×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • ‘তিনি বৃদ্ধ হইলেন', তবু বার্ধক্যে পৌঁছলেন না

    বিতান ঘোষ | 13-04-2020

    নেহরু এবং অন্যান্যরা

    রাজনৈতিক গুরু গান্ধীজির স্বপ্নের স্বয়ংশাসিত গ্রাম কেন্দ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখতে পারেননি তিনি। সদ্য স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রনেতা হিসাবে তিনি মনে করেছিলেন, ভারী শিল্পায়ন অপরিহার্য। আজ স্বাধীনতার 73 বছর পরে ইতিহাসের এক অদ্ভুত সমাপতনে সেই জওহরলাল নেহরুর চিন্তাভাবনাকেই পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হচ্ছে। দেশের শীর্ষ নেতারা নেহরুর বিবিধ তত্ত্বকে অসাড় প্রমাণ করতে নেমে পড়েছেন। এমনিতে নেহরু ভারতীয় জনমানসে সাদা-কালোয় বিভাজিত এক চরিত্র। কারও চোখে তিনি হিরো, কারও কাছে তেমনটা নন। একদিকে, তিনি চিনের হাতে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়া এক ‘দুর্বল' প্রধানমন্ত্রী। অন্যদিকে, ভারতকে বিশ্ব মানচিত্রে সম্মানের আসনে স্থাপিত করার ‘কারিগর'। সব মিলিয়ে নেহরুর অবদান হল, আত্মশক্তি সম্বন্ধে সচেতন এক নতুন ভারত গড়ে তোলা।

     

    সাম্প্রতিক হাইড্রোঅক্সিক্লোরোকুইন বিতর্কে অনেকেই ইন্দিরা গান্ধী এবং নরেন্দ্র মোদীর প্রতিতুলনা টানছেন। একাত্তরের ইন্দিরার সাহসিকতা ও পরিকল্পিত বিদেশনীতির সপ্রশংস উল্লেখের পাশাপাশি, আমেরিকার কাছে মোদীর আত্মসমর্পণের দিকটি ধিক্কৃত হচ্ছে। কিন্তু ইন্দিরার বিদেশনীতি তো হুবহু নেহরুর জোটনিরপেক্ষ ভারসাম্য নীতিরই অনুসারী। সেই হিসাবে তো প্রতিতুলনায় ইন্দিরা নন, নেহরুরই আসা উচিত।

     

    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর মেরুকৃত বিশ্বে আমেরিকা ও সোভিয়েত, যুযুধান দুই শক্তিবলয় থেকেই নেহরু দূরত্ব বজায় রেখেছেন। সর্বত্র কমিউনিজমের ভূত দেখে বেড়ানো আমেরিকা অবশ্য ভেবেছিল, নেহরুকে দাবার বোড়ে করে কমিউনিস্ট চিনকে ভয় পাওয়ানো যাবে। সেই উদ্দেশ্য যখন সাধিত হল না, মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব জন ফস্টার ডালেস নেহরুর এই তথাকথিত ‘নিরপেক্ষতা' নিয়ে বিদ্রুপ করলেন। বললেন, এই সব নেহরুর ‘নীতিজ্ঞানহীন নিরপেক্ষতা'। এর প্রত্যুত্তর নেহরু প্রায় দশ বছর পর দিয়েছিলেন। 1958 সালে, ভারতের সংসদে এক লিখিত বক্তব্যে তিনি বললেন, "It is completely incorrect to call our (foreign) policy Nehru's policy. I have not originated it. It is a policy inherent in the circumstances of India, inherent in the past thinking of India." ভারতের ধারণার মধ্যেই যে নীতি প্রোথিত আছে, তাকে অবশ্য তাঁর উত্তরসূরি ইন্দিরা খুব একটা সাদরে গ্রহণ করেননি। অন্তত প্রথম দিকে। নেহরু যে আমেরিকায় দাসপ্রথার বর্বরতা আর সীমাহীন বৈষম্য ছাড়া বিশেষ কিছুই খুঁজে পাননি, একদা সেই আমেরিকার প্রতিই ঝুঁকেছিলেন ইন্দিরা। সময়টা 1967 সাল। রুশ রাষ্ট্রনায়ক কোসিগিন তখন পূর্বসুরীদের অবস্থান পালটে, ভারত-পাক দুই দেশের প্রতিই সমদর্শী। 1965-1966, পরপর দু’বছরের খরায় দেশজুড়ে খাদ্য সংকট চলছে। এই পরিস্থিতিতে, মার্কিন সাহায্যে কৃতজ্ঞ ইন্দিরা বিশ্ব ব্যাঙ্ক ও আমেরিকার পরামর্শেই ভারতীয় টাকার অবমূল্যায়ন ঘটালেন। কিন্তু, অচিরেই তাঁর মার্কিন মোহ ঘুচল। মার্কিন রাষ্ট্রপতি নিক্সন ও তাঁর পরামর্শদাতা কিসিঞ্জারের ভারত-বিরোধী মনোভাব তাকে আশাহত করল। নেহরু অনুসৃত বিদেশনীতির অপরিহার্যতা দেরিতে হলেও হৃদয়ঙ্গম হলো তাঁর। এরপর 1977-এর জনতা সরকার, 1984-র রাজীব গান্ধীর সরকার, এমনকী 1999-এর বাজপেয়ী সরকার, নেহরুর বিদেশনীতির প্রাসঙ্গিকতাকে উপেক্ষা করতে পারেননি কেউই। নেহরুর গড়ে তোলা ভিত্তির উপরেই ভারতের বিদেশনীতির ঐতিহ্যের ইমারত গড়ে উঠেছে ধাপে ধাপে।

