×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • লকডাউনে অর্থনীতি 5: কেউ কথা রাখেনি

    রঞ্জন রায় | 06-06-2020

    টাকা ছাপানো কি ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ?


    প্রথম লকডাউন ঘোষণার পর মোদীজি বারাণসীর জনসভায় বলেছিলেন, করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ে লাগবে 21 দিন, কুরুক্ষেত্র ধর্মযুদ্ধের চেয়ে মাত্র তিনদিন বেশি।[1] সবাই থালা বাজিয়ে শাঁখ ফুঁকে স্বাগত জানাল। কিন্তু চার-চারটে লকডাউনের পর এখন ‘লক ওপেন’-এর সময় ভারতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দু’লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। দৈনিক নতুন সংক্রমণের নিরিখে ভারত এখন (6 জুন) বিশ্বে তিন নম্বরে। 


    অবশ্য প্রধানমন্ত্রী নোটবন্দির সময়েও দেশবাসীর কাছে 50 দিন সময় চেয়েছিলেন কালোটাকা উদ্ধরের জন্য, ‘ব্যর্থ হলে আমায় শাস্তি দিও’ বলেছিলেন।[2]  যদিও দু’বছর পরে দেখা গেল, 99% কালো টাকা সাদা হয়ে ব্যাঙ্কে ফিরে এসেছে।


    প্রচারমাধ্যমে শোনা গিয়েছিল, শ্রমিক ট্রেনের টিকিটের 85% ব্যয়ভার কেন্দ্রীয় সরকার বহন করবে। কিন্তু, 2রা মে রেলমন্ত্রকের নির্দেশিকা জানাচ্ছে যে, রাজ্য সরকার ট্রেনে চড়ার আগে শ্রমিকদের থেকে ভাড়া আদায় করে রেলকে জমা দেবে।[3]  শেষে সুপ্রিম কোর্টে বিচারকদের প্রশ্নের উত্তরে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা জানিয়েছেন যে, কেন্দ্রীয় সরকার নয়, রাজ্য সরকারই টিকিটের খরচ বহন করছে। কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে পরিযায়ী শ্রমিকদের থেকে যেন এক পয়সাও না নেওয়া হয় , এবং তাদের যেন বিনামূল্যে জল ও খাবার সরবরাহ করা হয়।[4]


    আর্থিক বিকাশের হার বা জিডিপি গ্রোথ নিয়ে সরকারের দেয় তথ্য 4.2% বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থাগুলোর কাছে খুব বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ড বলছিল 1.9%,[5]  প্রাক্তন মুখ্য পরিসংখ্যানবিদ প্রণব সেন বলছেন, অন্তত 1% বাড়িয়ে বলা হচ্ছে। নমুনা রিসার্চ এবং অন্য সংস্থাগুলিও বৃদ্ধির হার এই বছর1% থেকে 2%-এর বেশি ভাবছে না।[6]  স্টেট ব্যাঙ্কের মুখ্য অর্থনীতিবিদ সৌম্যকান্তি ঘোষ বলছেন, ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল অর্গানাইজেশন বা জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থা তাদের হিসেবের পদ্ধতি স্পষ্ট করুক।[7] 


    এককথায় কোভিড-19 এবং লকডাউনের ফলে কোম্পানির বড়কর্তা থেকে দিন আনি-দিন খাই মজুর সবার আয় কমেছে দারুণ ভাবে। এটা গোটা বিশ্বের সব দেশেই ঘটছে। কিন্তু ভারতে 2016 সালের নোটবন্দি ইত্যাদির ফলে অসংগঠিত ক্ষেত্রের অর্থনীতি, যা কিনা অর্থনীতির 90%, আগেই মার খেয়ে কুঁকড়ে গেছে। ফলে বর্তমানে সংকট আরও তীব্র হয়েছে।

     

    আরও পড়ুন

    লকডাউন অর্থনীতি 1: কার রিলিফ বিশ লক্ষ কোটি টাকায়?


    সরকারের রিলিফ প্যাকেজের প্রভাব কত দূর?


