প্রাথমিক শিক্ষা সংক্রান্ত নানা সমীক্ষায় দেখা যায় পঞ্চম শ্রেণির পড়ুয়া সরল বাংলা বাক্য পড়তে পারে না, দুই অঙ্কের সংখ্যা যোগ করতে পারে না। শিক্ষার অধিকার আইন বলবত্ হয়েছে এক যুগ হয়ে গেল। সব ধরনের পড়ুয়াকে স্কুলে টেনে আনতে সারা দেশে চালু রয়েছে মিড-ডে মিল। পণ্ডিতরা বিতর্ক করেই চলেছেন পাশ-ফেল প্রথা থাকা উচিত কি উচিত না। পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষার মূল সমস্যাটা কোথায়?
পরিকাঠামোগত সমস্যা :
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে ২৩টি জেলায় প্রায় ৫০ হাজারের মত প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। যার মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ গ্রামীন এলাকায়। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম, সর্বশিক্ষা অভিযান, সর্বশিক্ষা মিশনের সহযোগিতায় পরিকাঠামোগত অনেক উন্নতি হলেও অনেক বিদ্যালয়ে এখনো সীমানা প্রাচীর নেই। প্রতিটি বিদ্যালয়ে পানীয় জলের ব্যবস্থা থাকলেও সেই পানীয় জল কতটা পরিশ্রুত তা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা হয় না বললেই চলে। একজন অবর বিদ্যালয় পরিদর্শককে দুই তিনটি মন্ডলের দায়িত্ব সামলাতে হচ্ছে, এর ফলে কোনও সঠিক পরিদর্শন হচ্ছে না। সার্কল অফিসগুলোতে কর্মীর অভাবে অনেক কাজ শিক্ষকদের দিয়েই করাতে হচ্ছে, এতে বিদ্যালয়ে পঠন পাঠনে ব্যাঘাত ঘটছে। রাজ্যের সমস্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিকে একই ছাতার তলে আনতে ‘বাংলার শিক্ষা মিশন’ নামে একটি অনলাইন পোর্টালের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটি খুব ভালো উদ্যোগ, কিন্তু শিক্ষকদের মধ্যে এই ব্যাপারে সঠিক প্রশিক্ষণ না থাকাতে অনেক সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। অনলাইন পোর্টাল চালু হলেও বিদ্যালয়গুলিতে নেই কোনও কম্পিউটারের ব্যবস্থা। বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার কথা থাকলেও আসলে তা সঠিকভাবে হয়ে উঠে না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় গোটা শিক্ষাবর্ষে একবারও শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয় না।
মিড-ডে মিল পরিচালনায় সমস্যা:
অনেকগুলি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বিদ্যালয়স্তরে মিড-ডে মিলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সত্যি বলতে সরকারি বিদ্যালয়ে মিড-ডে মিলের ব্যবস্থা একটি বৈজ্ঞানিক ভাবনা। বিশ্বের দরবারে এই নিয়ে আমাদের দেশের সুনাম রয়েছে। এই প্রকল্প রূপায়ণে যা মূল্য ধার্য্য করা হয় তা দিয়ে সঠিক পুষ্টিযুক্ত খাবার পরিবেশন করা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। প্রাথমিকে ছাত্র প্রতি 4.48 টাকা এবং সপ্তাহে একদিন আবশ্যিক ডিম দিতে হবে। এই অগ্নিমূল্য বাজারে কীভাবে এত অল্প টাকায় মিড-ডে মিল দেওয়া হয় তা যারা এই প্রকল্প চালাচ্ছেন তারাই ভালোভাবে জানেন। এর ফলস্বরূপ শিক্ষার্থীরা সঠিক পুষ্টিযুক্ত খাবার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্র প্রতি কত টাকা বরাদ্দ হওয়া উচিত তা অমর্ত্য সেনের প্রতিচি ট্রাস্টের গবেষণা অনুযায়ী ন্যূনতম 7.05 টাকা হওয়া উচিত। এই ব্যাপারে কোনও ক্ষেত্রেই কোনও উদ্যোগ দেখা যায় না। অতীব কষ্টে এই প্রকল্পটি চলছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দিয়েই এই প্রকল্প চলছে। মিড-ডে মিলের বাজারঘাট সব কিছুই তাদের করতে হচ্ছে, এর ফলে পাঠদানেও তৈরি হচ্ছে অনেক সমস্যা।
পাঠক্রম ও সিলেবাসগত সমস্যা:
