সরকারের মতিগতি দেখে মনে হচ্ছে রাষ্ট্রের ভূমিকা আরও বেশি আধিপত্যবাদী হবে
লকডাউন 5 বা লকওপেনের গোড়ায় প্রধানমন্ত্রী তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদকালে, গত এক বছরের খতিয়ান দিতে গিয়ে কোনও অর্থনৈতিক সাফল্য বা নতুন কোনও যুগান্তকারী পদক্ষেপের কথা শোনাতে পারেননি। বরং তাঁর বক্তব্যে উঠে আসা 370 ধারা, তিন তালাক, রামমন্দির ও নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (সিএএ)— বাস্তবে বিজেপির নির্বাচনী ইস্তেহার এবং রাজনৈতিক কর্মসূচির অঙ্গ, কিন্তু দেশের আমজনতার আর্থিক কল্যাণের সঙ্গে সম্পর্কহীন।
তবে গত 17 মে “আত্মনির্ভর ভারত” বা রিলিফ প্যাকেজ (2)-এর শেষদিনের উপস্থাপনায় নির্মলা সীতারমন শিল্প এবং কৃষি নীতিতে যে ‘রিফর্ম’ বা পরিবর্তনের কথা বলেছেন, তা তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতোই বটে। অন্তত প্রথম দর্শনে!
দেশের অর্থনীতি ক্রমশ বাজারের হাতে?
শিল্পক্ষেত্রে আগে যেগুলো কেবল সরকারি বিনিয়োগের জন্য নির্ধারিত ছিল, তার প্রায় সবই এখন বেসরকারি— দেশি এবং বিদেশি—- বিনিয়োগের জন্য হাট করে খুলে দেওয়া হল। যেমন সবরকম অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এবং প্রতিরক্ষা সামগ্রী, যুদ্ধবিমান এবং যুদ্ধজাহাজ, রেল পরিবহন, পারমাণবিক শক্তি, খনিজ তেল, কয়লা, লোহা, তামা, ম্যাঙ্গানিজ, সোনা, হীরা ইত্যাদি খনি থেকে তোলা বস্তু। এয়ার ইন্ডিয়াকে বেচতে পারলে নাগরিক ‘উড়ান’ পুরোটাই বেসরকারি হতে হবে। বিমাতে বেসরকারি সংস্থাগুলি ক্রমশ জাঁকিয়ে বসছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর গঙ্গাযাত্রা কেবল সময়ের অপেক্ষা। এখন বলা হচ্ছে, সরকারের কাজ দেশ চালানো, ব্যবসা করা নয়।
আরও পড়ুন
লকডাউন অর্থনীতি 1: কার রিলিফ বিশ লক্ষ কোটি টাকায়?
কৃষিক্ষেত্রে ফসল সরকারি বিক্রয়কেন্দ্রে বেচার কোনও বাধ্যবাধকতা রইল না। যে কোনও রাজ্যের কৃষক তার ফসল, দেশের যে কোনও জায়গায় খোলা বাজারে বেচতে পারেন। এছাড়া জোর পড়বে চুক্তি চাষ বা নীলচাষের মতো আগে বেসরকারি কোম্পানির থেকে দাদন নিয়ে নিজের জমিতে কোম্পানির মর্জি মতো ফসল ফলানোর উপর। কিন্তু ‘ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স ফর সাস্টেনেবল এগ্রিকালচার’-এর সহ-আহ্বায়ক, কিরণ বিসসা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে, নিত্যপ্রয়োজনীয় আইনে সাধারণ কৃষকের বদলে ধনী কৃষক এবং কৃষি পণ্যের বড় কোম্পানিগুলোকে খুশি করা হয়েছে। ছোট এবং প্রান্তিক কৃষকের ফসল গুদামজাত করার মতো ক্ষমতাই নেই, ওদের পেটের দায়ে চটপট ফসল কম দামে বেচে দিতে হয়। ওরা কীকরে এই আইনের সুবিধে পাবে? [1] আর গতবছর থেকে কৃষকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে যে বছরে 6,000 টাকা করে দেওয়া হচ্ছে তাতে বাদ পড়ছেন ভূমিহীন ও খেতমজুররা, কারণ এই যোজনায় কৃষক বলতে বোঝানো হয়েছে শুধু জমির মালিকদের।
এদিকে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ছ’সদস্যের মানিটারি পলিসি কমিটির (এমপিসি) গত 20-22 মে-র বৈঠকে দেশের অর্থনীতিতে করোনা সম্পর্কিত লকডাউনের প্রভাব নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। গভর্নর শক্তিকান্ত দাস জানান যে বৃহৎ অর্থনীতির তিনটে প্রধান মানদণ্ড, বাজারে চাহিদা, ব্যক্তিগত উপভোগ এবং শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের আর্থিক বিনিয়োগ মার খেয়েছে। ব্যাঙ্কগুলোর ঋণবৃদ্ধি বলার মতো নয়। তবে কৃষির সাফল্যে ভর করে অর্থনীতি আগামী বছরে ঘুরে দাঁড়াবে, এটাই আশা। (অথচ জিডিপিতে কৃষির অবদান মাত্র 17 শতাংশ! তবে জনসংখ্যার প্রায় 48 শতাংশ লোক কৃষিনির্ভর) আবার ডেপুটি গভর্নর মাইকেল দেবব্রত পাত্র মনে করেন, আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি এত গভীর যে সারতে কত বছর লাগবে বলা কঠিন।[2]
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের স্বাধিকার হরণ, বাজারে টাকার জোগানেও সরকারের মাতব্বরি
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মানিটারি পলিসি কমিটির (এমপিসি) নিয়মিত দেশের অর্থনীতিতে টাকার জোগান এবং চাহিদার হিসেব কষে কতটা টাকা বাজারে থাকা উচিত, সেটা ঠিক করে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সেই পরামর্শ অনুযায়ী মন্দার সময় আর্থিক ব্যবস্থায় টাকার জোগান বাড়ায়— ব্যাঙ্কের বন্ড বিক্রি করে ঋণপত্র কিনে, কিংবা কম দরে ব্যাঙ্কগুলোকে টাকা ধার দিয়ে। যাতে ব্যাঙ্ক কম সুদে বাজারে টাকা ধার দিতে পারে। আবার মুদ্রাস্ফীতির সময় বাজারে টাকার জোগান কমায়—ব্যাঙ্ককে সরকারি বন্ড বিক্রি করে এবং ব্যাঙ্ককে ধার দেওয়ার সুদের হার বাড়িয়ে। যাতে ব্যাঙ্কের কাছে সস্তায় লোন দেওয়ার মতো টাকা না থাকে।
কিন্তু অক্টোবর 2018-তে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের স্বাধিকার বা অটোনমি প্রশ্নের মুখে দাঁড়ায়। স্বাধীনতার পর প্রথমবার কেন্দ্রীয় সরকার রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অ্যাক্টের ধারা 7(1)-এর অধিকার প্রয়োগ করে এবং নিজেদের রাজকোষের চাপ কমাতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের 70 বছরের আয় থেকে সঞ্চিত অর্থ নিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। সেই সময় তৎকালীন গভর্নর উর্জিত প্যাটেল পদত্যাগ করেন। ডেপুটি গভর্নর বিরল আচার্য রিজার্ভ ব্যাঙ্কের স্বাধিকার রক্ষার পক্ষে তিক্ত বক্তব্য রাখেন।[3] তারপর বিরল আচার্যকেও পদত্যাগ করতে হয়, এবং নিয়ম বদলে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বোর্ড অফ ডায়রেক্টর্সে সরকারের প্রতিনিধির সংখ্যা বাড়ানো হয়। ফলে বাজারে টাকার জোগানের সংকোচন বা প্রসারণের প্রশ্নে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে কোনও মতভেদ বা বিতর্কের সম্ভাবনাই থাকে না। অবশেষে 27 অগাষ্ট, 2019 তারিখে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নিজেদের অর্থভাণ্ডার থেকে 1,76,051 কোটি টাকা বা 1.76 লক্ষ কোটি টাকা কেন্দ্রীয় সরকারকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।[4] এতে আর্থিক মন্দা এবং ক্রমাগত কমতে থাকা রাজস্ব আদায়ের ফলে সরকারের রাজকোষে যে চাপ সৃষ্টি হচ্ছিল, তা অনেকটা কমে যায়।[5] অর্থনীতিবিদরা আশা করেছিলেন, এর ফলে সরকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ নির্মাণ করবে এবং কৃষক, ছোট ব্যবসায়ী এবং ক্ষুদ্র শিল্পকে কিছুটা সুরাহা দেবে, যাতে বাজারে কেনাকাটা বাড়ে।
আরও পড়ুন
লকডাউন অর্থনীতি 2. মা যা ছিলেন
সরকার নোট না ছাপলে গরিবের হাতে টাকা আসবে কোথা থেকে?
ভারতের সমস্ত রাজনৈতিক দল মনে করে দারিদ্র্য দূর হওয়া উচিত এবং এতে সরকারের ভূমিকা আছে। কিন্তু কাকে গরিব বলব, দারিদ্রসীমার দাঁড়ি কোথায় টানা হবে সে নিয়ে বিস্তর মতভেদ। তেন্ডুলকর কমিটির মতে এই সীমাটি হল ব্যক্তিপ্রতি দৈনিক খরচ 27 টাকা।
2009 সালে তেন্ডুলকর কমিটির পর্যবেক্ষণ, দেশের জনসংখ্যার 22 শতাংশ দারিদ্রসীমার নীচে বাস করে। তবে রঙ্গরাজন কমিটির (2012) মতে, এই সংখ্যাটি 30 শতাংশ। ‘ইউনাইটেড নেশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোজেক্ট’-এর মতে, 2005-06 থেকে 2015-16-এর মধ্যে 27 কোটির বেশি ভারতীয় দারিদ্রসীমার উপরে উঠেছে। কিন্তু নভেম্বর 8, 2016 থেকে গঙ্গা উল্টোখাতে বইছে। নোটবন্দি এবং জিএসটির জটিলতা ও ডিজিটাল লেনদেনে বাধ্যবাধকতার ফলে মার খেল অসংগঠিত ক্ষেত্রের অর্থনীতি। জিডিপি দ্রুত নিম্নগামী। শেষে করোনার প্রকোপে গত মার্চে এল চার ঘণ্টার নোটিসে লকডাউন— কাজ হারিয়েছে কত লোক? বিভিন্ন মতে প্রায় 5 থেকে 12 কোটি লোক। এদের উপর নির্ভরশীল পরিবার দ্রুত দারিদ্রসীমার নীচে নেমে যাচ্ছে। এরা ‘জিরো-ইনকাম গ্রুপ’ থেকে কবে ‘লোয়ার ইনকাম গ্রুপে’ ফিরবে আন্দাজ করা কঠিন। [6] অভিজিৎ ব্যানার্জি সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, ভারতের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারে, এবং চিন থেকে কাজ ভিয়েতনাম, ফিলিপিন্স বা বাংলাদেশে চলে গেছে বলে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ভারতের আর্থিক কাঠামো, প্রযুক্তি, উদ্যোগপতির সংখ্যা- সবই ওদের তুলনায় বেশি। যদি এক বছরে জিডিপি বৃদ্ধির হার 6 শতাংশ বা 7 শতাংশে পৌঁছে যায়, তাহলেই কাজ হারানো মানুষেরা অনেকেই কাজ ফিরে পাবে। কিন্তু সবই নির্ভর করছে সরকারের সঠিক নীতি নির্ধারণের উপর। [7] নোট ছাপানোর যুক্তিকে সমর্থন করে তাঁর বক্তব্য, গোটা বিশ্বে সবাই এই পথ নিয়েছে— আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানি, জাপান সবাই। ভারত কেন শুধুমুধু উল্টো পথে হাঁটবে?
কিন্তু সরকার রাজকোষ ঘাটতি মেটাতে নতুন করে টাকা ছাপাবে তেমন কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী দ্বিতীয় রিলিফ প্যাকেজ (20 লক্ষ কোটি) ঘোষণার আগে জানিয়েছিলেন যে, করোনা-জনিত প্যাকেজ ইত্যাদির ফলে রাজকোষ ঘাটতি বাজেটের সময় বলা 3 শতাংশের বদলে 5 শতাংশ হবে; অর্থাৎ 7.8 লক্ষ কোটির বদলে 12 লক্ষ কোটি টাকা ধার করতে হবে। কিন্তু প্যাকেজ ঘোষণার সময় বাড়তি টাকা কোথা থেকে আসবে, সেই প্রশ্ন উনি এড়িয়ে গিয়েছিলেন। সরকার যদি এই টাকাটা তুলতে বাজারে বন্ড বিক্রি করে, তাহলে বেসরকারি ক্ষেত্রের ধার নেওয়ার জন্য উপলব্ধ টাকা কমবে, ফলে বাজারে সুদের হার বাড়বে। কিন্তু তা না করে সোজা রিজার্ভ ব্যাঙ্কে ট্রেজারি বিল (বিনা সুদের অল্পকালীন বন্ড) জমা রেখে নোট ছাপিয়ে নিলে, বাজারে সুদের হারে কোনও প্রভাব পড়বে না, তাই মনে হচ্ছিল নোট ছাপানো হবে। [8]
আরও পড়ুন
লকডাউন অর্থনীতি 3: চলতি বছরের বাজেট
ডেফিসিট ফাইন্যান্সিং বা সাময়িক ধার করে সরকার চালানোই সমাধান
এখানে দুইখানা কথা আছে। আমেরিকা ইউরোপের মতো উন্নত অর্থনীতিতে সাধারণত অর্থনীতির অন্তর্নিহিত শক্তির প্রায় পূর্ণ দোহন হতে থাকে। তখন বাজারে অতিরিক্ত পয়সা এলে উৎপাদন বা শ্রমশক্তির নিয়োগে বিশেষ তফাত হয় না। তাই বাড়তি টাকা বাজারে পণ্যের দাম দ্রুত বাড়িয়ে দেয়। এই পরিস্থিতিকে বলে ‘টু মাচ মানি চেজিং টু ফিউ গুডস’।
কিন্তু ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের লোকজনের আয় কম, জমা পুঁজি কম। জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য অংশ হয় বেকার বা ছদ্ম-বেকার, মানে নাম-কে-ওয়াস্তে কিছু একটা করছে। ফলে বাজারে জিনিসের জোগান বাড়লে বা নতুন পণ্য এলেই যে সাত তাড়াতাড়ি বিক্রি হবে সে সম্ভাবনা কম। তাই ইন্ডাস্ট্রিও “ফুল ক্যাপাসিটি”তে উৎপাদন করে না। মহাগুরু কেইন্সের মতে এইসময়, বিশেষ করে মন্দার সময়, সরকার এগিয়ে এসে লোকের হাতে বেকার ভাতা দিলে বা রাস্তা, হাসপাতাল ইত্যাদি নির্মাণ কাজের বেতন হিসেবে নগদ দেওয়ার বন্দোবস্ত করলে, লোকে বাজারে ভোগ্যপণ্য কিনতে আসবে, ক্রমশ বাজার আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়াবে।
যেটা দরকার, হিসেব করে ধার নিয়ে নোট ছাপানো এবং পরিকল্পনা করে কয়েক বছরের মধ্যে সেই ধার চুকিয়ে ফেলা। এভাবে এই ডেফিসিট ফাইন্যান্সিং উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য বৃদ্ধির সহায়ক হবে, লাগামছাড়া মুদ্রাস্ফীতির পথে হাঁটবে না।
আরও পড়ুন
লকডাউন অর্থনীতি 4: মা যা হইয়াছেন
বাণিজ্যনির্ভর আধুনিক অর্থনীতিতে ‘আত্মনির্ভর ভারত’ কোনও সমাধান হতে পারে না
লাদাখ সীমান্তে চিন ও ভারতের সামান্য বিরোধ থেকেই সোশাল মিডিয়া এবং টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে একটা আহ্বান ছড়িয়ে পড়ছে— চিনের মাল বয়কট করতে হবে। ভোকাল ফর লোকাল হও, এবং এভাবেই ভারত “আত্মনির্ভর” হবে।
মজার ব্যাপার হল, ভারতের চিন থেকে আমদানি 2014 সালে 12 বিলিয়ন (লক্ষ কোটি) ডলার ছিল, কিন্তু মোদীজির সময় মাত্র পাঁচ বছরে বেড়ে গিয়ে 2018-19-এ 70.3 বিলিয়ন ডলার হয়েছে— যাতে ভারতের রপ্তানি 16.8 বিলিয়ন ডলার এবং চিন থেকে আমদানি 70.3 বিলিয়ন ডলার। মানে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ 53. 5 বিলিয়ন ডলার। বর্তমান ভারতে অধিকাংশ মোবাইল কোম্পানি, যেমন- রেডমি, ওপ্পো, ভিভো সব চিনের। গত দু’বছরে ভারতে স্টার্ট আপে চিনের বেসরকারি বিনিয়োগ বেড়ে 2 লক্ষ কোটি টাকা হয়েছে। ভারতে 30টি বড় স্টার্ট আপের মধ্যে 18টি স্টার্ট আপে চিনের বেসরকারি বিনিয়োগ রয়েছে। ওলা, হাইক, বিগ বাস্কেট, ওওয়াইও, পেটিএম (নোটবন্দির সময় প্রধানমন্ত্রীর বিজ্ঞাপন), স্ন্যাপডিল, জোম্যাটো, বাইজুস, টিকটক- সবেতেই চিনের বিনিয়োগ রয়েছে।[9]
তবে ভারতের কিছু কোম্পানিও চিনে বিনিয়োগ করেছে। কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রির দু’বছর আগের একটি স্টাডি রিপোর্ট অনুযায়ী, চিনে 54টি ভারতীয় কোম্পানি উৎপাদন, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যুক্ত রয়েছে।[10] চিনে এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, কয়লা এবং বিদ্যুৎ রপ্তানিতে আদানি গ্লোবাল (সিঙ্গাপুরে অফিস), ড. রেড্ডিজ ল্যাব, জিন্দাল স্টিল এন্ড পাওয়ার, বিইএমএল, বিএইচএমএল, অরবিন্দ ফার্মা এবং মহীন্দ্রা এন্ড মহীন্দ্রা।
ফলে চিনা মাল বয়কটের আহ্বানের মধ্যে যতটা দেশপ্রেম আর রাজনীতি আছে ততটা আর্থিক বিবেচনা নেই। কারণ সরকারি বাণিজ্য ছাড়াও ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগে ভারতে তৈরি বহু উৎপাদনে ব্যবহৃত মেশিন বা তার যন্ত্রাংশ, কেমিক্যালস সব চিন থেকে আসে। এছাড়া অনেক স্টার্ট আপে চিনের আলিবাবা ইত্যাদির বিনিয়োগ রয়েছে। কাজেই কাকে চিনা মাল বলা হবে, এটাও একটি বিতর্কিত প্রশ্ন। এমনকি, সর্দার প্যাটেলের স্ট্যাচুর বাইরের ব্রোঞ্জের আবরণের প্লেটগুলো পর্য্ন্ত চিনের সিয়াংসি টংকিং কোম্পানিতে ঢালাই হয়ে এসেছে।[11] এছাড়া ভারতে চিনের রফতানি 75 বিলিয়ন ডলার, ওদের সমগ্র রফতানির 3 শতাংশ। কিন্তু চিনে ভারতের রফতানি 17 বিলিয়ন ডলার, যা কিনা দেশের সমগ্র রফতানির 5.3 শতাংশ। কাজেই দু’দেশের বাণিজ্য মার খেলে ভারতের লোকসান বেশি।[12] কিন্তু কিছু ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন 10 জুন থেকে দেশ জুড়ে চিনা মাল আমদানি বন্ধ করার ডাক দিয়েছে।[13]
আগামী দিনের জীবিকার রূপ:
অর্থনীতি কেবল শুকনো টাকাকড়ির হিসেব নয়, কোনও বিমূর্ত ছবি বা রকেট সায়েন্সও নয়, এটি একটি সামাজিক বিজ্ঞান। তাই এতে প্রতিফলিত হয় আমাদের জীবনশৈলী এবং সংস্কৃতি ও তার বিবর্তন। জুনের শেষে ভারতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা 5 লক্ষ ছাড়িয়ে যেতে পারে, এবং জুলাইয়ের শেষে 10 লক্ষ।
এর আতঙ্ক এবং বাধ্যবাধকতা আমাদের জীবিকা ও জীবনশৈলীতে কী ধরনের পরিবর্তন আনবে, আজ সেটা আন্দাজ করা কঠিন। তবু কয়েকটা কথা বলাই যায় । যেমন কেনাকাটাতে নগদে লেনদেন কমে ক্রমশ ডিজিটাল লেনদেন বাড়বে। অনেকগুলো ব্যবসায় এবং শিল্পে “ওয়ার্ক ফ্রম হোম” হবে ‘নিউ-নর্মাল’। স্কুল-কলেজের পড়াশুনোতেও এর ছাপ পড়বে। কিন্তু এর জন্য দরকার উন্নত স্কিল-সেট বা পরিকাঠামো, যা ব্যয়সাধ্য। ফলে গ্রাম এবং ছোট শহরের খেটে খাওয়া পরিবারের নতুন প্রজন্ম হয়তো পিছিয়ে পড়বে এবং কম আয়ের কাজে আটকে থাকবে।
লকডাউনে সবচেয়ে মার খেয়েছে খেলাধূলা, বিনোদন শিল্প এবং পর্যটন ও হোটেল ব্যবসা
‘সামাজিক দুরত্ব’ বজায় রাখতে গিয়ে নতুন খোলা রেস্তোরাঁতে টেবিল সাজানো হচ্ছে ফাঁক রেখে, ক্রেতারা বসছেন পাশাপাশি নয়, মুখোমুখি। এতে ব্যবসায় বড় ক্ষতি হচ্ছে। মনে হয় যতদিন না করোনার ভ্যাক্সিন আবিষ্কার হচ্ছে এবং তা আমজনতার হাতে পৌঁছাচ্ছে, ততদিন এইভাবেই চালাতে হবে। ,সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে মুখে মুখোশ এঁটে কোন খেলাটি খেলা যায়? টেনিস? ফুটবল? ক্রিকেট? আইপিএল? আইএসএল? কুস্তি-বক্সিং? সাঁতার? তবে বার্সেলোনা রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে মাঠে নামছে, মেসি ট্রেনিং করছেন; দেখা যাক।
বিনোদন জগতে টিভি সিরিয়ালের শ্যুটিং শুরু হচ্ছে, কিন্তু গ্রুপ থিয়েটার এবং পথ-নাটকের কী হবে? আবেগের প্রকাশ হবে হাত না ধরে? শুধু সংলাপ বলে?
মানুষ ক্রমাগত উদ্ভাবন করে চলেছে, এমনকী আদিমতম জীবিকায়ও
অল ইন্ডিয়া নেটওয়ার্ক অফ সেক্স ওয়ার্কার্সের প্রেসিডেন্ট কুসুম জানিয়েছেন যে, সামাজিক দূরত্ববিধির জন্য গ্রাহকেরা আসছে না। তাই কাজ হারিয়ে দিল্লির যৌনকর্মীদের 60 শতাংশ, প্রায় 3,000 কর্মী তাদের নিজের রাজ্যে ফিরে গেছেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ শালিনীর মত পরিবারের অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে, উত্তরপ্রদেশে গাঁয়ের বাড়ি ছেড়ে দিল্লিতে এসেছিলেন। এখন সেখানেই ফিরে যেতে হচ্ছে।[14]
গার্স্টিন বাস্টিয়ন রোড বা জিবি রোডের শর্মিলা, রজনীদের মতো অনেকেরই এখন বাচ্চাকে খাওয়ানোর পয়সা জুটছে না— সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।
আরও পড়ুন
লকডাউনে অর্থনীতি 5: কেউ কথা রাখেনি
কলকাতার সোনাগাছি এবং অন্যান্য লালবাতি এলাকাতেও প্রায় একই অবস্থা। যৌনকর্মীদের ইউনিয়ন ‘দুর্বার’ এবং কিছু এনজিও-র সহায়তায় এদের কোনওরকমে দু’বেলা মোটা ভাতের জোগাড় হচ্ছে বটে, কিন্তু কতদিন? খবরে প্রকাশ, বড়তলা থানার ওসি দেবজিত ভট্টাচার্য্য 5,000 যৌনকর্মী মহিলাকে চিহ্নিত করে কিছু এনজিও-র সহায়তায় দু’বেলা খাবার জোগানোর দায়িত্ব নিয়েছেন।[15]
কিন্তু মানুষ বাঁচতে চায়, তাই বিষম পরিস্থিতিতে হার না মেনে প্রাণপণ লড়াই করে। করোনার হট জোন মুম্বাই নগরী এখন ভয় ধরায়। এখানে বিশেষ ধর্ম সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষও বাড়ছে। মুম্বাইয়ের গ্রান্ট রোডের যৌনপল্লীর বাসিন্দা রিয়া (নাম বদলে দেওয়া হয়েছে) ও তাঁর সঙ্গীরা প্রযুক্তি ব্যবহার করে পেশার কৌশল পাল্টে নিয়েছেন। তাঁরা মোবাইলের মাধ্যমে গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন হিন্দু এবং মুসলিম দু'টো নাম নিয়ে। উনি নির্ধারিত সময়ে সেজেগুজে, কিন্তু ওড়নায় মুখ ঢেকে ভিডিও চ্যাটে বসেন। সময় 30 মিনিট, এইভাবে প্রতিদিন ঘরে বসেই গ্রাহক প্রতি 300 থেকে 500 টাকা দরে দুই বা তিনজন গ্রাহকের মনোরঞ্জন করেন। উনি খুশি, কাউকে কমিশন দিতে হয় না, গুন্ডা বা পুলিশের উপদ্রব নেই এবং সবচেয়ে বড় কথা স্বাস্থ্যের উপর চাপ নেই।[16]
নতুন সম্ভাবনা:
মনে হচ্ছে এই মহামারীর ঠেলায় আগামী দিনে রাষ্ট্রের ভূমিকা আরও বাড়বে। মার্ক্স-লেনিনের মতো সমাজতন্ত্রী এবং প্রুধোঁ-বাকুনিনের মত নৈরাজ্যবাদীদের স্বপ্ন— রাষ্ট্র ক্ষয়ে গিয়ে ফুরিয়ে যাবে বা ধ্বংস হবে— সত্যি হওয়ার সম্ভাবনা আপাতত নেই।
কিন্তু দু'টো বিষয়ে রাষ্ট্রের সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে করোনা-পরবর্তী দশকে বড় বিতর্ক শুরু হতে চলেছে। এক, ইউনিভার্সাল হেল্থ-কেয়ার বা সর্বজনীন স্বাস্থ্য-প্রকল্প এবং ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম বা সর্বজনীন মৌলিক আয়। দ্বিতীয়টির কেনিয়া, ইরান ও আলাস্কায় প্রয়োগ শুরু হয়েছে। এই নিয়ে ভবিষ্যতে আলাদা করে কথা বলা যাবে।
তথ্যসূত্র:
---------------------------------------------------------------------
1 বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, 5 জুন, 2020
2 লাইভমিন্ট ডটকম, 5 জুন, 2020
3 ইকনমিক টাইমস, 11 নভেম্বর 2018
4 দি টাইমস অফ ইন্ডিয়া, 28 আগষ্ট, 2019
5 দি হিন্দু এবং ইন্ডিয়া টুডে, 27 ও 28 অগাষ্ট, 2019
6 বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, দেবাংশু দত্তের প্রবন্ধ, 6 জুন, 2010
7 অভিজিৎ ব্যানার্জি, এনডিটিভি-তে রবীশকুমারকে দেওয়া সাক্ষাৎকার; 5 জুন, 2020
8 ইকনমিক টাইমস, 19 মে, 2020
9 জি নিউজ মিডিয়া ব্যুরো, 8 জুন, 2020
10 “গ্রোয়িং ফুটপ্রিন্টস অফ ইন্ডিয়ান কোম্পানিজ ইন চায়না”—এ সার্ভে বেসড রিপোর্ট অফ সিআইআই, ফেব্রুয়ারি, 2018
11 টাইমস অফ ইন্ডিয়া, 27 সেপ্টেম্বর, 2018
12 লাইভ মিন্ট, 3 জুন, 2020
13 ইকনমিক টাইমস, 3 জুন, 2020
14 টাইমস অফ ইন্ডিয়া; 17 মে, 2020
15 টাইমস অফ ইন্ডিয়া; 20 এপ্রিল, 2020
16 লাইভমিন্ট ডটকম, 22 মে, 2020
দাঙ্গার সময় গান্ধীজির মুসলিম শরণার্থীদের সাহায্যে হিন্দু যুবকদের এগিয়ে আসার আহ্বানে খেপেন সাভারকর।
সেলুলার জেলের নাম পালটে তাঁর নামে রাখা হল। এ বার দাবি তাঁকে ‘ভারতরত্ন’ দেওয়া হোক।
স্বাধীনতা সংগ্রামে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের সমর্থক ছিলেন। সেই সাভারকরই কালাপানি থেকে ফেরত এলেন কট্টর মুস
আমরা দেখব যে সাভারকরের হিন্দুত্ব এবং আরএসএস-এর হিন্দুত্বের মধ্যে কী কী মিল এবং কোথায় অমিল।
15 লাখ মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা অসমে
সেরা ভোজনরসিক না বুঝলেও মাংসের হালাল ঝটকা বিচারে নেমেছে দিল্লি পুরসভা