকে তারা ইংরেজদের কাছে বিক্রি করে দিয়ে দেশে ফিরে যান। কিন্তু এই শহরের আনাচে কানাচে এখনও দিনেমারদের কীর্তির স্মারকগুলো রয়ে গেছে। শ্রীরামপুর মানে শুধুই ভারত বিখ্যাত মাহেশের রথ নয়। শহর কলকাতা থেকে প্রায় 28 কিমি দূরের এই শহর কিন্তু বাংলার নবজাগরণেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল, আর তাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন দিনেমাররা। বাংলার সমাজজীবনে হিন্দু এবং খ্রিস্টান সংস্কৃতির সমন্বয়সাধনেও শ্রীরামপুরের ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় রয়ে গেছে।
আপাতত রণে ভঙ্গ দিলেও সুনার বঙ্গালের কারিগরদের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
শিল্পী মাত্রেই সংশয়ী, সংশয়ী হওয়া মানেই পরশ্রীকাতর হওয়া নয়
প্রতিস্পর্ধা-সঞ্জাত, স্বাতন্ত্রমন্ডিত আলোকবর্তিকাই 2022-এর অন্ধকার দিকগুলোয় আলো ফেলবে।
এককালের নবজাগরিত কলকাতার বহু অন্তর্জলি যাত্রা দেখা নন-এসি মেট্রোর বিদায় হল গীতাপাঠের মাধ্যমে!
পাজি, কাঠিবাজ মিডল ক্লাসকে জব্দ করা মার্ক্সের কম্মো নয়, এই কাজটাও একমাত্র মোদীজিই পারেন!
শহরের বৈচিত্র্যময় মিছিলে বিভাজন রোখার ডাক।