     

    সেই সময়কার ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বিশ্ব রাজনীতিতে ভারতকে এক নিরাপদ অথচ সুদৃঢ় স্থান দিয়ে গিয়েছিলেন নেহরু। এক্ষেত্রে তাঁর পাশ্চাত্য শিক্ষা লালিত তত্ত্বের সমাহার যেমন ঘটেছিল, তেমনি বাস্তবতার প্রতিফলনও ঘটেছিল। নিরস্ত্রীকরণের সোচ্চার সমর্থক নেহরুর আমলেই কিন্ত ভারত ইউরোপের প্রায় 5টি দেশ থেকে যুদ্ধাস্ত্র কিনেছিল। দেশের ভারী শিল্পে বিনিয়োগ করতে এগিয়ে এসেছিল, তিনটি ভিন্ন সমাজব্যবস্থার দেশ। দুর্গাপুরে ব্রিটেন, ভিলাইতে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং রাউরকেল্লায় জার্মানি। এশিয়া ও আফ্রিকার উন্নয়নশীল দেশগুলির বিশ্বস্ত বন্ধু হিসাবেও ভারতকে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন নেহরু।

     

    বর্তমান সরকারের আমলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশগুলির সঙ্গেও ভারতের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। কোথাও সেদেশের উপজাতিদের মদত দিয়ে (নেপালের মদেশীয়), আবার কোথাও বা অন্তর্দেশীয় কোন্দলে হস্তক্ষেপ করে (মলদ্বীপ), দেশগুলির চিন নির্ভরতা বাড়িয়ে দিয়েছে নর্থব্লক। প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দলের সমর্থকরা ভাবছেন, বিমানবন্দরের টারম্যাকে বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানকে জড়িয়ে ধরলে, কিংবা তাঁর সমর্থনে সভা করে সুমিষ্ট ভাষণ দিলেই দারুন ভালো কিছু একটা করা যাবে। কিন্তু বিদেশনীতির মতো জটিল বিষয় এতটা সরলরেখাতেও হাঁটে না। বিজ্ঞানভাবনা, গণতন্ত্রে সংখ্যালঘুর অবস্থান ইত্যাদি অনেক বিষয়েই নেহরুর ধারণা দেশের আজকের শাসকদের কাছে মূল্যহীন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এখনও তাঁর পঞ্চাশ বছর আগের পূর্বসূরির প্রতি রাগ ঝেড়ে ফেলতে পারেননি। নেহরু দেশকে কতটা পিছিয়ে দিয়েছেন, তা প্রমাণ করতে তিনি সদা তৎপর। কিন্তু তাঁকে এটা বুঝতে হবে, পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতিতেও অন্তত একটি বিষয়ে নেহরু এখনও অপরিহার্য। সেটা হলো বিদেশনীতি; ‘নেহরুভিয়ান ফরেন পলিসি'। যার প্রশংসা করা যায়, সমালোচনা করা যায়, কিন্তু উপেক্ষা করা যায় না। তাঁর রাজনৈতিক বিরোধীরাও সেই অসাধ্য সাধন করতে পারেননি। নেহরু অনেকদিন বৃদ্ধ হয়েছেন, কিন্তু কালান্তরেও তাঁর ভাবনায় বার্ধক্য আসেনি। 
     


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পরেও আফগানিস্তানের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রাখতেই হবে ভারতকে

    এই সঙ্কটে দেশের তাবড় রাষ্ট্রপ্রধানরা কে, কেমন ভূমিকা নিচ্ছেন

    রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষায় লাগাম পরানোর দুরূহ কাজও করতে হবে বিজেপিকে

    ‘সব খেলার সেরা’ আছে কিনা জানা নেই, তবে ফুটবলটাই আর বাঙালির নেই!

    ‘আসিতেছে বিপদের দিন, চাষিরা করিতেছে হম্বিতম্বি, চোখ রাঙাইছে চিন!’

    শ্রীরামপুরের গির্জা বলতে ভোলা ময়রা এই সেন্ট ওলাফস গির্জার কথাই বলেছেন

    ‘তিনি বৃদ্ধ হইলেন', তবু বার্ধক্যে পৌঁছলেন না-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested