ছাতিমতলার ছায়ায় বসে তৃপ্ত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘তিনি আমার প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি’। শান্তিনিকেতনের সেই ছাতিমতলায় যে এত অশান্তি, তা কে আর জানত। অশান্তির কুশীলব কারা তা নিয়ে অবশ্য পরস্পরবিরোধী মত রয়েছে। বিরোধের এক প্রান্তে রয়েছেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী, অপর প্রান্তে তিনজন পড়ুয়া। এমনিতে পড়ুয়া এবং শিক্ষকদের একাংশের সঙ্গে উপাচার্যের বিরোধের অন্ত নেই। ছাত্র শিক্ষকরা গলা মিলিয়ে আর ‘আমাদের শান্তিনিকেতন, সব হতে আপন’ গান না, একে অপরের দিকে তর্জনী তুলে অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগ করতে থাকেন।
ঘটনার সূত্রপাত চলতি বছরের গোড়ায়, জানুয়ারি মাসের 9 তারিখে। সেদিন উপাচার্য তাঁর ঘনিষ্ঠ কিছু শিক্ষককে নিয়ে ছাতিমতলায় মৌন প্রতিবাদ কর্মসূচি নিয়েছিলেন। কিছু বছর আগে বিশ্বভারতী ক্যাম্পাসের ভিতর দিয়ে যাওয়া শ্রীনিকেতনমুখী একটা রাস্তা বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষকে ব্যবহার করতে দিয়েছিল রাজ্য সরকার। সম্প্রতি বহু বিষয়ে উপাচার্যের সঙ্গে রাজ্য সরকার এবং শাসকদল তৃণমূলের মতান্তর হওয়ায় রাজ্য প্রশাসন সেই রাস্তাটি বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের হাত থেকে নিয়ে পুনরায় পূর্ত দফতরের হাতে তুলে দেয়। এই বিষয়ে তৃণমূল অভিযোগ করেছিল যে, গোটা রাস্তাটিকে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের (বিজেপি) পতাকা দিয়ে মুড়ে ফেলা হচ্ছে। সেই রাস্তা ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতেই উপাচার্য সেদিন ছাতিমতলায় অবস্থানে বসেছিলেন। একই দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অচলাবস্থা ও উপাচার্যের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে একদল পড়ুয়া বিক্ষোভ দেখায়। ‘অভিযুক্ত’ পড়ুয়াদের সন্ধানে উপাচার্য একটি তদন্ত কমিটি তৈরি করেন। তার আগেই অবশ্য পর্যায়ক্রমে টানা 9 মাস সাসপেন্ড করে রাখা হয়েছিল তিন পড়ুয়া সোমনাথ সাউ, ফাল্গুনি পান এবং রূপা চক্রবর্তীকে।
তদন্ত কমিটির রিপোর্ট বলছে, 11 জন প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান অনুযায়ী, উপরিউক্ত তিন পড়ুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও রাজনীতি বিভাগে ভাঙচুর চালিয়েছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গরিমাকে ক্ষুণ্ণ করেছে। তাই সাসপেনসনের মেয়াদ ফুরানোর আগেই ওই পড়ুয়াদের পত্রপাঠ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত করা হল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী, আশ্রমিকরা অবশ্য কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তে মোটেও হতবাক হননি, অভিযুক্তরা তো নয়ই। উপাচার্যের বিরাগভাজন হলে পড়ুয়া, মায় শিক্ষকদের সাসপেন্ড করে দেওয়া এখন সেখানে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে সরব হওয়ায় সাসপেনসনের খাঁড়া নেমে এসেছিল অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সুদীপ্ত ভট্টাচার্যের ওপর। এবারেও ওই তিন পড়ুয়াকে বিতাড়িত করার পাশাপাশি আরও দুই অধ্যাপক অরণি চক্রবর্তী এবং পীযূষকান্তি ঘোষকে সাসপেন্ড করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিশ্বভারতীর কোপে পড়া ছাত্র শিক্ষক সহ বহু মানুষের অভিযোগ এসব কিছুই হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর নির্দেশে।
‘বিদ্যুত’-এর চমকের অবশ্য শেষ নেই। এর আগেও তিনি তাঁর বিচিত্র কাজের মধ্য দিয়ে সকলকে হতবাক করে দিয়েছেন। 2020 সালে সাধারণতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে নয়া নাগরিকত্ব আইনের সপক্ষে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি জানান, এই দেশের সংবিধানে নাকি সংখ্যালঘু মানুষদের মতামত প্রাধান্য পেয়েছে। তাই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এবং সরকার চাইলে সংবিধান এমনকি সংবিধানের প্রস্তাবনাটাও আমূল বদলে দিতে পারে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য এই যে, তিনি একজন স্বনামধন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। বিশ্বভারতীতে আসার আগে বহু বছর দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। তাই দেশের সংবিধান এবং তা সংশোধনের নিয়মকানুন সম্পর্কে তিনি একেবারে নাদান, এমনটা মনে করার কারণ নেই। ঘটনার এখানেই শেষ নয়। ইতিহাস বিভাগের স্নাতক স্তরের এক পড়ুয়া উপাচার্যের এই বক্তব্যের ভিডিও ফোনে রেকর্ড করে তা সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয়। এতেই ক্ষিপ্ত হন উপাচার্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর মাত্র একদিনের নোটিশে সেই পড়ুয়াকে হোস্টেল ছাড়ার নিদান দেন।
উপাচার্যের বিরুদ্ধে বিক্ষোভরত পড়ুয়ারা।
তাছাড়াও কখনও প্রতিবাদী ছাত্রদের ‘মাওবাদী’ বলে সম্বোধন করা, রাজনৈতিক কারণের দোহাই দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে বরেণ্য অর্থনীতিবিদের প্রবেশ আটকে বিজেপির নেতামন্ত্রীদের বিভিন্ন রাজনৈতিক সেমিনারে অনুমতি দেওয়া— তাঁর মুকুটে ‘কীর্তি’র পালক নেহাত কম নয়। শান্তিনিকেতনের মানুষজনও এসবে বিদ্যুৎ-স্পৃষ্ট! কিন্ত এমন ঐতিহ্যবাহী একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্রমঅবনতির জন্য কি শুধু উপাচার্যই দায়ী? সাসপেন্ডেড শিক্ষক অরণি চক্রবর্তীর কথায়, ‘বিশ্বভারতীতে ওপর ওপর একটা গণতন্ত্র আছে ঠিকই, কিন্তু বাস্তবে গণতান্ত্রিক পথে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় না। উপাচার্যের বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে অনেক শিক্ষক অন্যায় দেখেও মুখ বন্ধ করে রাখেন। তাই আমাদের শিক্ষকদের একাংশও এর দায় এড়াতে পারেন না।' আর এক সাসপেন্ডেড শিক্ষক, সুদীপ্ত ভট্টাচার্য বলছিলেন, ‘যারা অন্যায় বা দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হন, তাঁদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়, কিন্তু অভিযুক্তরা বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়ায়।'
কিন্তু বিশ্বভারতী কি এক তাসের দেশ, যেখানে উপাচার্যের ইচ্ছাতেই সবকিছু পরিচালিত হবে? এই জায়গায় বিশ্বভারতীর প্রশাসনিক কাঠামোয় একটা বড় গলদ দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। সুদীপ্তবাবুর কথায়, ‘অন্যান্য কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের নেতৃত্বে একটি কমিটি থাকে, যে কমিটির সদস্যরা পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে কোনও বড় সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু বিশ্বভারতীতে যাবতীয় সিদ্ধান্ত এককভাবে নেন উপাচার্য। তাই স্বেচ্ছাচারিতার একটা জায়গা তৈরি হয়ে যায়।' সব মিলিয়ে ক্ষমতাসীন ব্যক্তির স্বেচ্ছাচার আর সমষ্টির নীরবতা গত তিন দশক ধরে বিশ্বভারতীকে অন্যান্য কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তুলনায় ক্রমশ পিছিয়ে দিয়েছে। সেক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন ব্যক্তির শুভবোধই একমাত্র প্রতিষ্ঠানের উন্নতির পক্ষে সহায়ক হতে পারে।
যাঁকে নিয়ে এত ক্ষোভ-বিক্ষোভ সেই উপাচার্য, মাননীয় বিদ্যুৎ চক্রবর্তী কিন্তু তাঁর কর্মে অবিচল। ভাবখানা এমন যেন তিনি কিছু নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়েই বিশ্বভারতীতে এসেছেন। সেই লক্ষ্য পূরণে যে বাধাই আসুক, তাতে তাঁর কুছ পরোয়া নেহি। সংবাদমাধ্যমেরও ধরাছোঁয়ার বাইরে তিনি। তিন ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা নিয়ে তাঁর মতামত জানতে চাওয়া হলেও, তিনি বা কর্তৃপক্ষ কারও তরফে কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি। ইদানীং শোনা যাচ্ছে তিনি সময়ে অসময়ে, এমনকি রাত-বিরেতেও ছাতিমতলায় গিয়ে ধ্যানে বসে পড়ছেন। তাঁর এক পূর্বসূরি একবার একটি বিতর্কের মধ্যে পড়ে গিয়ে রামকিঙ্কর বেইজের তৈরি গান্ধীমূর্তির সামনে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করেছিলেন। বিদ্যুৎবাবুও কি সব সমালোচনা, বিক্ষোভ থেকে পরিত্রাণ পেতে রবীন্দ্র-শরণে গেলেন? কিন্তু তাঁকে কেন্দ্র করে বিতর্ক বিক্ষোভ যেভাবে দানা বাঁধছে তাতে কতটা তিনি ‘পরিত্রাণ’ পাবেন, তাই নিয়ে সন্দেহ থাকছে।
এতগুলো অবোধ প্রাণকে সহায় সম্বলহীন করে ঘরের মেয়ে কি শ্বশুরঘরে ফিরতে পারে?
মানবাধিকার নয়, নাগরিকত্ব প্রদানও নয়, শাসকদলের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নটাই মূলকথা।
নাবালিকা 'ধর্ষণ' নিয়ে মমতার এমন অসংবেদনশীল মন্তব্য ও ভাবনার শরিক বহু সাধারণ মানুষ, সে আমরা প্রকাশ্যে
শ্যামাপ্রসাদ ‘সাম্প্রদায়িকতা' নামক রোগে আক্রান্ত হলে, সেই রোগের উৎস খুঁজে সেটা নির্মূল করতে হবে।
এই কঠিন সময়ে বিরোধীরাও দেশকে সঠিক দিশা দেখাতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে সঙ্কটে পড়বে ভারতই!
ভাওয়াল সন্ন্যাসীর ঢঙে সনিয়া বলবেন আমায় তোমরা যেতে দাও, আর বাকিরা পথ আগলাবে— এই হল কংগ্রেসের হাল!