বাংলার নির্বাচনে বিজেপির প্রত্যাশা ও প্রচারের তুলনায় শোচনীয় পরাজয়ে বিজেপি বিরোধী দলগুলির মধ্যে সমন্বয় ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এই সমন্বয়ের অন্যতম সূত্রধর ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর। কিছুদিন আগেই এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাবে জানিয়েছিলেন, ‘কোনও তৃতীয় ফ্রন্ট বিজেপিকে রুখতে পারবে না’। অর্থাৎ কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে শুধু বিভিন্ন বিজেপি বিরোধী আঞ্চলিক শক্তি একজোট হয়েও বিজেপিকে হারাতে পারবে না। প্রশান্ত কিশোর ওরফে পিকে এই সাক্ষাৎকার দেওয়ার আগেই রাজধানীতে গুঞ্জন উঠেছিল, দুর্বল কংগ্রেসকে কার্যত অচ্ছুৎ রেখেই বিরোধী অক্ষ দানা বাঁধছে, এবং অক্ষের দুই প্রধান ভরকেন্দ্র হিসাবে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ‘মরাঠা স্ট্রংম্যান’ শরদ পাওয়ারের নাম শোনা যাচ্ছিল। পিকে নিজেও তিনদিন শরদ পাওয়ারের বাসভবনে গিয়ে বৈঠক করে আসেন। তারপর এই নিয়ে জল্পনা বৃদ্ধি পেলেও, পিকে স্পষ্ট করে দিয়েছেন কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে বিরোধী জোট তিনি চান না।
কিন্তু গত একমাসে বিরোধী শিবিরের বিবিধ নেতৃবর্গের পরস্পরবিরোধী অবস্থান সম্ভাব্য বিরোধী জোটের ভবিষ্যত নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে। বছর ঘুরলেই উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচন। স্থানীয় পঞ্চায়েত ভোটে বিজেপি সমাজবাদী পার্টি ও আম আদমি পার্টির কাছে পর্যুদস্ত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সেই রাজ্যে বহুজন সমাজ পার্টির সুপ্রিমো মায়াবতী উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে একলা লড়ার কথা ঘোষণা করলেন। গত লোকসভা নির্বাচনে দীর্ঘকালীন রাজনৈতিক বৈরিতা ভুলে মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি (BSP) এবং মুলায়ম সিং যাদবের সমাজবাদী পার্টি (SP) জোট বেঁধে লড়েছিল। এই জোট উত্তরপ্রদেশে বিজেপির জয়রথকে রুখতে না পারলেও, তাদের আসন পাঁচ বছর আগের 71 থেকে 62-তে নামাতে পেরেছিল। নির্বাচন মেটার অব্যবহিত পরেই এই জোট ভেঙে যায়। মায়াবতীকেও অন্য বিরোধী দলগুলির আন্দোলনে খুব বেশি পাওয়া যায়নি। এমনকি নয়া নাগরিকত্ব আইন (CAA) ও জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (NRC) নিয়ে যখন সারা দেশ উত্তাল, তখনও মায়াবতীকে নীরব থাকতে দেখা গেছে। উত্তরপ্রদেশের দলিত ও সংখ্যালঘু ভোটের একাংশ যদি একলা লড়া মায়াবতীর পক্ষে যায়, তবে তা প্রকারান্তরে শাসক বিজেপিরই সুবিধা করে দেবে।
বিজেপির রাজনীতি দিয়েই বিজেপিকে পরাভূত করার অনন্য নজির গড়েছিল মহারাষ্ট্র। মহারাষ্ট্রের বিজেপির পূর্বতন শরিক শিবসেনা শাসক জোট থেকে বেরিয়ে এসে কংগ্রেস এবং শরদ পাওয়ারের NCP-র সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার গঠন করে এবং বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। সম্পূর্ণ বিপরীত মতাদর্শে বিশ্বাসী এই তিন দলের জোট বেঁধে সরকার গঠন অনেককেই বিস্মিত করেছিল। শিবসেনা বিজেপি-সঙ্গ ত্যাগ করায় বিজেপি শিবিরও খানিক বলিষ্ঠ হয়েছিল। কিন্তু সেই শিবসেনার গলাতেও যেন এখন ‘অন্য’ সুর শোনা যাচ্ছে। তাদের দলীয় মুখপত্র ‘সামনা’তে সম্প্রতি সমবায় মন্ত্রক গঠন করার জন্য অমিত শাহের প্রশংসা করা হয়েছে। এমনকি শিবসেনার পরিচিত মুখ সঞ্জয় রাউতকেও ইদানীং আগের মতো চাঁচাছোলা ভাবে মোদী সরকারের সমালোচনা করতে দেখা যাচ্ছে না। রাউতের গলাতেও যেন মোদী সরকারের প্রতি প্রশংসার সুর। অন্যদিকে জল্পনার পারদ চড়াচ্ছেন প্রবীণ শরদ পাওয়ারও। বহু রাজনৈতিক বসন্ত দেখে ফেলা এই প্রাজ্ঞ রাজনীতিক সম্প্রতি নয়া তিন কৃষি আইনে কিছু রদবদল করার জন্য সরকারের কাছে আর্জি জানিয়েছেন। অথচ শরদের দল সাম্প্রতিক অতীতে প্রতিবাদী কৃষকদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে তিন কৃষি আইন সম্পূর্ণ বাতিল করার দাবি জানিয়েছিল। শুধু তাই নয়, গত 17 জুলাই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শরদ পাওয়ারের দীর্ঘ একান্ত বৈঠকও রাজধানীর অলিন্দে নয়া জল্পনার সৃষ্টি করেছে। মহারাষ্ট্রের কংগ্রেস নেতা নানা পাটোলে সম্প্রতি দাবি করেছেন, মহারাষ্ট্রের পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনে, কংগ্রেস এককভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। বৃহত্তর রাজনৈতিক ক্যানভাসে এই খণ্ডচিত্রকে যদি যুক্ত করা যায়, তবে বলতেই হয় তথাকথিত বিরোধী ঐক্যে এখনও একতাবিধান করা সম্ভব হয়নি। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলই এখন নিজেদের মতো করে লিটমাস টেস্টে ব্যস্ত।
আরও পড়ুন: জাতের অঙ্কে মন্ত্রিত্ব বণ্টনে বাংলায় ফল মিলবে কি?
গত দু'টো লোকসভা নির্বাচনে দেখা গেছে উত্তর ভারতের গো-বলয় বিজেপিকে বিপুল সংখ্যক সাংসদ দিয়েছে। তাই বিজেপির মোকাবিলায় বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণেও বিরোধীদের মনোযোগ দেওয়া জরুরি। তামিলনাড়ুতে করুণানিধি-পুত্র স্ট্যালিনের DMK, কেরালায় বামেরা এবং কর্ণাটকে কংগ্রেস শক্তিশালী দল। কিন্তু দক্ষিণ ভারতেরই গুরুত্বপূর্ণ দুই রাজ্য তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশে যে দু'টি দল ক্ষমতায়, সেই তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি (TRS) এবং ওয়াইএসআর কংগ্রেস প্রকাশ্যে বিজেপি শিবিরের সদস্য না হলেও, তাদের বিরোধী শিবিরে সন্নিবেশিত করা যায়নি। যেমন করা যায়নি ওড়িশার শাসক দল বিজু জনতা দল (BJD)-কেও। বহু ইস্যুতে এই রাজনৈতিক দলগুলি শাসক বিজেপির বিরুদ্ধে নীরব থেকেছে, সংসদে গুরুত্বপূর্ণ বিল নিয়ে আলোচনা বা ভোটাভুটিতে অনুপস্থিত থেকেছে, এ কথা সত্য। কিন্তু সম্প্রতি কোভিড টিকার রাজ্যওয়াড়ি বন্টন এবং পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে এই দলগুলিকে সরব হতে দেখা যাচ্ছে। অথচ তাদের সেই ক্ষোভকে এখনও বাকি বিরোধীরা সঠিক ভাবে কাজে লাগাতে পারেননি। প্রশ্ন রয়েছে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি-কে (AAP) নিয়েও। স্বঘোষিত বিজেপি বিরোধী এই দলটির কংগ্রেস-বিমুখতা বৃহত্তর জোটে এদের সামিল করতে পারেনি। অথচ দিল্লির 7টি লোকসভা আসন ছাড়াও পাঞ্জাব ও দিল্লি লাগোয়া উত্তরপ্রদেশে এদের ভাল ফল করার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
স্বস্তিতে নেই কংগ্রেসও। যে তিন রাজ্যে তারা এককভাবে ক্ষমতায়, সেখানে অন্তর্দ্বন্দ্বের নানা চোরাস্রোত। পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং-এর সঙ্গে নভজ্যোত সিং সিধুর কোন্দল সামলাতে নাজেহাল কংগ্রেস হাইকম্যান্ড। রাজস্থানেও অশোক গহৌলত, সচিন পাইলট শিবিরের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা যায়নি এখনও। ছত্তিশগড়ের আদিবাসী বিক্ষোভ সামাল দিতে সেখানেও মুখ্যমন্ত্রী বদলের মতো কোনও চরম সিদ্ধান্ত নিতে পারে কংগ্রেস, খবর তেমনই। কংগ্রেসে দীর্ঘদিন ধরে কোনও কার্যকরী সভাপতি নেই। রাহুলের সঙ্গে প্রবীণ নেতাদের নানা বিষয়ে মতপার্থক্য প্রকাশ্যে আসছে। আবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো আঞ্চলিক নেতারা বর্তমান পরিস্থিতিতে কংগ্রেসের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে পারলেও, রাহুলের নেতৃত্বে কাজ করতে তাঁদের অস্বস্তির কথা গোপন করেননি। সনিয়া গান্ধীর মতো সর্বজনমান্য কোনও নেতা বিরোধী জোটকে নেতৃত্ব দিলে তখন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও হতে পারে। মোদীর লার্জার দ্যান লাইফ ভাবমূর্তির বিপ্রতীপে যোগ্য, অভিজ্ঞ নেতৃত্বের অভাব বিরোধী শিবিরকে এমনিতেই কিছুটা পিছিয়ে রেখেছে।
এই পরিস্থিতিতে সংসদের আসন্ন বাদল অধিবেশনে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় মোদী সরকারের ব্যর্থতা, ভ্যাকসিনের অভাব, রাফালে কেলেঙ্কারি সহ বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারকে চেপে ধরতে চায় বিরোধীরা। এই ব্যাপারে সংসদে কক্ষ সমন্বয় করে এগোতে চায় বিরোধী শিবির। গত মে মাসে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের পর বিরোধী জোট নিয়ে যে উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছিল, এখন তা অনেকটাই মিলিয়ে এসেছে। ভোট কুশলী প্রশান্ত কিশোর অবশ্য এখনও সবাইকে মেলানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি তিনি রাহুল গান্ধীর সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকও করেছেন। তথাকথিত এই বিরোধী জোট আগামীদিনে ইনক্লুসিভ পলিটিক্সের মাধ্যমে মোদী সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে সমর্থ হয়, নাকি বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া হিসাবেই রয়ে যায়, সেটাই এখন দেখার।
‘বাবু’দের দেখানো পথেই রাষ্ট্রদ্রোহীদের খুঁজছে কেন্দ্রীয় সশস্ত্র বাহিনী।
পুরুষ সদস্যের মুখাপেক্ষী না থেকে, আর্থসামাজিক স্বাবলম্বনকে বুঝি 'ভিক্ষাবৃত্তি' বলে?
ছিন্নমূলের দেশ নেই, সমাজ নেই, আছে জেদ আর কল্যাণকামী রাষ্ট্রের তাচ্ছিল্য ও করুণা।
বহু সঙ্কটেও মানুষকে বেঁচে থাকার শিক্ষা দিয়ে গেল 2020।
কাজের সন্ধানে শহরে চলে আসা অপুরা গত সাত-আট মাসে গ্রামে ফিরতে পারেনি। লোকাল ট্রেনে আমার সঙ্গী হল তারা
শিল্পীর শিল্প কালোত্তীর্ণ হয় মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় সরকারের দেওয়া রাষ্ট্রীয় খেতাবে নয়।