সাময়িক শান্তিপর্বের শেষে ফের রক্তাক্ত মধ্যপ্রাচ্য। সারা বিশ্ব যখন কোভিডমহামারীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে, সে সময় ‘জমি দখলের যুদ্ধে’ লিপ্ত ইজরায়েল, প্রত্যাঘাত প্যালেস্টাইনেরও। এই লড়াই শুধু ভূ-কৌশলগত লড়াই নয়, একইসঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মরক্ষার লড়াইও বটে। এই লড়াইয়ের সূচনা হঠাৎ একদিনে শুরু হয়েছে, এমনও নয়। এর প্রেক্ষাপটে একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে, যুযুধান দুই শিবিরের নেপথ্যে বেশ কিছু বড় কুশীলব আছেন। ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন দ্বন্দ্বের এই বহুমাত্রিক ইতিহাসের বর্তমান পর্ব কোভিড পরিস্থিতির মধ্যেও সারা বিশ্বের বাড়তি উদ্বেগের কারণ।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকেই বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ইহুদিরা তাঁদের জন্য এক ঐক্যবদ্ধ দেশের কথা বলছিলেন। ইহুদিদের একাংশ তাঁদের ‘পবিত্র ভূমি’ প্যালেস্টাইনে এসে বসবাস শুরু করেন। প্যালেস্টাইন তখন তুর্কি রাজবংশের নিয়ন্ত্রণাধীন অটোমান সাম্রাজ্যের অধীন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের পরাজয় ঘটলে ব্রিটেন কিছুদিনের জন্য প্যালেস্টাইন অঞ্চলের দায়িত্ব নেয়। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব বালফোর 1917 সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায়, ইহুদিদের জাতীয় বাড়িতে (নিজেদের দেশ) সমবেত হওয়ার লড়াইকে একটি ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে স্বীকৃতি দেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বের নানা প্রান্তে, বিশেষত জার্মানিতে ইহুদিদের ওপর নির্মম অত্যাচারের ফলে ইহুদিরা আন্তর্জাতিক মহলের সহানুভূতি পেতে থাকেন। আমেরিকা ইহুদিদের এই স্বতন্ত্র হোমল্যান্ডের দাবি মেনে নেয়। 1948 সালে প্যালেস্টাইনের বুকে তৈরি হয় স্বাধীন সার্বভৌম ইজরায়েল রাষ্ট্র। প্যালেস্টাইন-বাসী আরবরা, অন্যান্য আরব দেশগুলি এই ঘটনাকে কোনওদিনই মেনে নিতে পারেননি। ইজরায়েলের বিশিষ্ট ঐতিহাসিক বেনি মরিস এবং ইলানা প্যাপে মিলিটারি আর্কাইভস ঘেঁটে তথ্য উদ্ধার করে তাঁদের বইগুলিতে দেখিয়েছেন যে, 1948 সালে ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ইহুদিরা বহু আরব পরিবারকে তাদের ভিটে থেকে জোর করে উচ্ছেদ করেছিল। প্যালেস্টানীয়রা তখন থেকেই উদ্বাস্তু ও শরণার্থী হতে শুরু করে। ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মের মানুষের কাছে পবিত্র শহর বলে গণ্য জেরুজালেমকে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ একটা মুক্ত আন্তর্জাতিক শহরের মর্যাদা দিলেও ইজরায়েল তা মানতে নারাজ।
বর্তমানে মানচিত্রে প্যালেস্টাইন খুঁজলে কিছু পাওয়া যাবে না। বরং গাজা স্ট্রিপ নামকরণের যথার্থতা প্রমাণ করে ইজরায়েল ও ভূমধ্যসাগর দিয়ে ঘেরা এক চিলতে জমি দেখা যাবে, আর আলাদা আর একটি তুলনায় বেশ বড় এলাকা দেখা যাবে, যার তিনদিক ইজরায়েল ও একদিক জর্ডন রাষ্ট্র দিয়ে ঘেরা। ইজরায়েলি সেনাবাহিনীর কড়া শাসনে প্যালেস্টানীয়রা এই দুই অঞ্চলের মধ্যে বসবাস করে। কিন্তু ইজরায়েল অন্তত কয়েক লক্ষ ইহুদিকে বিশ্ব জনমতকে উপেক্ষা করে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে স্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তাদের নিরাপত্তার জন্য আরব এলাকা ও ইহুদি এলাকার মধ্যে উঁচু পাঁচিল ও সেনা পাহারার ব্যবস্থা করেছে। গাজা স্ট্রিপ এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক থেকে প্রতিদিন যে আরবদের কাজের সন্ধানে ইজরায়েলে যেতে হয়, যে অসুস্থ রোগীদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়, তাদের নিয়মিত সেনাচৌকিতে পারমিট দেখিয়ে অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘক্ষণ। কখনও অনুমতি মেলে, কখনও মেলে না। হাজার হাজার বছর ধরে ইহুদিরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নির্যাতিত হয়ে এসেছে, যা চরমে ওঠে হিটলারের জার্মানিতে। পাঁচিল ও কাঁটাতারে ঘেরা কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, নিজেদের বাড়িঘর, ব্যবসা ইত্যাদি সব কিছু বেদখল হতে দেখা ও শেষে জীবন ও জীবিকা হারানোর সেই স্মৃতি ইহুদিদের মনে রয়েছে। বিশ্বের মানুষেরও সে জন্য ইহুদিদের প্রতি সহানুভূতি রয়েছে। কিন্তু সেই একই ধরনের অত্যাচার তারা গত 70 বছর ধরে আরবদের (প্যালেস্টানীয়দের) উপর করে চলায় ক্রমশই তারা আন্তর্জাতিক জনমতের একটা বড় অংশের (আমেরিকা প্রভৃতি কিছু বড় রাষ্ট্র বাদে) সহানুভূতি হারাচ্ছে।
ইজরায়েলের সম্প্রসারণবাদী মনোভাব বহু সময়েই শান্তির পরিবেশকে বিঘ্নিত করেছে। তাই চার চারটি যুদ্ধের পরেও মধ্যপ্রাচ্যের এই অংশে রক্তপাত থামেনি। আমেরিকা এবং পশ্চিমি রাষ্ট্রবর্গের একাংশের প্রত্যক্ষ মদত ও প্ররোচনায় ইজরায়েল ক্রমশ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে, আর প্যালেস্টাইনবাসী আরবরা হয়ে উঠেছেন নিজ ভূমে পরাধীন। ইজরায়েল কখনওই স্বাধীন প্যালেস্টাইনের অস্তিত্ব স্বীকার করেনি। তাকে নিজেদের অঞ্চলে অবস্থিত একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল মনে করেছে। প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি জেরুজালেমকে ইজরায়েলের রাজধানী বলে ঘোষণা করে গেছেন।
1967-র পর মিশর, ইরানের মতো অন্যান্য আরব দেশ আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাধ্যবাধকতায় প্যালেস্টাইনের পাশ থেকে সরে যায়। তারপর থেকে এতকাল প্যালেস্টাইন প্রায় একাই লড়াই করে এসেছে নিজেদের জীবন, মাটি রক্ষা করার জন্য। প্যালেস্টাইনের এই অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে দীর্ঘকাল সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন প্যালেস্টাইন মুক্তি বাহিনী (PLO)-র নেতা ইয়াসের আরাফাত। গোড়ার দিকের উগ্র জঙ্গিবাদী মনোভাব ছেড়ে তিনি বারবার ইজরায়েলের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসেছেন। কিন্তু এই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হয়তো ইজরায়েলও সন্তুষ্ট হয়নি। অন্যদিকে প্যালেস্টাইন জাত্যাভিমানের প্রতি সুবিচার করতে না পারায় এই আরাফাত ক্রমশ প্যালেস্টাইন জনতার থেকে দূরে সরে গেছেন। তাঁর PLO-র স্থলাভিষিক্ত হয়েছে উগ্র মৌলবাদী সংগঠন হামাস। গণতন্ত্রকামী, নিজের জমি জীবনের অধিকার রক্ষায় সরব প্যালেস্টানীয়দের এই মৌলবাদী শক্তির হাতে ছেড়ে দেওয়ার দায় কার? উত্তর জানা নেই।
1990 থেকে উপসাগরীয় যুদ্ধে গণতন্ত্র রক্ষার নামে আমেরিকা একটি একটি ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দৈত্য তৈরি করে দিয়ে গেছে। আফগানিস্তানে সেই দানবের নাম যদি হয় ওসামা বিন লাদেন, প্যালেস্টাইনে সেটি হামাস। আফগান সমাজতন্ত্রকে রুখতে তালিবান কতটা সফল হয়েছিল জানা নেই, কিন্তু 9/11-র মূল্য আমেরিকাকেই চোকাতে হয়েছিল। একইভাবে নিজের অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে আমেরিকা এই সেদিন পর্যন্তও ইজরায়েলকে যাবতীয় প্রশ্রয় জুগিয়ে এসেছে। সেই প্রশ্রয়ে বলীয়ান হয়ে কিনা জানা নেই, তবে অতীতেও রমজান মাসে প্যালেস্টানীয়দের ওপর বর্বরোচিত আক্রমণ নামিয়ে এনেছে ইজরায়েল। অথচ, একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় উঠে এসেছে ইজরায়েলের সিংহভাগ নাগরিক (প্রায় 53 শতাংশ) এই আস্ফালন, প্রাণঘাতী যুদ্ধের বিরুদ্ধে। প্রশ্ন ওঠে, তবে কাদের স্বার্থে এই নরমেধ যজ্ঞের আয়োজন?
আরও পড়ুন: ইজরায়েলেই উগ্র প্যালেস্টাইন বিরোধিতার বিরোধী স্বর
অত্যাধুনিক অস্ত্রভাণ্ডার, বিপুল অর্থে পুষ্ট ইজরায়েল এই প্রাণঘাতী লড়াইয়ে কিঞ্চিৎ এগিয়ে থাকলেও, হামাস গোষ্ঠীও প্রত্যাঘাতে পিছু হঠতে নারাজ। বিশ্ব রাজনীতির বিগ ব্রাদাররা এখনও নিশ্চুপ, হয়তো নিজেদের সুবিধামতো কৌশল সাজাতে ব্যস্ত। কাঁদছে সাধারণ মানুষ। ইতিহাস যে কতবার সাধারণের হন্তারক হবে, জানা নেই।
তোমার শিল্প নেই, সংস্কৃতিও ঘুচতে বসেছে, ভদ্রজন, তাই কি তোমার এই কৌলীন্য রাখার দায়?
একের পর এক সিদ্ধান্তে আছড়ে পড়ছে বিতর্কের ঝড়, তবু ‘বিদ্যুৎ’-এর চমকে নীরব সমর্থন জোগাচ্ছেন অনেকে।
বাংলার ভোটের ফল বিজেপি বিরোধী শিবিরে আশা জাগালেও বিরোধী ঐক্য এখনও দূর অস্ত।
বন্ধ হরতালময় শহরে এমন দিনগুলোয় সচরাচর ছেলেরা পথে ক্রিকেট খেলে, স্থানীয় চায়ের ঠেকে আড্ডা জমে।
কুচক্রীরা সারাক্ষণ গুজরাত মডেলকে গাল পাড়লেই বা, উন্নয়ন বলতে দেশবাসী তো গুজরাতকেই বোঝে!
দুর্বল, প্রায় অনিচ্ছুক নেতৃত্বের পক্ষে নানা রাজ্যের সম্ভাবনাময় তরুণ নেতাদের কংগ্রেসে ধরে রাখা কঠিন।