প্রাথমিক স্তরে সঠিক কী পাঠক্রম থাকা উচিত তা নিয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা চলছে। National Curriculum Frame work 2005 বা জাতীয় পাঠক্রমের রূপরেখা 2005, সারা দেশে বুনিয়াদী শিক্ষায় ঠিক কী পাঠক্রম রাখা উচিত তা নিয়ে দিশা দেখিয়েছে এবং শিক্ষার অধিকার আইন 2009-এ একে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। বর্তমান প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাক প্রাথমিক শ্রেণি চালু করা হয়েছে। ‘কুটুম কাটাম’ এবং ‘মজারু’ নামে দুটি বই রয়েছে। প্রাক প্রাথমিকে পাঠক্রম খুব স্বল্প হওয়াতে তাড়াতাড়ি বইগুলো থেকে শিখন প্রক্রিয়া সমাপ্ত হয়ে যায়। এই নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যেও অনেক প্রশ্ন থাকে। অনেকে মনে করেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের থেকে বেসরকারি বিদ্যালয়ের পাঠক্রম অনেক ভালো। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তি না করানোর এটি একটি অন্যতম কারণ। Learning without burden (ভারমুক্ত শিখন) কথাটি মাথায় রেখে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ‘আমার বই’ নামে একটি মাত্র বই তৈরি হয়েছে। প্রথমে বইটি বেশ ভারযুক্ত থাকায় তাকে তিনটি খণ্ডে বিভাজিত করা হয়েছে এবং বইটিকে পাঠ শেষে বিদ্যালয়ে রেখে দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। শিশুদের বইয়ের ভার ও মানসিক ভার কমানোর জন্য এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হল অভিভাবকরা বুঝতে পারছে না তাদের শিশুরা ঠিক কী শিখছে? তারা বাড়িতে সেই ভাবে তাদের শিশুদের ঠিক মতো গাইড করতে পারছে না। এর ফলে অভিভাবকদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। প্রাথমিকের ইংরেজি পড়ানো নিয়ে প্রচুর মতবিরোধ থাকলেও বর্তমানে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি চালু আছে। তবে তৃতীয় শ্রেণির দ্বিতীয় ভাষার পাঠক্রম বেশ জটিল, অনেক সময় পাঠদানে শিক্ষক-শিক্ষিকারাও সমস্যায় পড়ছেন। বিশেষ করে দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠ শেষে শিশুরা যখন তৃতীয় শ্রেণিতে দ্বিতীয় ভাষা শিখতে যাচ্ছে তখন সেই শ্রেণির পাঠক্রম খুব কঠিন মনে হচ্ছে তাদের কাছে। তৃতীয় শ্রেণি থেকে ইতিহাস, ভূগোল ও বিজ্ঞান বইয়ের বদলে একসাথে সবগুলো বিষয়কে রেখে তৈরি হয়েছে "আমাদের পরিবেশ’। এই বইটিতে যেভাবে তথ্য দিয়ে তৈরি করা হয়েছে তা শিক্ষার্থীদের কাছে উৎসাহব্যঞ্জন নয়। পাঠ শেষে শিক্ষার্থীরা ঠিক কী জানবে তার সঠিক দিশা নেই। গণিতের ক্ষেত্রে অনেক বাস্তব উদাহরণের সাহায্যে গণিতের বইগুলি তৈরি হয়েছে। গণিতে অধ্যায়গুলির শুরুতেই Mathematical meta language-এর ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় শিক্ষক-শিক্ষিকা গণিতে শুধুমাত্র সমস্যা সমাধান পদ্ধতি শেখাতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। এই ব্যাপারে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ্যে Orientation Programme-এর প্রয়োজন আছে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়ে উঠছে না।
মূল্যায়নগত সমস্যা:
বর্তমানে উচ্চ প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত সামগ্রিক ও নিরবিচ্ছিন্ন ( Comprehensive and Continuous Evaluation) মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু আছে। যার দুটি ভাগ, একটি হল প্রস্তুতিকালীন মূল্যায়ন এবং অপরটি হল সামগ্রিক মূল্যায়ন। প্রাথমিক স্তরে প্রস্তুতিকালীন মূল্যায়নে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে এবং এতেই বেশি নম্বর রাখা হয়েছে। এই প্রথা অনুযায়ী শিশুদের প্রতিদিন মূল্যায়ন করা হবে। এই মূল্যায়ন শ্রেণি কক্ষের ভিতরে বাইরে সর্বত্র করা হয়ে থাকে। শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যা কতটা অর্জন করেছে তার জন্য এই মূল্যায়ন নয়, এই মূল্যায়ন শিশুদের সার্বিক বিকাশের জন্য। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় এই পদ্ধতিটি সব চেয়ে বেশি অবহেলিত হয়ে থাকে। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ্যে সঠিক ধারণা না থাকায় অনেকক্ষেত্রেই শিশুদের মধ্যে অবমূল্যায়ন হচ্ছে। এই ব্যাপারে প্রশিক্ষণ এবং ওয়ার্কশপ হলেও সকল শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছে সঠিক ভাবে না পৌঁছানোয় তারা সঠিক ভাবে মূল্যায়ন করতে পারছে না। শিশুদের বৃদ্ধি এবং বিকাশ ভীষণ ভাবে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু বাস্তবে রিপোর্ট কার্ডে শিশুদের বৌদ্ধিক বিকাশকেই তুলে ধরা হয়, শারীরিক বিকাশকে সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। সাময়িককালের মধ্যে শিশুদের কাম্য শিখন সামর্থ্য (E xpected Learning Outcome) স্তর অনুযায়ী স্থির করা হয়েছে। শিশুদের কোনও একটি শ্রেণির পাঠদান শেষে ঠিক কী কী বিষয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা জন্মাবে তা যাচাই করা হবে। প্রতিটি বিদ্যালয়ে সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী এই কাম্য শিখন সামর্থ্যের পোস্টার লাগানোর কথা বলা হয়েছে এবং অভিভাবকদের কাছেও তা থাকবে। অভিভাবকরা এগুলো দেখে বুঝবে তাদের শিশুরা বিদ্যালয়ে ঠিক কী শিখবে বা শিখতে চলেছে। কিন্তু বাস্তবে অভিভাবকদের কাছে এরকম তথ্য এখনও পৌঁছয়নি। অর্থাৎ শুরুতেই মুখ থুবড়ে পড়েছে এই উদ্দেশ্য।
শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পেশাগত সমস্যা:
শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পেশাগত সমস্যা প্রাথমিক শিক্ষার প্রসারে অনেকটা বাধার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। NCTE-এর নিয়ম মেনে শিক্ষক-শিক্ষিকারা প্রাথমিক শিক্ষকতার পেশায় যোগদান করেন। কিন্তু বেতন পাচ্ছিলেন পুরনো হারেই। যেখানে এই রাজ্যের আশেপাশে সব রাজ্যেই প্রাথমিক শিক্ষকদের উন্নত বেতন কাঠামো রয়েছে। বর্তমানে যারা এই পেশায় আসেন তাদের কারও যোগ্যতা স্নাতকের নীচে নয় এবং কঠিন প্রতিযোগিতায় সফল হয়ে আসতে হয়। প্রত্যেকে একটা স্বপ্ন নিয়ে আসেন এবং নিজেদের কেরিয়ার সঠিক ভাবে গড়ে তুলতে চান। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় এই অবস্থার ফলে অনেক মেধাবী প্রাথমিক শিক্ষক-শিক্ষিকা এই চাকরি ছেড়ে অন্য চাকরিতে চলে যাচ্ছেন, যা শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে মোটেও ভালো নয়। যদিও বর্তমানে শিক্ষকদের আন্দোলনের চাপে প্রাথমিক শিক্ষকদের কিছুটা উন্নত বেতন কাঠামো চালু হলেও একরাশ বৈষম্য রেখে দেওয়া হয়েছে। চরম বঞ্চনা সহ্য করে এক প্রকার বাধ্য হয়েই এই পদে চাকরি করতে হচ্ছে। হয়তো কোনও সরকার পক্ষই প্রাথমিক শিক্ষা এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাদের তেমন গুরুত্ব দিতে চায় না এই দৃষ্টিভঙ্গির বদলের প্রয়োজন আছে । বদলি নীতিতে রয়েছে স্বজন পোষণ। এর ফলে অনেকের মনোবল ভেঙে যায়। কিছু নিয়োগের সময় বিস্তর অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে যা দেখে সমাজের লোকজন প্রাথমিক শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ভালো নজরে দেখেন না। যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক তারা কোনওরকম সুবিধে পাননা। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষাকর্মী বা GROUP D স্টাফ না থাকায় সবটা কাজ সেই শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরই করতে হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে স্থায়ী প্রধান শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে না। এক প্রকার মুখ বুজে সব সহ্য করতে হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষার মূল সমস্যাটা কোথায়?