×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • মেরুকরণের শাখা পল্লবিত হল না বাংলায়

    বিতান ঘোষ | 10-05-2021

    প্রতীকী ছবি।

    শত প্রচেষ্টাতেও আড়াআড়ি ভাঙল না বাংলা। বাউল গান আর মুর্শিদির সুরে এক হয়েই বাজল বাংলার একতারা। উল্টোদিকে প্ররোচনা তো কম কিছু ছিল না। এখনও যে নেই, তেমনটাও নয়। বিজেপি না জিতলে সটান পাকিস্তানে বোম-ফোম পড়ার কথা ছিল, সে সব কিছুই হল না। উল্টে শত প্ররোচনা ও প্রণোদনাতেও বাংলায় আরও কিছুদিনের জন্য হিন্দু-মুসলিম এক হয়েই রয়ে গেল। 

     

     

    বিজেপি আগাগোড়া এই নির্বাচনকে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের ফর্মুলায় ফেলতে চেয়েছিল। 30 শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ এমনিতেই সম্প্রদায়গত রাজনীতির এক অতি-উত্তম পরীক্ষাগার। কিন্তু এই ফর্মুলায় বিশেষ কল্কে পেল না বিজেপি। অথচ, 34 শতাংশ সংখ্যালঘুর বাসস্থান আসামের ফলাফল বলছে মেরুকরণের প্রায় সবটুকু ফায়দা উসুল করেছে বিজেপি। উজানি অসমে অবশ্য কংগ্রেস আর বদরুদ্দিন আজমলের এআইইউডিএফ-ও এই মেরুকরণের কিছু সুফল নিজেদের অনুকূলে আনতে পেরেছে। কিন্তু আজমলের দলকে সাম্প্রদায়িক ইসলামিক দল বলে দেগে আসামের হিন্দু ভোটকে একত্রিত করতে সক্ষম হয়েছে বিজেপি। অন্যদিকে কংগ্রেস আর এআইইউডিএফ-ও বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির মোকাবিলায় সংখ্যালঘু সমাজকে তাদের পক্ষে ভোট দেওয়ার আবেদন জানিয়ে সাফল্য পেয়েছে। এই বৃহত্তর বাইনারিতে মলিন হয়ে গেছে ভূমিপুত্র রক্ষার দাবিতে লড়াইয়ে নামা আঞ্চলিক দলগুলির নির্বাচনী সাফল্য। বাংলায় কিন্তু এই মোটা দাগের ভোট-বিভাজন ঘটেনি। 2019-এর ভোট চিত্রে কিন্তু এই ক্রমবর্দ্ধমান ধর্মীয় মেরুকরণ এবং ভোট বিভাজনের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল। সেবার মোট হিন্দু ভোটের 57 শতাংশ নিজেদের ঘরে তুলে এবং 18টি আসন পেয়ে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল বিজেপি। উল্টোদিকে তৃণমূল হিন্দু ভোটের মাত্র 32 শতাংশ নিজেদের অনুকূলে আনতে পেরেছিল। এর পাশাপাশি তফসিলি জাতি-জনজাতিদের ভোটের সিংহভাগ পদ্ম-শিবিরে যাওয়ায় মাত্র 22টি আসনে জিতেই থামতে হয় 42টি আসন পাওয়ার স্বপ্ন দেখা তৃণমূলকে। 

     

     

    বিজেপি নেতারা 2019-এর ফল দেখে স্থির করে নিয়েছিলেন এই মেরুকরণটাকে আর একটু চওড়া করা প্রয়োজন। তাঁরা এই আশাও করেছিলেন সংখ্যালঘু ভোট একচেটিয়া ভাবে তৃণমূলের পক্ষে থাকবে না। সংখ্যালঘু ভোটের একটা বড় অংশ সংযুক্ত মোর্চার ঘরে যাবে বলেই তাঁরা তাঁদের অভ্যন্তরীণ হিসাবনিকাশ শুরু করেছিলেন। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে আব্বাস সিদ্দিকিকে নিয়েও বিজেপি নেতৃত্ব যথেষ্ট নরম অবস্থান নিয়েছিলেন। টেলিভিশনের পরিচিত মুখ, বিজেপির প্রথমসারির নেতাকে ভোটের আগে আব্বাসের বিষয়ে প্রশ্ন করায় তিনি জানিয়েছিলেন, ‘শুধু তৃণমূলই মুসলমানদের নিয়ে রাজনীতি করবে নাকি? আব্বাসকে বাংলার রাজনৈতিক ময়দানে বিজেপি স্বাগত জানায়।' ভোটের ফল থেকে স্পষ্ট বিজেপির সংখ্যালঘু ভোট বিভাজন আর হিন্দু ভোট একত্রীকরণের সেই চিরায়ত ফর্মুলা বাংলায় মুখ থুবড়ে পড়েছে। 21-এর নির্বাচনে গত লোকসভার তুলনায় তৃণমূলের পক্ষে 7 শতাংশ হিন্দু ভোট বেশি এসেছে। এবং এই ভোটটা পুরোটাই এসেছে বিজেপির ঘর ভেঙে। অন্যদিকে গত লোকসভায় যেখানে 70 শতাংশ সংখ্যালঘু মানুষ তৃণমূলের ওপর আস্থা রেখেছিলেন, সেখানে এবার 75 শতাংশ সংখ্যালঘু মানুষ তাদের ওপর আস্থা রেখেছেন। এই অতিরিক্ত 5 শতাংশ ভোটটা যে বাম-কংগ্রেসের ঘর থেকেই এসেছে, তা বোঝার জন্য বেশি মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই

     

     

    এতো গেল ভোট পাটিগণিতের কথা। কিন্তু এর বাইরেও একটা অন্য ভোট-রসায়ন আছে। গত লোকসভা নির্বাচনের পরে একটি জাতীয় সমীক্ষক সংস্থার ভোট-পরবর্তী সমীক্ষায় একটি চমকপ্রদ তথ্য উঠে এসেছে। বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন এরকম প্রতি 5 জন হিন্দু ভোটারের মধ্যে 4 জনই বলেছেন, তাঁরা মনে করেন ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। তাই এই দেশে প্রত্যেকটি ধর্মের মানুষের স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। আরও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়, এই 4 জন জানিয়েছেন, তাঁরা মনে করেন, 1992 সালে বাবরি মসজিদ ভেঙে দেওয়া অন্যায় হয়েছিল। এখন প্রশ্ন হল, এই ভোটাররা তবে সেবার বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন কেন? এ ব্যাপারে সমীক্ষায় যে ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে, তার ভিত্তিতে বলা যায় স্থানীয় কোনও কারণে তাঁরা এই বড়সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলেন। হতে পারে, এই ভোটাররা অতীতে বামদলগুলিকে ভোট দিতেন, কিন্তু সেবার তৃণমূলকে হারাতে বিজেপিকে ভোট দেন। কিংবা, 2018-র পঞ্চায়েত ভোটে শাসক তৃণমূলের গা-জোয়ারিতে বিরক্ত হয়ে তাঁরা এ রাজ্যে প্রায় অপরীক্ষিতশক্তি বিজেপিকে বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু 21-এর ফলাফল বলছে এই ভোটারদের অধিকাংশের ভোট এবার তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে গেছে। অর্থাৎ, মাত্র দুবছরেই বিজেপির প্রতি এঁদের মোহভঙ্গ হয়েছে। উল্টে বিজেপিকে রুখতে যাঁরা তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন, সেরকম 5 জন ভোটারের মধ্যে একজন মেনে নিয়েছেন তৃণমূল সংখ্যালঘু তোষণকরে

     

     

    অতএব, বিজেপি যে সহজ অঙ্কে মেরুকরণের স্বপ্ন দেখেছিল, তা বাংলায় হয়নি। এমনিতেই বাংলার মিশ্র সংস্কৃতি এবং আরও অন্যান্য কারণে হিন্দু ভোট কখনওই এককাট্টা হয়ে কোনও একটা নির্দিষ্ট দলের পক্ষে যায় না। সংখ্যালঘু ভোটও মোটের ওপর একটা দলের দিকে গেলেও, বাংলার মুসলমানরা কখনওই একটা ভোটব্যাঙ্ক হিসাবে ভোট দেন না। এবারে বিজেপির নেতারা এমন খুল্লামখুল্লা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চাষ না করলে হয়তো সংখ্যালঘু ভোটের কিছু অংশ সংযুক্ত মোর্চার দিকে যেতে পারত। কিন্তু সংখ্যালঘুরা হয়তো চেয়েছিলেন বিজেপি বিরোধী ভোটটাকে এককাট্টা করতে, অনেক বর্ণহিন্দুও যেমন এটা চেয়েছিলেন৷ এখানেই বিজেপির অঙ্কটা ঘেঁটে যায়। 

     

     

    স্থানীয় এক বিজেপি নেতা সখেদে বলছিলেন, “ওড়িশায় মাত্র 2.5 শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট। সেখানে জয় শ্রীরামবললে, পালটা জয় জগন্নাথধেয়ে আসে। তাছাড়া সে রাজ্যে হিন্দুরা সংকটে আছে বললে হিন্দু ভোট এককাট্টা হয় না। কিন্তু আমরা ভেবেছিলাম বাংলায় 30 শতাংশ সংখ্যালঘুর জুজুদেখিয়ে হিন্দু ভোটকে এককাট্টা করা যাবে। কিন্তু তা হল না।'' ‘এ ব্যথা কী যে ব্যথা বোঝে কি আর জনে...!


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    পোশাক দেখে অপরাধী চিনে ফেলা ক্ষমতাসীনই, তার মতানুসারে চালাতে চায় সকলকে।

    ‘আসিতেছে বিপদের দিন, চাষিরা করিতেছে হম্বিতম্বি, চোখ রাঙাইছে চিন!’

    দেশের পূর্ব প্রান্তে দুই প্রতিবেশী রাজ্যের বিরোধ প্রায় দুই দেশের সংঘর্ষের চেহারা নিচ্ছে

    পুরুষ সদস্যের মুখাপেক্ষী না থেকে, আর্থসামাজিক স্বাবলম্বনকে বুঝি 'ভিক্ষাবৃত্তি' বলে?

    বুকের মাঝে আস্ত একটা দেশকে যারা লালন করতে ব্যর্থ, তারাই ভাগাভাগির কথা বলে।

    হে রাম! গান্ধী-সুভাষ ভিক্ষা করেও স্বাধীনতা আনতে পারলেন না, আনলেন সেই মোদীজি।

    মেরুকরণের শাখা পল্লবিত হল না বাংলায়-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested