অবিকল জলসাঘরের বিশ্বম্ভর রায়। ঠাটবাট ঘুচতে বসেছে, তবু জমিদারি মনোভাবে বদল আসেনি। শতাব্দী প্রাচীন দল কংগ্রেসের (Indian National Congress) কথা হচ্ছে। বিগত প্রায় এক দশক ধরে দলের রাজনৈতিক সাফল্যের গ্রাফ ক্রমনিম্নগামী। রাজ্যে রাজ্যে দলীয় কোন্দল মাথাচাড়া দিচ্ছে। কিন্তু দলের তথাকথিত হাইকম্যান্ডের (Congress Highcommand) তরফে কোনও তাপউত্তাপ দেখা যাচ্ছে না। অবশ্য এই হাইকম্যান্ডটি কে বা কারা, এবং দলে কে কাকে কম্যান্ড করবে তা নিতান্ত অস্পষ্ট। বহুদিন দলে কোনও কার্যকরী সভাপতি নেই, এআইসিসি-র (AICC) বৈঠকও হয়নি দীর্ঘসময়। তাই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলের নেতাকর্মীরা যখন বলছেন, ‘ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ’, তখন 24, আকবর রোডের কেউই দলের দায়িত্ব নিতে রাজি নন।
স্বাধীনতার পর থেকেই দেশের বিভিন্ন রাজ্যে আঞ্চলিক উচ্চাকাঙ্ক্ষায় লাগাম পরাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে কংগ্রেসকে। প্রথমে নেহরু এবং পরে ইন্দিরা এই উচ্চাকাঙ্খাকে মূলস্রোতে মেশাতে সমর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু ইন্দিরার সময় থেকেই দলের সংগঠনকে যেভাবে কেন্দ্রাভিমুখী একটা চরিত্র দেওয়া হয়েছিল, তাতে দলের অভ্যন্তরে আঞ্চলিক স্বার্থগোষ্ঠীগুলিকে কিছুদিনের জন্য নিরস্ত করা গেলেও, দীর্ঘমেয়াদে দলে বিচ্ছিন্নতাবোধ আরও বেশি করে মাথাচাড়া দেয়। আট এবং নয়ের দশকে একে একে দল ছাড়েন জিকে মুপানর, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শরদ পওয়ার, পিএ সাংমার মতো নেতারা। সীতারাম কেশরীর মতো দুর্বলচিত্ত ‘পুতুল’ সভাপতি কংগ্রেসের এই ক্ষয়রোগে রাশ টানতে পারেননি।
দক্ষিণ ভারতে কে কামরাজের যে বিরোধিতার সম্মুখীন ইন্দিরা হয়েছিলেন, তাতে হয়তো দক্ষিণ ভারত সম্পর্কে তিনি একটু অধিক সাবধানী হয়ে উঠেছিলেন। এর আগেও রাজাগোপালাচারীর মতো দক্ষিণের নেতারা নেহরুর শিরঃপীড়া বাড়িয়েছিলেন। ইন্দিরার আমলে এক কেবল অন্ধপ্রদেশের রাজশেখর রেড্ডি নিজের রাজ্যে যথেষ্ট ক্ষমতা ভোগ করতেন। অথচ রাজশেখর রেড্ডির মৃত্যুর পর সেই রাজ্যে যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হল, তা পূরণ করতে ব্যর্থ হল কংগ্রেস। সেই স্থানে উঠে এলেন রাজশেখর রেড্ডির পুত্র জগনমোহন রেড্ডি এবং তাঁর নতুন দল ওয়াইএসআর কংগ্রেস— যে দল এখন অন্ধ্রপ্রদেশের শাসনক্ষমতায় রয়েছে।
দলের অন্দরে কোন নেতার সঙ্গে কোন নেতার কী সমীকরণ এবং কোন উপায়ে যুযুধান দুই নেতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা যায়, তা নিয়ে কংগ্রেসের অনভিজ্ঞতা বারবার প্রকট হচ্ছে। অসমেই যেমন তৎকালীন কংগ্রেস নেতা হিমন্ত বিশ্বশর্মার আপত্তি ছিল প্রবীণ কংগ্রেস নেতা, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈয়ের পুত্র গৌরব গগৈকে নিয়ে। খুব সম্ভবত উচ্চাকাঙ্খী হিমন্ত তাঁর রাজনৈতিক যাত্রাপথে কোনও তরুণ প্রতিদ্বন্দ্বীকে চাননি। অথচ হিমন্তের মতো প্রভাবশালী নেতার উচ্চাকাঙ্খাকে বাইপাস করে একটা আপসরফার পথে হাঁটার কোনও চেষ্টাই করেননি কংগ্রেস শীর্ষনেতৃত্ব। আজ সেই হিমন্তই অসমের মুখ্যমন্ত্রী এবং উত্তর-পূর্ব ভারতে বিজেপির অন্যতম পোস্টার বয়।
একই কথা প্রযোজ্য রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশের ক্ষেত্রেও। সেখানেও প্রবীণ নেতাদের অভিজ্ঞতা ও নবীনদের উচ্চাকাঙ্খার মধ্যে ভারসাম্য রাখতে ব্যর্থ হয়েছে কংগ্রেস। ফলস্বরূপ মধ্যপ্রদেশে কমলনাথের মতো দুঁদে নেতাকে সামনে রেখেও গড় রক্ষা করা যায়নি, আর রাজস্থানে গহৌলত-পাইলট স্নায়ুযুদ্ধের মাঝে পড়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে দল ও সরকার। পর্যবেক্ষক বা বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসাবে যাঁদের এইসব মীমাংসা করার ভার দিয়ে অন্য রাজ্য থেকে পাঠানো হচ্ছে, তাঁরাও সংশ্লিষ্ট রাজ্যে দলের হাঁড়ির খবর বিশেষ রাখেন না বলেই মনে হয়েছে। তাই মীমাংসা দূরস্থান, বিক্ষুব্ধ নেতাদের দাবি তাঁরা আরও সমস্যা বাড়াচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত পর্যবেক্ষক জিতিন প্রসাদ তো দলের পর্যবেক্ষণ করতে এসে নিজেই বিজেপি শিবিরে ভিড়ে গিয়েছেন। কংগ্রেসে কে যে কার ওপর পর্যবেক্ষণ করবে, তাই বোঝা মুশকিল!
পাঞ্জাবে এতকাল কংগ্রেসের মুখ ছিলেন পাতিয়ালা রাজবংশের ‘ক্যাপ্টেন’ অমরিন্দর সিং। হঠাৎই প্রাক্তন ক্রিকেটার নভজ্যোত সিং সিধুকে প্রদেশ সভাপতি পদে বসিয়ে পাঞ্জাব প্রদেশ কংগ্রেসে চোরাগোপ্তা লড়াইয়ের পথ খুলে দেয় কংগ্রেস হাইকম্যান্ড। সিধু বনাম ক্যাপ্টেন অভ্যন্তরীণ লড়াইতে হাইকম্যান্ড সিধুর পাশে দাঁড়ায়, মুখ্যমন্ত্রীত্বে ইস্তফা টানতে হয় ক্যাপ্টেনকে। পাঞ্জাবের নয়া মুখ্যমন্ত্রী, সিধু ঘনিষ্ঠ দলিত মুখ চরণজিৎ সিং চন্নি। এদিকে চন্নির সরকার পরিচালনায় ক্ষুব্ধ সিধু প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে বসে আছেন। এই আকালের বাজারে সবেধন নীলমনি এই সম্ভাবনাময় রাজ্য পাঞ্জাবেও কংগ্রেস দিশাহীনভাবে এগিয়ে চলেছে।
আরও পড়ুন: অহোম জাতীয়তাবাদের সঞ্জীবনী ‘অনুপ্রবেশ’!
দলের অন্দরে যে 23 জন প্রবীণ নেতা ক্রমাগত হাইকম্যান্ডের (পড়ুন রাহুল ও প্রিয়ঙ্কা) দল পরিচালনা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তাঁরা প্রকাশ্যেই বলছেন, হয় রাহুল গান্ধী সভাপতি হয়ে দলের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিন, নয়তো অদৃশ্য হয়ে, পিছন থেকে সবটা নিয়ন্ত্রণ করা বন্ধ করুন। এদিকে রাহুল আবার দলের অন্দরে নিজের পছন্দের লোকেদের নিয়ে একটি গোষ্ঠী তৈরি করতে চান, যার পোশাকি নাম ‘টিম রাহুল’। কিন্তু এই টিমের অধিকাংশ সদস্যই যেভাবে গত তিন বছরে পদ্ম শিবিরে গিয়ে ভিড়েছেন, তাতে এই টিমের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন কংগ্রেসের পোড়খাওয়া প্রবীণরা। রাহুলের টিমের নতুন সদস্য হিসাবে সম্প্রতি দলে যোগ দিয়েছেন কানহাইয়া কুমার ও জিগ্নেশ মেবানি। কিন্তু দল ও সংগঠনে তাঁদের কীভাবে কাজে লাগাবেন রাহুল?
কানহাইয়া নিজে যেমন ভূমিহার সম্প্রদায়ের মানুষ। বিহারের বর্তমান রাজনীতিতে ভূমিহার ভোট ভীষণ ফ্যাক্টর, কার্যত যেটি এখন বিজেপির দখলে। রাহুল কি কানহাইয়াকে দিয়ে বিজেপির এই ভূমিহার ভোটব্যাঙ্কের সিঁদ কাটতে পারবেন? পাঞ্জাবের নয়া মুখ্যমন্ত্রী চন্নি শুধু সিধু ঘনিষ্ঠ নেতাই নন, রাজ্যের প্রভাবশালী দলিত মুখও বটে। পাঞ্জাবে গুঞ্জন, ইদানীং মোদী বিরোধিতায় সরব অকালি দল ও মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি সেই রাজ্যে জোট করে লড়ে দলিত ভোটের বড় অংশে ভাগ বসাতে উদ্যত হয়েছে। কংগ্রেস কি চন্নিকে মুখ করে তা রুখতে পারবে? কমন্ডলুর রাজনীতিতে পিছিয়ে পড়ে ফের আত্মপরিচয়ের রাজনীতিকে প্রাধান্য দেবে? উত্তর দেবে সময়।
তবে সাম্প্রতিক অতীতে কংগ্রেসের এই জাতীয় যাবতীয় পরীক্ষানিরীক্ষা কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। উত্তরপ্রদেশের ব্রাহ্মণ ও উচ্চবর্ণের ভোটকে চাঁদমারি করা কংগ্রেস দীর্ঘসময় ধরে প্রিয়ঙ্কা গান্ধীকে পূর্ব উত্তরপ্রদেশের দায়িত্ব দিয়ে রেখে দিয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ভোটের বাক্সে তেমন কোনও সুফল পায়নি তারা। উল্টে বিগত দুই দশকে বিভিন্ন রাজ্যে শক্তিশালী আঞ্চলিক দলগুলির কাছে রাজনৈতিক জমি হারাতে হয়েছে কংগ্রেসকে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল, তামিলনাড়ুতে ডিএমকে এবং এডিএমকে, তেলেঙ্গানায় টিআরএস— এমন উদাহরণ ভূরিভূরি। এর কারণ হিসাবে উত্তর ভারতে মণ্ডল রাজনীতির উত্থানকে দায়ী করা যেতে পারে। তবে তাতে কংগ্রেস উচ্চনেতৃত্বের অপদার্থতা বিন্দুমাত্র লঘু হয় না। আগে তবু কংগ্রেসের কিছু ‘ক্রাইসিস ম্যানেজার’ ছিলেন— যারা রাজ্যে রাজ্যে বিভিন্ন বিবাদ বিসংবাদ মোকাবিলায় দক্ষতার পরিচয় রাখতেন। এখন গোটা দলটাই যখন ক্রাইসিসে, তখন দলের মুখ্য ম্যানেজারটি কে, তাই জানেন না দলের নেতাকর্মীরা!
আমাদের 70 লক্ষ হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ আছে। তাই, আমরা যে কোনও মিথ্যা খবরকে সত্য করতে পারি
বামেদের শহীদ বেদীর সংখ্যা কমা আর তৃণমূলের ক্রমবর্দ্ধমান 'শহীদ স্মরণ’ সমানুপাতিক!
শীতের ফুটিফাটা শরীরেও প্রেম আসে, আসে দ্রোহও, শাসক তাই বসন্তকে ভয় পায়।
নাবালিকা 'ধর্ষণ' নিয়ে মমতার এমন অসংবেদনশীল মন্তব্য ও ভাবনার শরিক বহু সাধারণ মানুষ, সে আমরা প্রকাশ্যে
খাদ্য, বস্ত্র যখন পয়সা দিয়েই কিনতে হয়, সংবাদ নয় কেন?
নিজেদের দুর্বলতা কাটানোর দাওয়াই খুঁজে না পেলে অন্যরা দল ভাঙাবেই।