    আগেই বলেছি ভারতের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় অংশ হল, মাইক্রো স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ (এমএসএমই) অর্থাৎ, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি উদ্যোগসমূহ। এদের অবদান দেশের উৎপাদন শিল্পের 45%, রফতানির 40% এবং জিডিপি’র 30%। এরা কাজ জোগায় 11 কোটি মানুষকে।


    তাই সরকারের রিলিফ প্যাকেজের অভিমুখ ছিল এই ইউনিট গুলোকে যাতে সহজ কিস্তিতে ব্যাঙ্ক ঋণ পাইয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করা যায়। বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে মনে হচ্ছে না যে, এই আর্থিক দাওয়াই বর্তমান সংকটে বিশেষ কাজে আসবে।[8]


    এক, এই ছোট ছোট ইউনিট গুলোর ঋণের চাহিদা হল প্রায় 70 লক্ষ কোটি টাকা। এর মাত্র 15% জোগান আসে ব্যাঙ্ক বা অন্য প্রচলিত অর্থনৈতিক সংস্থার থেকে।
    দুই, এই দাওয়াই বাজারে সক্রিয় প্রভাব ফেলতে অনেক সময় নেয়। ততদিনে অনেক ইউনিট ঝাঁপ ফেলে দেবে।
    তিন, এই লকডাউনের বাজারে ব্যাঙ্ক বা কেউ সহজে ঋণ দিতে চাইছে না। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত আর্থিক ব্যবস্থায় 8 লক্ষ কোটি ঠুসে দিয়েছিল (দ্বিতীয় প্যাকেজ দেখুন)। কিন্তু ব্যাঙ্কগুলো সেই টাকায় ঋণ না দিয়ে অন্তত 8.5 লক্ষ কোটি টাকা কম সুদে (রিভার্স রেপো রেটে) ফের রিজার্ভ ব্যাঙ্কেই জমা করে দিয়েছে।[9]


    অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বললেন, ব্যাঙ্ক যেন সিবিআই, সেন্ট্রাল ভিজিল্যান্স এবং অডিটের তোয়াক্কা না করে যোগ্য প্রার্থীদের ‘অটোমেটিক্যালি’ ঋণ দেয়।[10] 


    এদিকে অনেক নাম করা বণিকগোষ্ঠী, যেমন অনিল আম্বানী গ্রুপ, ক্যাফে কফি ডে, জেট এয়ারওয়েজ এবং  আইএলএফএস-এর মতো সংস্থা ঋণখেলাপি হয়েছে। ব্যাঙ্ক ভয় পাচ্ছে এই মন্দার বাজারে যখন এমএসএমই  এবং নির্মাণ সংস্থাগুলির শ্রমিক কর্মচারিদের বড় অংশ ঘরে ফিরে গেছেন, তখন অধিকাংশ  ইউনিট ঋণ নিতে চাইবে না। অথবা, হুড়মুড়িয়ে সস্তা ঋণ তারাই নেবে, যারা সেটা নিয়ে বাজারে তাদের ধার দেনা চোকাবে, কিন্তু ব্যবসায় কাজে লাগাবে না । এবং এক বছর পর ঋণ অনাদায়ী হলে 100% গ্যারান্টি নেওয়া সরকারকে দেখিয়ে দেবে।


    আসলে মন্দার সময় বাজার চাঙ্গা করতে চাই অ্যান্টিবায়োটিক বা শর্ট টার্ম সমাধান- রাজকোষ ব্যয় বা ফিস্ক্যাল এক্সপেন্ডিচার বাড়িয়ে। সোজা কথায় লোকের হাতে টাকা দেওয়া। তাতে বাজারে এফেক্টিভ ডিমান্ড বা ‘প্রকৃত চাহিদা’ বাড়বে। 


    কীভাবে প্রকৃত চাহিদা বাড়ানো সম্ভব?


    স্পষ্ট উত্তর, সরকারের জনকল্যাণে খরচা বাড়াতে হবে। বর্তমান আপৎকালীন পরিস্থিতিতে, বিনামূল্যে রেশন এবং সরকারের রাজকোষ থেকে লোককে কাজ হারানোর জন্যে বেকারভাতা দেওয়া হচ্ছে সমাধান।


    কতদিন? যতদিন কলকারখানা, বাজারহাট, দোকানপাট, গাড়িঘোড়া চলাচল শুরু হয়ে স্বাভাবিক জীবন শুরু হচ্ছে না, ততদিন। ধরুন, অন্তত ছ’মাস। এমনও হয়? হ্যাঁ, আমেরিকা, ইংল্যান্ড দিচ্ছে এবং ইউরোপের অনেক দেশ দিচ্ছে।

     

    আরও পড়ুন

    লকডাউন অর্থনীতি 2. মা যা ছিলেন

     

    আমেরিকা 2 লক্ষ কোটি টাকার অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা সেনেটে পাস করিয়ে[11] কাজ হারানো 22 মিলিয়ন নাগরিককে বেকার ভাতা এবং প্রতি সপ্তাহে অতিরিক্ত 600 ডলার করে দিচ্ছে। আর 500 ডলার বা তার কম বেতনভোগী কর্মচারিকে দু’মাসের জন্যে বিনা সুদে ঋণ দিচ্ছে।[12]


    ডেনমার্ক বলছে, এই সময় ছাঁটাই না করার শর্তে বেতনের 90% কোম্পানিগুলোকে ভর্তুকি দেবে। ইংল্যান্ড 80% এবং নেদারল্যান্ডও ঘরে বসে থাকা কর্মচারিদের ভর্তুকি দিচ্ছে।[13]


    আর দরকার কিছু পরিষেবা নির্মাণের কাজ বেসরকারি ক্ষেত্রের ভরসায় না থেকে নিজেরাই শুরু করা। বিশেষ করে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে; গাঁয়ে গঞ্জে ছোট ছোট হাসপাতাল, সরকারি ওষুধের দোকান এবং সাপ্লাই চেন গড়ে তোলা। এতে চাহিদা এবং রোজগারবৃদ্ধির দুটোরই সম্ভাবনা রয়েছে।


    কিন্তু সরকার খরচ করবে কীকরে? টাকা কোথায়? এমনিতেই ডেফিসিট বা বাজেট ঘাটতি রয়েছে।


    টাকা আসতেই পারে নোট ছাপিয়ে।


    সরকার বাজারে বন্ড ছাড়লে নেবার লোক নেই। মন্দা এবং করোনাতে জনতার আয় এবং সঞ্চয় দুটোই কমে গেছে। যদি আর্থিক ব্যবস্থা বা ব্যাঙ্কের থেকে বন্ড বেচে টাকা নিতে হয় তো চাপ আছে; অন্তত 5 থেকে 6% সুদ দিতে হবে। নইলে ব্যাঙ্কগুলো রিভার্স রেপো রেটের কম সুদে (এখন 3.75% থেকে কমে 3.35%) রিজার্ভ ব্যাঙ্কে বাড়তি টাকা জমা রাখবে। কারণ এটা অল্প সময়ের জন্যে। সরকারি বন্ড আরও বেশি সময়ের জন্যেও টাকা আটকে রাখবে।

     

    অগত্যা? সেই রিজার্ভ ব্যাঙ্কে ট্রেজারি বিল বা অল্পকালীন বন্ড জমা রেখে নতুন টাকা ছাপাতে বলা। ট্রেজারি বিল 91 দিন, 182 দিন বা 364 দিনের জন্যে বিনা সুদে জারি হয়। সরকার লিখে দেয় যে, অমুক তারিখে এই টাকা সরকার রিজার্ভ ব্যাঙ্কে ফেরত দেবে। এ যেন মাসে পকেটে টান পড়লে বন্ধুর থেকে ধার নেওয়া।


    এই হল মানিটাইজেশন অফ ফিস্ক্যাল ডেফিসিট  বা রাজকোষের ঘাটতিকে নোট ছাপিয়ে পুষিয়ে নেওয়া, যাতে মানি মার্কেট এবং ব্যাঙ্ককে এড়িয়ে সরকার সোজা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের থেকে লেনদেন করে নেয়।


    ইদানীংকালে কোন আধুনিক দেশ এই নোট ছাপানোর পন্থা নিয়েছে?


    2007-08 সালে আর্থিক বাজারে যে ব্যাপক মন্দা শুরু হল, তা ক্রমশ সমস্ত উন্নত দেশে ছড়িয়ে পড়ল। তখন কল্যাণকামী রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালন করতে ব্যাঙ্কগুলোতে টাকা ঢালা এবং বেকার ভাতায় ব্যয়বৃদ্ধি শুরু করল। তারপর টাকার ঘাটতি মেটাতে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক সরকারের অল্পকালীন বন্ড কিনে সরকারকে টাকা ধার দিল, অর্থাৎ নোট ছাপাল, ফলে বাজারে টাকার জোগান বাড়ল। যেমন ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড 2009 সালে দু’দফায় 165 এবং 175 বিলিয়ন পাউন্ড সরকারি বন্ড কিনল। মানে, বদলে সরকারকে নতুন নোট দিল। আমেরিকার ফেডারেল ব্যাঙ্ক, ইউরোপের অন্যান্য ব্যাঙ্ক এবং জাপানও পিছিয়ে ছিল না। আরে এই সেদিনও করোনার ঠেলা সামলাতে ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড এই বছরের এপ্রিলের 9 তারিখে সরকারকে সাহায্য করতে বণ্ড নিয়ে নোট ছাপাতে রাজি বলে প্রস্তাব পাশ করেছে। যদিও ব্যাঙ্কের গর্ভনর এন্ড্রু বেইলি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করে গেছেন।[14]


    সবাই স্বাধীন এ বিপুল ভবে, ভারত শুধুই ঘুমায়ে রয়!


    তো সবাই এতসব করল, কিন্তু ভারত কি এতদিন শুধু সুবোধ বালক হয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে? আমাদের দেশ কখনও নোট ছাপানোর লোভে পড়েনি কালীদা?


    পড়েনি আবার! আমাদের সবই তো ব্রিটিশের কাছ থেকে নেওয়া। এই ডেফিসিট ফাইনান্স তত্ত্বের গুরুদেব হলেন ব্রিটেনের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন অর্থমন্ত্রী লর্ড জন মেনার্ড কেইন্স। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নেহেরুজি ভারতে মিশ্র অর্থনীতির ভিত তৈরি করতে কেমব্রিজ থেকে অধ্যাপক ক্যালডোরকে নিয়ে এলেন পরামর্শদাতা হিসেবে। ভারতের তৎকালীন করনীতি, সরকারের বাজেট পরিকল্পনা, সবেতেই অধ্যাপক ক্যালডোরের প্রভাব রয়েছে। আর উনি হলেন খাঁটি কেইন্সপন্থী, যারা মনে করেন অনুন্নত দেশের  বাজেট ঘাটতি সামলাতে ডেফিসিট ফাইনান্স বা দরকার মতো রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে দিয়ে নোট ছাপানো কোনও পাপ নয়, বরং উন্নয়নের হাতিয়ার।


    সেই গোড়া থেকেই সরকারের বাজেটের রাজকোষ ঘাটতি বা ফিস্ক্যাল ডেফিসিট ‘অটোমেটিক্যালি মানিটাইজড’ বা নোট ছাপিয়ে পূর্ণ হতে লাগল। কিন্তু 1991 সালে লাগাতার বছর বছর নোট ছাপানোর কুফল বিষফোড়ার মতো দেখা দিল মুদ্রাস্ফীতি বা ইনফ্লেশনের চেহারায়। ফলে 1994 সালে ড. মনমোহন সিংহ (প্রাক্তন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক গভর্নর এবং তৎকালীন অর্থমন্ত্রী) এবং সি রঙ্গরাজন (তৎকালীন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক গভর্নর) এই ‘অটোমেটিক্যালি’ ব্যাপারটাকে 1997 থেকে বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। আজ বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে এরাই কিন্তু ফিসক্যাল ডেফিসিটকে ‘মারো গোলি’ বলে নোট ছাপিয়ে বাজারে অতিরিক্ত টাকা জোগানোর এবং উন্নয়নমূলক কাজ চালিয়ে যাবার পরামর্শ দিচ্ছেন।[15]

     

    আরও পড়ুন

    লকডাউন অর্থনীতি 3: চলতি বছরের বাজেট

     

    তাহলে আজকে সরকার রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে সরাসরি নোট ছাপাতে বলছে না কেন?


    এই প্রশ্নে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে দুটো মত রয়েছে। 


    অর্থনীতিবিদ মিহির শর্মা বলেছেন– সরকারের কাছে যে টাকা নেই, তা খরচা করবে কেন?[16] এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর ডি সুব্বারাও সতর্ক করছেন, এখনও টাকা ছাপানোর অবস্থা হয়নি। ভারত সহজেই ইনফ্লেশনের ফাঁদে পড়ে যায়। সরকার জোর করে টাকা ছাপালে ইনফ্লেশনের সম্ভাবনা; রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যেভাবে অপ্রত্যক্ষ ভাবে ব্যাঙ্কের বন্ড কিনে টাকা জুগিয়ে, বা কম রেপো রেটে ওদের টাকা ধার দিয়ে যাচ্ছে, তাই ভাল।[17] 


    উনি এটাও বলেছেন যে, সরকারের এই রাজকোষ ঘাটতি যদি (এখন 3.5% থেকে 4.5% ) ফিসক্যাল রেসপন্সিবিলিটি অ্যান্ড বাজেট ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট (এফ আর বি এম) বেঁধে দেওয়া লক্ষণরেখা (জিডিপির 3%) ডিঙোয়, তাহলে বাজারে সরকারের আর্থিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে খারাপ রিপোর্ট কার্ড তৈরি হবে। করোনার জন্যে সরকারের আরও খরচ হবে, ফলে এই ঘাটতি আরও বেড়ে যাবে। তাই, এখন থেকে রাশ টেনে ধরতে হবে।  


    অন্যদিকে ভারতের প্রাক্তন আর্থিক উপদেষ্টা এবং বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রাক্তন মুখ্য অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু (বর্তমানে আন্তর্জাতিক ইকনমিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট) জানালেন যে, ওই আইনে দুটি উপধারা আছে, যাতে বিশেষ পরিস্থিতিতে (যেমন- প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাষ্ট্রীয় সংকট ইত্যাদি) লক্ষ্মণরেখা ডিঙোনোর নিদানও দেওয়া আছে। কোভিড-19 অবশ্যই অমন একটি পরিস্থিতি।


    উনি আরও বলেছেন যে, ভারত সরকারের মোট ডেট (ঋণ) জিডিপির 68% থেকে 69%। দেশ এখন 2 লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতি। তাই, এখনও আরও 10% ঋণ, মানে অর্থনীতির 80% পর্যন্ত বেড়ে গেলে চিন্তার কারণ নেই।[18]


    ইউরোপের দেশগুলো জিডিপি’র 80% থেকে 100% অবধি ধার করেছে। 


    রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর এবং বর্তমানে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রঘুরাম রাজন বলছেন, ঘাটতি মেটাতে হিসেব করে নোট ছাপালে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। অর্থব্যবস্থার স্বার্থে যা দরকার, তা খরচা করতে হবে। এতে অল্পদিনে কোনও ‘রান অ্যাওয়ে’ ইনফ্লেশন বা সর্বনেশে মুদ্রাস্ফীতি ঘটবে না। স্বল্প মেয়াদে অর্থনীতি বাগে এলে মিটিয়ে দিলেই হবে।[19]


    পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের চেয়ারম্যান এন.কে. সিং (যাঁর কমিটি 2003 সালে ওই লক্ষণরেখা বা এফআরবিএম আইন বানিয়েছিল) বলছেন এই মহামারীর ফলে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার ওই লক্ষণরেখা ডিঙোতেই পারে, তবে দুর্যোগ কেটে গেলে আবার আর্থিক শৃঙ্খলায় ফিরে আসলেই হবে।[20]


    কিন্তু ফিসক্যাল ডেফিসিট বা আর্থিক ঘাটতির বেড়া ডিঙোলে যে আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থাগুলো খারাপ রিপোর্ট দেবে! 


    রঘুরাম রাজন পাত্তা দিচ্ছেন না। সোজা সাপটা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নীতি নির্ধারকরা যদি  সমস্যার ঠিকমতো মোকাবিলা না করতে পারে তো সরকারের উচিত বিরোধীদের থেকে প্রতিভা ধার নেওয়া! খিদে মেটানো এবং কাজের ব্যবস্থা হল আশু সমস্যা। খালি শুকনো রেশন নয়, রান্নার তেল, মাথার উপরে ছাদ এবং হাতে নগদ টাকা দেওয়ার কথাও ভাবতে হবে।[21]

     

    আরও পড়ুন

    লকডাউন অর্থনীতি 4: মা যা হইয়াছেন


    অন্যমতের অর্থনীতিবিদদের টাকা ছাপানোয় আপত্তি ঠিক কোনখানে? তাঁরা মানছেন যে, মন্দার বাজারে যখন বেসরকারি চাহিদা ঢলে পড়েছে বা সুষুপ্ত অবস্থায় চলে গেছে, তখন তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা হিসেবে আর্থিক উদ্দীপনা জোগাতে এটি সরকারের চমৎকার হাতিয়ার।


    কিন্তু ভয় তারপর। সরকারের অভ্যেস খারাপ না হয়ে যায়। এই অবস্থা থেকে ফিরতে দেরি না হয়! যদি দু’পেগের পর টেবিল থেকে উঠে পড়ে বাড়ি ফিরে আসতে মন না চায়! তাহলে আগামী দিনে ভয়ঙ্কর মুদ্রাস্ফীতির বীজ পোঁতা হবে যে!


    সরকারের অবস্থা হল শ্যাম রাখি, না কূল রাখি! শেষে শ্যামের দিকেই ঢলে পড়ে ব্যয় সংকোচের সিদ্ধান্তকেই মেনে নিয়েছে। তাই ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করা ২০ লক্ষ কোটি টাকার যে রিলিফ প্যাকেজ, তাতে রাজকোষ থেকে বাস্তবিক খরচা 2.5 লক্ষ কোটির বেশি নয়। এবং এই লেখার সময় আজ কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করেছেন যে, করোনা প্যানডেমিকের ফলে উদ্ভূত আর্থিক সংকটের কারণে এ’বছর বাজেটে ঘোষিত সমস্ত নতুন প্রকল্প বাবদ খরচ একব ছরের জন্যে স্থগিত থাকবে। তবে, ভারত আত্মনির্ভর যোজনা (রিলিফ প্যাকেজ 2) এবং পিএম গরিব কল্যাণ যোজনা জারি থাকবে।


    [ডেফিসিট ফাইন্যান্সিং বা সাময়িক ধার করে অর্থব্যবস্থা পরিচালনা কি কোনও অন্ধগলি? অর্থশাস্ত্রের ইতিহাস এবং নীতি কী বলে? ভারত কোন দিকে হাঁটছে? এর আলোচনা আগামী কিস্তিতে।]  

     

    তথ্যসূত্র
    --------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------                       
    1. দি হিন্দু, 26 মার্চ, 2020
    2. ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, 14 নভেম্বর, 2016
    3. মিনিস্ট্রি অফ রেলওয়ের বিজ্ঞপ্তি ক্রমাঙ্ক ডিটিপি/2020/05/17 , তারিখ 2 মে, 2020
    4. ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, 28 মে, 2020
    5. ইকনমিক টাইমস, 14 এপ্রিল, 2020
    6. ইকনমিক টাইমস, 28 এপ্রিল, 2020
    7. ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, 2 জুন, 2020
    8. ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, 5 জুন, 2020
    9. ইকনমিক টাইমস, 9 মে, 2020
    10. টাইমস অফ ইন্ডিয়া, এবং বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, 23 মে, 2020
    11. নিউ ইয়র্ক টাইমস, মার্চ 28, 2020
    12. সিএনবিসি ডট কম, 8 মে, 2020
    13. মার্কেট ইন্সাইডার , 25 মার্চ, 2020 এবং বিবিসি নিউজ, 20 মার্চ, 2020
    14. ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, 25 এপ্রিল 2020; উদিত মিশ্রের প্রবন্ধ
    15. 24 এপ্রিল, 2020; ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
    16. মিহির শর্মা, দ্য প্রিন্ট, 21 মে,2020
    17. ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, 28 মে, 2020
    18. ইন্ডিয়া টুডে চ্যানেলে ইন্টারভিউ,1 মে, 2020
    19. বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, 8 মে, 2020
    20. ঐ; 21 মে, 2020
    21. ঐ; 21 মে , 2020


    রঞ্জন রায় - এর অন্যান্য লেখা


    চার-চারটে লকডাউনের পর এখন ‘লক ওপেন’-এর সময় ভারতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দু’লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে।

    সরকার আগে মন্দার কথা অস্বীকার করলেও লকডাউন তাকে চলতি বছরে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেবে!

    নীরব মোদী, মেহুল চোকসির মতো গুজরাতের স্বর্ণ ব্যব্যসায়ীদের কেচ্ছা তো সর্বজনবিদিত।

    আমরা দেখব যে সাভারকরের হিন্দুত্ব এবং আরএসএস-এর হিন্দুত্বের মধ্যে কী কী মিল এবং কোথায় অমিল।

    15 লাখ মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা অসমে

    আয়ুষ মন্ত্রক তাদের তিনটি ওষুধের প্যাকেজ দিব্য করোনিল, দিব্য শ্বাসারি বটি এবং দিব্য অনুতৈল-কে ‘প্রত

    লকডাউনে অর্থনীতি 5: কেউ কথা রাখেনি-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested