করোনার আগেই সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতির হাল ছিল করুণ
করোনা-পরবর্তী ভারতে মহামারী ঠেকাতে সরকারের চার দফায় (এ যাবৎ) লকডাউনের ফলে তৈরি হওয়া আর্থিক সঙ্কট ও তার সরকারি নিদান বুঝতে গেলে দরকার করোনা-পূর্ব ভারতের আর্থিক চেহারা কেমন ছিল তা দেখা।
করোনা মহামারীর আগে ভারতের আর্থিক চেহারাটি সংক্ষেপে বুঝতে আমরা কয়েকটি তথ্যের উপর জোর দেব। যেমন, গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট (জিডিপি) বা মোট ঘরোয়া উৎপাদন, পার ক্যাপিটা জিডিপি বা মাথাপিছু গড় জিডিপি, বেকারত্বের হাল হকিকত, ফিস্ক্যাল ডেফিসিট বা আর্থিক ঘাটতি, বিভিন্ন শিল্পে মন্দার ছবি, ব্যাঙ্কের হাল ইত্যাদি।
2018 সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে থেকে হাওয়ায় ভেসে আসছিল কিছু কথা। যেমন ভারত এখন প্রায় 3 ট্রিলিয়ন (লক্ষ কোটি) ইকনমি, দ্রুত অগ্রগতির নিরিখে বিশ্বে দু’নম্বরে পৌঁছে গেছে। শীগগিরই চিনকে ছাড়িয়ে যাবে, ফ্রান্সকে ছাড়িয়ে গেছে। দ্বিতীয়বার জেতার পর প্রধানমন্ত্রী দেশের জন্যে নতুন লক্ষ্য ঘোষণা করলেন। ভারতকে আগামী কয়েক বছরে 5 ট্রিলিয়ন (মার্কিন ডলার) ইকনমি হতে হবে।[1] অর্থাৎ ভারতের জিডিপি এখন প্রায় 3 ট্রিলিয়ন, পাঁচ বছরে 5 ট্রিলিয়ন জিডিপির বুড়ি ছুঁতে হবে। চারদিকে ধন্য ধন্য পড়ে গেল। এমন সাহসী প্রধানমন্ত্রী, এমন স্বপ্নদ্রষ্টা কেউ গত 70 বছরে দেখেনি।
এর জন্য দরকার বছরে 14 শতাংশ দরে জিডিপি বৃদ্ধি। তাহলে মুদ্রাস্ফীতি 4 শতাংশ বাদ দিয়ে নীট বৃদ্ধি 10 শতাংশ হবে। তাহলে 5 বছরে গিয়ে 5 ট্রিলিয়ন হতে পারে । কিন্তু 2016 সালের শেষের দিকে ডি-মনিটাইজেশনের ধাক্কায় সেই যে জিডিপি বৃদ্ধির হার পড়তে শুরু করল আজও থামার লক্ষণ নেই, মেরে কেটে 5 শতাংশ হবে। তাহলে? কেউ কেউ অবশ্য বললেন, উৎসাহে কী না হয়, কী না হয় চেষ্টায়! দরকার 56 ইঞ্চি বুকের ছাতি। হিন্দি বলয়ে পথেঘাটে শুনলাম, এঁর হাতে দেশের বাগডোর তাই দেশ এখন বিশ্বের মধ্যে দু’নম্বর। ইনি প্রধানমন্ত্রী থাকলে আজ নয় কাল একনম্বর হয়ে যাব!
আসুন, আমরা আগে এই দু’নম্বর হওয়ার দাবিটি যাচাই করে দেখি।
দেশের অর্থনীতির অবস্থা মাপা হয় জিডিপি বা গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট দিয়ে। এই “সমগ্র ঘরোয়া উৎপাদন” এমন একটি সূচক যা কোনও দেশে একটি নির্দিষ্ট বছরে দেশের মধ্যে উৎপন্ন সমস্ত দ্রব্য (গুডস) এবং পরিষেবার (সার্ভিস) যোগফলের হিসেব কষে আর্থিক অবস্থাকে মেপে নেয়। ইকনমিক্সের ফর্মুলা ধরলে: জিডিপি= সি + জি + আই + এন (রফতানি বিয়োগ আমদানি); যেখানে সি হচ্ছে ব্যক্তিগত উপভোগ, জি হচ্ছে সরকারি বা পাবলিক সেক্টরে বিনিয়োগ, আই হচ্ছে কর্পোরেট সেক্টরের বিনিয়োগ এবং এন হচ্ছে আমদানি-রপ্তানির নীট ফল, অর্থাৎ রপ্তানি বেশি হলে প্লাস, আমদানি বেশি হলে মাইনাস।
সেই হিসেবে ভারত এখন 2 ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ইকনমির দেশ। আশা ছিল মার্চ 2020 নাগাদ 3 ট্রিলিয়ন হবে, কিন্তু মন্দা এবং করোনার কারণে সেটা হয়নি। সে কথায় পরে আসছি।
গত নির্বাচনে জেতার পর থেকে মোদীজি স্বপ্ন দেখিয়েছেন যে তাঁর কথা শুনে ঠিকমতো চললে আমরা 2024 সাল নাগাদ 5 ট্রিলিয়ন ইকনমি হয়ে যাব।
অন্য দেশগুলো? চিন 14.14 ট্রিলিয়ন ডলার, আমেরিকা 21.44 ট্রিলিয়ন।
আসলে ‘ইমার্জিং ইকনমি’ বা ‘সবচেয়ে দ্রুত উঠে আসা ইকনমি’র বিচারে ভারত এক বছরের জন্য চিনকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থানে ছিল । এই কথাটাই মন্ত্রী-সান্ত্রী-পাত্র-মিত্র-অমাত্যের দল জোর গলায় বলে বেড়াচ্ছিলেন। তবে চিন তার মন্দা অনেকটা সামলে আবার সেই আগের জায়গায়।
বিশ্বে ইকনমির সাইজে ভারত এখন পঞ্চম থেকে সপ্তম স্থানের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। চিন, জাপান এবং জার্মানি যথাক্রমে দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ স্থানে রয়েছে।
দেশ |
আমেরিকা |
চীন |
জাপান |
জার্মানি |
ভারত |
ব্রিটেন |
ফ্রান্স |
জিডিপি (মার্কিন ডলারে)[2] |
21.44 |
14.44 |
5.15 |
3.86 |
2.94 |
2.84 |
2.73 |
তথ্যসূত্রঃ ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ড 2019
মাথাপিছু জিডিপি:
গ্রস জিডিপি বা মোট দেশের সম্পদের হিসেব পুরো ছবিটা তুলে ধরে না। ভারতের মত বিশাল দেশ যার জনসংখ্যা 134 কোটি তার মোট সম্পদ তো বড় মাপের হবেই। অন্য দেশের সঙ্গে তুলনা হবে কী করে? সেখানে মাথাপিছু গড় সম্পদ বা পার ক্যাপিটা জিডিপি কিছুটা সঠিক সূচকের কাজ করে। দেখা যাক 180 টি দেশের মধ্যে আমরা কে কোথায় দাঁড়িয়ে।
দেশ |
মাথাপিছু জিডিপি (মার্কিন ডলারে)[3] |
র্যাঙ্ক |
আমেরিকা |
65111 |
7 |
চীন |
10098 |
65 |
ইন্দোনেশিয়া |
4176 |
109 |
ভারত |
2171 |
139 |
আর একটা তুলনা করা যাক। মনমোহন সিংয়ের সময়ে, অর্থাৎ 2014 সালে ভারতের জিডিপি এবং পার ক্যাপিটা জিডিপি কেমন ছিল ।
দেশ |
জিডিপি (ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে)
|
|
|
|
2014 [4] |
2019 |
বৃদ্ধির হার (শতাংশে) |
আমেরিকা |
15.11
|
21.44 |
6.33 |
চীন |
10.38 |
14.44 |
4.06 |
জাপান |
4.62 |
5.15 |
0.53 |
জার্মানি |
3.86 |
3.86 |
0 |
ব্রিটেন |
2.95 |
2.84 |
- 0.11 |
ফ্রান্স |
2.85 |
2.73 |
- 0.12 |
ভারত |
2.05 |
2.94 |
0.89 |
ভারত সপ্তম স্থানে, রাশিয়ার আগে কিন্তু ইতালি ও ব্রাজিলের পিছনে।
কিন্তু মাথাপিছু জিডিপির হিসেবে ভারতের স্থান 190 টি দেশের মধ্যে 139তম; পাকিস্তান, নেপাল , বাংলাদেশের থেকে সামান্য উপরে বটে, কিন্তু ভিয়েতনাম (130), মিশর, লাওস (131), ভেনেজুয়েলা(133), ঘানা (137), সিরিয়া, ইত্যাদির নীচে।[5]
দেখা যাচ্ছে, মোট জিডিপির আয়তনে মাঝে মাঝে ফ্রান্স ও ব্রিটেনকে পেছনে ফেলে পঞ্চম স্থান অধিকার করা ভারত মাথাপিছু জিডিপির মানদন্ডে ভিয়েতনামের পিছনে? এর একটা কারণ ভারতের বিশাল 133 কোটি জনসংখ্যা। বাস্তবিক ব্যক্তির দারিদ্র কিন্তু সুধু ওই মাথাপিছু পরিসংখ্যান দিয়েই বোঝা যাবে না। ভারতের শীর্ষ 1 শতাংশ ধনীর হাতে গোটা দেশের সম্পত্তির 73 শতাংশ বা নীচের দিকের 70 শতাংশ জনসংখ্যার সম্পত্তির চারগুণ। এটা ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের সামনে 2018তে পেশ করা অক্সফ্যামের রিপোর্ট। ভারতের বিলিওনারদের সম্পত্তির পরিমাণ সরকারের একবছরের বাজেটের চেয়ে বেশি।[6]
আয়-বৈষম্য
এই বিষয়টি নিয়ে টিভি চ্যানেলে কখনই কোনও আলোচনা হয় না। কিন্তু আমরা বাঙালী। আমাদের বঙ্কিমচন্দ্র শুধু বন্দেমাতরম শেখাননি, শিখিয়েছেন হাসিম শেখ ও রামা কৈবর্ত্যের কথাও ভাবতে। কাজেই আমরা আয় বা সম্পত্তির বৈষম্য মাপার সূচক জিনি কোএফিশিয়েন্ট নিয়েও কথা বলব। জিনির ভ্যালু 0 থেকে 1 অব্দি হতে পারে। 0 = পূর্ণ সাম্য, 1 = পূর্ণ বৈষম্য।
এটা মাপা হয় দু’ভাবে। ট্যাক্সের আগের আয় বা ট্যাক্সের পরের আয়ের ভিত্তিতে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক মাপে ট্যাক্স পরবর্তী আয়ের ভিত্তিতে। ওরা বলছিল 2008 পর্যন্ত ভারতের জিনি সূচক 0.4 এর আশেপাশে ছিল, 2011 তে 0.378; তারপরে বাড়ছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের আয় বৈষম্যের তালিকায় ভারতের নাম ক্রমশঃ উপরের দিকে উঠছে।
অনেকের মতে ট্যাক্স পরবর্তী আয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টরকে ধরে না । প্রি-ট্যাক্স ইনকাম বরং বৈষম্য মাপার জন্যে অনেক বেশি নির্ভর যোগ্য ডেটাবেস। পিকেটি তাঁর ‘ক্যাপিটাল’ বইয়ে প্রি-ট্যাক্স ডেটা নিয়েই কাজ করেছেন। অর্থনীতিবিদ লুকাস চ্যান্সেল এবং টমাস পিকেটির মতে 2014 নাগাদ ভারতের ক্ষেত্রে এই সূচক বেড়ে প্রায় 0.50 বা তার কাছাকাছি হয়েছে।[7]
ফিসক্যাল ডেফিসিট বা রাজকোষ ঘাটতি
এটি একটি সূচক যা সরকার আয়ের থেকে ব্যয় কত বেশি করছে বা ধার করে কতটা খরচা করছে তা বোঝায়। এই ধার মোট জিডিপি’র কত শতাংশ তা সরকারের আর্থিক নিয়ন্ত্রণ কত দৃঢ় সেটা বোঝায়। মুডিজ, ক্রাইসিল, এস অ্যান্ড পি গ্লোবাল, ইক্রা, ফিচ রেটিং ইত্যাদি আন্তর্জাতিক রেটিং এজেন্সিগুলো এর ভিত্তিতে সরকার কত সুচারুভাবে আর্থিক প্রশাসন চালাচ্ছে তার সার্টিফিকেট দেয়। এর স্ট্যান্ডার্ড হার জিডিপির 3 শতাংশ ধরা হয়। গত পাঁচ বছরে এই দর 3 শতাংশ থেকে 4 শতাংশের মধ্যেই থেকেছে। ফলে বিভিন্ন রেটিং সংস্থা ভারত সরকারকে ভাল রেটিং দিয়েছে, যা সরকার তার আর্থিক নীতির সমালোচনার মুখোমুখি হলে ঢালের মত ব্যবহার করেছে।
অশনি সংকেত
মন্দার মার
হঠাৎ সবার চোখে পড়ল যে বাজারে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা ক্রমশ দ্রুত হারে কমছে। ইনফ্লেশন বা মুদ্রাস্ফীতি লাগামছাড়া নয়, 4 শতাংশের আশেপাশে, কিন্তু লোকে কিনছে কম। গাড়ি থেকে বাড়ি, জামাকাপড় থেকে বিস্কুট, সর্বত্র ক্রেতার উপস্থিতি আগের মতো নেই। বিদ্যুতের চাহিদা, লোকের সেভিং বা জমাপুঁজি তাও বাড়ছে না। সরকার বলল, এ তো এখন গোটা বিশ্ব জুড়ে চলছে, আমরা উন্নত দেশগুলোর তুলনায় ভালো আছি। নিন্দুকরা পাল্টা বলল, 2016 সালে রাতারাতি নোট বাতিলের ফলে মার খেয়েছে ভারতের অর্থনীতির অসংগঠিত ক্ষেত্র। এরা নগদে লেনদেন করে। তার উপর গ্রামেগঞ্জে ডিজিটাল নেটওয়ার্ক না থাকায় নতুন জিএসটি-র ধাক্কা সামলাতে না পেরে অনেক ছোট ছোট দোকানপাতির ব্যবসা মার খেয়েছে, লোক কাজ হারিয়েছে।
কর আদায়ে ঢিমে গতি
কয়েক বছর ধরেই কর আদায়ে ভাটা পড়ছিল। গত আর্থিক বছরে (2019-200 কর্পোরেট এবং ব্যক্তিগত আয়কর মিলে আদায়ের লক্ষ্য ছিল মোট 11.7 লাখ কোটি টাকা, আদায় হল 9.5 লাখ, অর্থাৎ লক্ষ্যের 81 শতাংশ।[8]
অপ্রত্যক্ষ কর বা জিএসটি আদায় হল 97,597 লক্ষকোটি, যা লক্ষের থেকে 1 লক্ষকোটি কম।[9]
ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ড এর স্টাডি টিম বলল ভারতের জিএসটি আদায় তার পোটেনশিয়ালের থেকে বেশ কম।[10]
ভারতে বেকারত্ব
ভারত সরকারের 2011 জনগণনা অনুযায়ী ভারতের রোজগারের 93 শতাংশ হল অসংগঠিত বা ইনফর্মাল ক্ষেত্রে, অর্থাৎ শহুরে স্বরোজগারী বা ক্যাজুয়াল মজুরি পাওয়া শ্রমিকের দল, যাদের শ্রম আইনের রক্ষাকবচ নেই।[11] ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক রিপোর্ট বলছে এই কম মজুরিতে কাজ করা, অকুশল, ইনফর্মাল কাজের শ্রমিকেরাই ভারতের শ্রম বাজারে সবচেয়ে চোখে পড়ার মত।[12] সংগঠিত ক্ষেত্রে 2014 পর্যন্ত ভারতে বেকারত্বের হার ছিল 2.3 শতাংশ। কিন্তু মোদী সরকারের 2017-18 সালে ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে রিপোর্ট বলল এই হার এখন 6.1 শতাংশ, যা গত চার দশকে সবচেয়ে বেশি। সরকার গত নির্বাচনের আগে পর্যন্ত এই রিপোর্ট প্রকাশ করেনি। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পরে ওই রিপোর্টকেই সরকারিভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে।[13] আমেরিকার পিউ রিসার্চ সেন্টার বলেছে “প্রায় 18.6 মিলিয়ন ভারতীয় কাজ হারিয়েছে এবং 393.7 মিলিয়ন খুব খারাপ শর্তে কাজ করছে এবং কাজ হারানোর ভয়ে খাটছে”।[14]
ব্যাঙ্কে ধোঁকাবাজি/ জালিয়াতি/ জোচ্চুরি ইত্যাদি
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্ট অনুযায়ী বর্ষ 2018-19 সালে ব্যাঙ্কে ফ্রড বা ধোকাবাজির ঘটনা 74 শতাংশ বেড়ে গেছে।[15]
বর্ষ |
কেস সংখ্যা |
রাশি (কোটি টাকায়) |
2017-18 |
5,916 |
41,167 |
2018-19 |
6,801 |
71, 543 |
চন্দা কোচার, প্রাক্তন এমডি, আই সি আই সি আই ব্যাঙ্ক, নিজের স্বামী দীপক কোচারের কোম্পানিকে অন্যায্য লোন দেওয়া এবং সেই লোন এনপিএ হওয়ার ষড়যন্ত্রে সামিল হওয়ার দায়ে অভিযুক্ত। উনি 2011 সালে পদ্মভূষণ পেয়েছিলেন। জয় টমাস, পাঞ্জাব অ্যান্ড মহারাষ্ট্র কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন এমডি 4.335 কোটি চিটিং কেসে গ্রেফতার হয়েছেন। বিজয় মালিয়া, নীরব মোদী, মেহুল চোকসি এবং আরও 28 জন রাঘব বোয়াল ব্যাঙ্ক-লোন ডিফল্টার্স দেশ ছেড়ে আগেই পালিয়ে গেছেন। তারপর সরকার 50 কোটি টাকার বেশি যাদের লোন এনপিএ হয়েছে এমন নতুন 91 জনের লিস্ট দিয়ে ব্যাঙ্ককে বলেছে ওদের পাসপোর্টের খুঁটিনাটি জানাতে।[16]
ব্যাঙ্কের এনপিএ, রাইট অফ ইত্যাদি
এনপিএ বা নন-পারফর্মিং অ্যাসেট মানে যে ব্যাঙ্ক লোন অ্যাকাউন্টে নিয়মমত ইন্সটলমেন্ট বা সুদ আদায় হচ্ছে না। এতে ব্যাঙ্কের দ্বিগুণ লোকসান। এক, এই বছরের পাওনা আয় এল না। দুই, সঞ্চিত লাভ থেকে একটি অংশ এর জন্য সরিয়ে আলাদা খাতায় রাখতে হবে।
31 মার্চ 2018-তে গোটা ব্যাঙ্কিং সেক্টরের এনপিএ 10.35 ট্রিলিয়ন (লক্ষ কোটি) টাকা। এর 85 শতাংশ পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্কের। যেমন স্টেট ব্যাঙ্কের এনপিএ 2.23 ট্রিলিয়ন। সমগ্র লোনের মধ্যে এনপিএর অনুপাত 2008 সালে ছিল 2.3 শতাংশ; 2017 সালে গিয়ে দাঁড়াল 9.3 শতাংশ ।
মোদীজির ফ্ল্যাগশিপ প্রোজেক্ট মুদ্রা লোনে (যাতে 10 লাখ টাকা পর্যন্ত বিনা জামানতে ছোট শিল্প ঋণ পায়) সাড়ে চার বছরে 17000 কোটি এনপিএ। এই মুদ্রা লোনের এনপিএ হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে তৎকালীন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর রঘুরাম রাজন সতর্ক করেছিলেন।[17] কৃষি ক্ষেত্রে 9.42 ট্রিলিয়ন লোনের 1.04 ট্রিলিয়ন 2019-এই এনপিএ (11 শতাংশ)। গত পাঁচ বছরে 2.5 লাখ ট্রিলিয়ন টাকা কৃষি ঋণ মকুব। লোকসভা ভোটের আগে নভেম্বর 2018-এ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অজানা লোকজনকে ছোট ছোট লোন (যা প্রধানমন্ত্রী শুরু করিয়েছিলেন) আগামী দিনের জন্য ভয়ঙ্কর।[18]
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ফিনানশিয়াল স্ট্যাটাস রিপোর্ট বলছে এই বছরে এনপিএ মার্চে 9.3 শতাংশ থেকে বেড়ে সেপ্টেম্বর 2020-এ গোটা ব্যাঙ্ক ঋণের 9.9 শতাংশ হয়ে যাবে।[19]
এর উপর আছে লোন রাইট অফ, বা ময়লা ঝাঁট দিয়ে কার্পেটের তলায় লুকিয়ে রাখা।
যে এনপিএ লোনটি আদায় করার কোনও সম্ভাবনা নেই, যেমন বিজনেস লাটে উঠেছে, ঋণী/ গ্যারান্টর দেউলে হয়েছে, পালিয়ে গেছে বা মারা গেছে, অথবা সম্পত্তি লুকিয়ে বেচে দিয়েছে বা আজ তার মূল্য অকিঞ্চিৎকর, তাকে ব্যাড ডেট প্রভিশন (সঞ্চিত লাভ থেকে সরিয়ে রাখা রাশি) হিসেবে অ্যাডজাস্ট করে ব্যালান্স শিট থেকে মুছে দেওয়া যায়। ফলে ব্যালান্স শিট বেশ তকতকে দেখাবে, এনপিএ কম দেখাবে, কিন্তু লাভ মার খাবে। এটা চুলচেরা বিচারে ঋণ মাফ নয় বটে, কিন্তু কোনও অ্যাকাউন্ট একবার রাইট অফ হলে তার পেছনে কেউ খামোকা পরিশ্রম করে না। আজ পর্যন্ত রাইট অফ খাতায় আদায়ের গড় হল 10 শতাংশ।
এর মধ্যে ব্যাঙ্কিং সেক্টরে 2.54 লাখকোটি এনপিএ রাইট অফ করা হয়েছে।[20]
সাকেত গোখলে বলে একজন আরটিআই কার্যকর্তা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে আরটিআই পিটিশন দিয়ে সবচেয়ে বড় 50 টি ব্যাঙ্ক লোনের উইলফুল ডিফল্টারদের (যারা ইচ্ছে করে ঋণ শোধ করেনি এবং যাদের ঋণ রাইট অফ করা হয়েছে) নাম জানতে চাইলে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক 16 ফেব্রুয়ারি, 2020-তে উত্তর দেয় যে এই তথ্য আইনত দেওয়া সম্ভব নয় । শেষে আদালতের হস্তক্ষেপে 24 এপ্রিলে সেই লিস্ট পাওয়া গেলে দেখা যায় যে 2019-20-তে ওই 50 জনের অনাদায়ী লোন রাইট অফ করার ফলে ব্যাঙ্ক গুলোর ডুবেছে 68607 কোটি টাকা।[21]
দেখা যাচ্ছে যে ওই লিস্টের শীর্ষে রয়েছেন মেহুল চোকসি’র গীতাঞ্জলী জুয়েলাখা (5,492 কোটি টাকা) এবং ওর আরও তিনটি ফার্ম। মেহুল, নীরব মোদী এরা অনেক আগেই দেশের বাইরে পালিয়ে গেছেন। চার নম্বরে আছে রুচি সোয়া(2,212 কোটি )। এই ফার্মটি বাবা রামদেব এর পতঞ্জলি গত সেপ্টেম্বরে 4200 কোটি টাকায় কিনে নিয়েছে। রামদেবের ঘোষণা অনুযায়ী 4000 কোটি টাকা দিয়ে রুচি সোয়ার পাওনাদারদের চুকিয়ে দেওয়া হবে। সে না হয় হল, কিন্তু ব্যাঙ্কের বকেয়া টাকা কেউ চোকায়নি। অথচ রুচি সোয়া বাবার অধিগ্রহণের পর মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। স্টক এক্সচেঞ্জে নাম লিখিয়েছে।[22]
এই পটভুমিকায় ব্যাঙ্কিং সেক্টরে লোন দেওয়া কমে যাচ্ছে। একে বাজার ঠান্ডা; তায় প্রতিবছর এনপিএ আর ফ্রড। ফলে ব্যাঙ্কের ভাঁড়ারে পয়সা যথেষ্ট থাকলেও লোন দেওয়ার ব্যাপারে ওরা খুব মেপে মেপে পা ফেলছে।
(চলবে)
তথ্যসূত্র
-------------------------------------------------------------------------------------------------
[1] ইকনমিক টাইমস, 9 জানুয়ারি 2020।
[2] ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক, 2019
[3] ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ড, 2019।
[4] ঐ; 2014।
[5] তথ্যসূত্রঃ বিশ্বব্যাঙ্ক এবং ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড।
[6] বিজনেস টুডে, 30 জানুয়ারি 2019; ইকনমিক টাইমস, 20 জানুয়ারি , 2020 এবং পিটিআই।
[7] মুথুকুমার; 8 জানুয়ারি, 2018- তে হিন্দু গ্রুপের “বিজনেস লাইন” পত্রিকা (ডিজিটাল)।
[8] ব্লুমবার্গকুইন্ট, 17 মার্চ, 2020।
[9] ইকনমিক টাইমস, 1 এপ্রিল, 2020।
[10] ঐ, 17 ফেব্রুয়ারি, 2020।
[11] “কমব্যাটিং ইউথ আনএমপ্লয়মেন্ট ইন ইন্ডিয়া”, প্রবীণ সিনহা, (মার্চ, 2013), বার্লিন।
[12] ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক রিপোর্ট, 2020।
[13] বিজনেস টুডে, ইন ; 14 মার্চ, 2019।
[14] সার্ভে রেজাল্টস, পিউ রিসার্চ সেন্টার , ওয়াশিংটন ডিসি; 25 মার্চ, 2019।
[15] ইকনমিক টাইমস ; 24 ডিসেম্বর, 2019।
[16] ঐ; 15 মার্চ, 2018।
[17] ডেকান হেরাল্ড, জানুয়ারি 19, 2020
[18] ঐ; জানুয়ারি 19, 2020।
[19] দীনেশ উন্নিকৃষ্ণান , মানিকন্ট্রোল ডট কম, 4 মার্চ, 2020।
[20] ইকনমিক টাইমস, 2 অগাস্ট, 2019।
[21] ফিনানশিয়াল এক্সপ্রেস, 28 এপ্রিল, 2020।
[22] সাকেত গোখলের টুইটার এবং এনডিটিভিকে দেওয়া ইন্টারভিউ।
কৃষি উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থায় কাঠামোগত সংস্কার চাই।
এই বিপুল সংখ্যক মানুষের ভাগ্য বদলে যাবে বলে দাবি করা হচ্ছে সরকারের পক্ষে থেকে।
বিজ্ঞানের নবতম শাখা কামধেনু গৌ-বিজ্ঞানের জন্ম হল!
দাঙ্গার সময় গান্ধীজির মুসলিম শরণার্থীদের সাহায্যে হিন্দু যুবকদের এগিয়ে আসার আহ্বানে খেপেন সাভারকর।
হাসবেন না; এটা সত্যি ভাববার কথা। এই সব গান-টানের পেছনে ঘাপটি মেরে থাকা গভীর চক্রান্তের হদিশ পাওয়া যা
মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী লাভ জিহাদ আইন এখন সুপ্রিম কোর্টে