×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • ‘ভাই' ভাইরাল হলে, সংস্কৃতির ‘দাদা'রা ক্ষুণ্ণ হন

    বিতান ঘোষ | 07-12-2021

    নিজস্ব ছবি

    উপভাষা, উপকথা, উপহাস— ভদ্রোজনোচিত ঔচিত্যে কি তিনটেই একসূত্রে বাঁধা পড়ে যায় বার বার? সতীনাথ ভাদুড়ির ঢোঁড়াই-রা কিংবা মহাশ্বেতা দেবীর অর্জুন শবর-রা কি মূলস্রোতের সংস্কৃতি'র অতলেই ঢাকা পড়ে যায় বরাবর? ভদ্রজন নির্মিত সমাজ-সংস্কৃতিতে কালেভদ্রে এই প্রশ্নগুলি ওঠে না, এমন নয়। কিন্তু তার বিনির্মা হয় কই?

     

     

    বীরভূম নিবাসী জনৈক বাদাম বিক্রেতা ভুবন বাদ্যকর গান গেয়ে গেয়ে পণ্য বেচছেন। গানের কথা, সুর, এমনকি গলা, সবই তাঁর, এর মৌলিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনও অবকাশই নেই। মেঠো সুরে, আঞ্চলিক ভাষার টানে গাওয়া এই গানের প্রতিপাদ্য বিষয় ইমিটেশন গয়না, মোবাইলের অব্যবহৃত ঢাকনা ইত্যাদি অকিঞ্চিৎকর মনোহারী দ্রব্যের বিনিময়ে তিনি সমান মাপের কাঁচা বাদাম দেবেন। গানের শেষে আছে অকপট স্বীকারোক্তি— বিবিধ জিনিসের বিনিময়ে তিনি শুধু কাঁচা বাদামই দিতে পারবেন, অন্য কিছু দেওয়ার সামর্থ্য তাঁর নেই। আদরেই হোক বা অনাদরে, সমাজ মাধ্যমের আবেগবুদ্ধিহীন পরিমাপকগুলো বলছে, গানটি ইতিমধ্যেই বহু মানুষ শুনে ফেলেছেন, চলতি কথায় যাকে ভাইরাল' বলে আর কী।

     

    আরও পড়ুন:ধর্মের সঙ্গে সব কিছু গুলিয়ে যায়, জনসংখ্যাও

     

    এমন সুন্দর স্বআরোপিত বিপণন কৌশল চাপরাশিবৃত্তিতে অভ্যস্ত ভদ্রসমাজের পছন্দ হল না। বাঘা বাঘা বিজ্ঞাপনী সংস্থা মোটা টাকার বিনিময়ে সুললিত পদ্যে ও গদ্যে বিজ্ঞাপন বানাবে, তবেই না সংস্কৃতি রক্ষিত হবে? কিন্তু এক জন বাদাম বিক্রেতা কিনা আপন ডায়ালেক্টে ডায়ালেক্টিকাল মেটেরিয়ালিজম পড়া কিংবা পড়ার ভান করা ভদ্রজনেদের সংস্কৃতি'-কে এ ভাবে কাঁচকলা দেখাবেন, তা কি মেনে নেওয়া যায়? অগত্যা শুরু হল উপহাস বর্ষণ। যত ভাবে ওদের' আর ওদের' সংস্কৃতিকে টেনে নামানো যায় আর কী! প্রান্তজনের প্রান্তকথা শোনার ঔদার্য আমাদের কবেই বা হয়েছে! টুসু, ভাদুর কথা না জেনেই ভাবীকাল পড়েছে ও পড়বে দুর্গাপুজো বাঙালির শ্রেষ্ঠ পুজো। মশাই বাঙালি বলতে আপনি কাদের বোঝেন? কলকাতা ও তৎসংলগ্ন এলাকার কিছু ভদ্রবিত্ত মানুষদেরই কি?

     

    নৈরাশ্যের মেঘ সরলে তবুও তো অনন্ত জাগে। ভুললে চলবে না রাজারাজড়াদের যুদ্ধবিগ্রহে ভরা ইতিহাসে প্রান্তজনেদের কথা সার্থক ভাবে ইতিহাসচর্চায় তুলে আনার জন্য যাঁরা সবিশেষ প্রয়াসী হয়েছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই কৃতি বাঙালি ইতিহাসবিদ। সাবঅল্টার্নিজম-এর আঁতুড়ঘর তো এই কলকাতাই। তবুও ব্যবধান ঘুচল কই? মুলস্রোতের সাহিত্য-সমাজ-সংস্কৃতির অখণ্ড আধিপত্যে মাথা গলাতেই পারলেন না প্রান্তজনেরা। প্রান্তজনেদের নিয়ে কাজ করলেন যাঁরা, তাঁরাও প্রান্তবাসী হয়েই রইলেন। তাঁদের কিছু পুরস্কার বা খেতাব জুটলে এখনও কিঞ্চিৎ সমাদর হয় ঠিকই, তবে তাতে ঔদার্যের তুলনায় দাক্ষিণ্যের ভাবই বেশি।

     

    আরও পড়ুন:কৃষিতে স্বনির্ভর, তবু পেটে এত খিদে কেন ভারতের?

     

    সম্প্রতি বাংলার ওয়েব মাধ্যমে একটি বহুল জনপ্রিয় ধারাবাহিকে প্রায় সবকটি চরিত্রকে স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে দেখে আমরা ভারী উদ্বেলিত হয়েছিলাম। পরিচালকও তারিফ কুড়িয়েছিলেন এমন সাহসিকতা'র পরিচয় দেখানোয়। বিপুল টাকার ব্র্যান্ডিংয়ে সেই মনোরঞ্জক আয়োজনে আমরা এই সাহসিকতাকে সেলাম ঠুকলেও, ভুবন বাদ্যকর ও তাঁর সৃষ্টির কাছে এসে আমরা থমকে গেলাম। কৌলীন্য রক্ষার মরিয়া প্রয়াস দেখাতে গিয়ে আরও ছোট হয়ে গেলাম যেন নিজেরা। উপহাস করলাম আবার ওই ছোটলোকের গাঁইয়া অপসংস্কৃতি'র সঙ্গে আপন কারিকুরির মিশেলে গান বানিয়ে সমাজ মাধ্যমে তা বেচলাম। বিনিময়ে ন্যূনতম কৃতিত্বটুকুও দিলাম না বাদাম বিক্রেতা ভুবনকে। আসলে ওদের' আপন করে নেওয়ার মতো ঔদার্য আমাদের বা আমাদের তৈরি করে নেওয়া সংস্কৃতির নেই। যে সংস্কৃতি গ্রহিষ্ণু হতে পারে না, সেই সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব আশাবাদী হওয়া কি সম্ভব?


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    পাজি, কাঠিবাজ মিডল ক্লাসকে জব্দ করা মার্ক্সের কম্মো নয়, এই কাজটাও একমাত্র মোদীজিই পারেন!

    শতবর্ষ পরে রবীন্দ্রনাথের কবিতা নয়, আদিত্যনাথের হঠযোগ পড়বে ভারত!

    লাল ফিতের ফাঁসে রুদ্ধ আমলাতন্ত্রের মুক্তির নামে বাংলায় এখন চলছে আসলে ব্যক্তির একক শাসন।

    ক্ষমতা প্রয়োগ করে মহামারীর মোকাবিলার সঙ্গে আইনগত এবং নৈতিক দায়িত্বও পালন করাও উচিত কেন্দ্রের।

    বাংলায় বেহাল বিজেপির মোহ কাটতেই তৃণমূলে ফিরছেন নব্যরা, বিমুখ আদিরাও, মহাসংকটে রাজ্য বিজেপি

    নিউ নর্মাল সময়ে মহামারী অনেক কিছু বদলে দিয়ে গেলেও বাঙালির এই চিরায়ত অভ্যাসে বদল আনতে পারেনি।

    ‘ভাই' ভাইরাল হলে, সংস্কৃতির ‘দাদা'রা ক্ষুণ্ণ হন-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested