×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • লকডাউন অর্থনীতি 3: চলতি বছরের বাজেট

    রঞ্জন রায় | 30-05-2020



    করোনা মোকাবিলায় টাকা আসবে কোথা থেকে?


    আমরা, মধ্যবিত্তরা, প্রত্যেক মাসের শেষে আগামী মাসের জন্য পারিবারিক বাজেট বানাই। তাতে কত রোজগার, নানা খাতে কত করচ, কার কার ধার শোধ করতে হবে, কাকে এই মাসে না দিলেও চলবে, দরকার পড়লে কার থেকে নতুন করে ধার পাওয়া যাবে, এই সব বিবেচনা করি। একই ভাবে সরকার নতুন আর্থিক বছর শুরু হওয়ার দু’মাস আগে কত আমদানি / আয় হয়েছে বা হবে এবং কী কী খরচা আগের থেকে ঠিক করা আছে আর দেশের আর্থিক অবস্থা অনুযায়ী নতুন কী করা উচিত সেটা ভেবে বাজেট বানায় এবং রসদে টান পড়লে ধার নেয়।


    বাজেটের সংক্ষিপ্ত চেহারায় চারটে জিনিস থাকবে (আয়ের মধ্যে পুঁজিগত আয় এবং রাজস্ব আয়। ব্যয়ের মধ্যে পুঁজিগত ব্যয় এবং রাজস্ব ব্যয়):
    ক্যাপিটাল রিসিট বা পুঁজিগত আয় = কোনও পুঁজি নিবেশ থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ ও সুদ এবং সরকারের ঋণ ও বিদেশি পুঁজি নিবেশ।


    রেভিনিউ রিসিট বা রাজস্ব আয় = প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ কর (তাতে কেবল কেন্দ্রীয় সরকারের অংশটুকু) + কর ছাড়া অন্য খাতে আমদানি।


    পুঁজিগত ব্যয় (ক্যাপিটাল এক্সপেন্ডিচার) = সরকারের যে খরচা শুধু স্থায়ী সম্পত্তি নির্মাণে খরচ হবে। রাস্তা নির্মাণ, রেললাইন এবং নতুন রেলগাড়ির ইঞ্জিন ও কোচ এবং নতুন স্টেশন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের সংযন্ত্র স্থাপন, হাসপাতাল, গবেষণা কেন্দ্রের ভবন এবং মেশিনারি কেনা, অথবা প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য ট্যাঙ্ক, বিমান, মিসাইল, জাহাজ কেনা ইত্যাদি।


    রাজস্ব ব্যয় (রেভিনিউ এক্সপেন্ডিচার) = যা দিয়ে কোনও সম্পত্তি নির্মাণ হবে না, কিন্তু যে খরচা প্রশাসন এবং আর্থিক উৎপাদন চক্র চালু রাখতে আবশ্যক। যেমন মন্ত্রী—সাংসদ থেকে শুরু করে সরকারি কর্মচারী সকলের মাইনে; খাদ্য, বিদ্যুৎ, কৃষিতে ভর্তুকি ইত্যাদি।


    বাজেটের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সূচক হল রাজকোষীয় ঘাটতি বা ফিস্কাল ডেফিসিট। এটি হল বাজেটে সরকারের সমগ্র ব্যয় যদি সমগ্র আয়ের থেকে বেশি থাকে তাহলে সমগ্র ব্যয় থেকে সরকারের ঋণ ছেড়ে বাকি মোট আয় বিয়োগ করলে যা থাকে। এটি মাপা হয় জিডিপি’র শতাংশ হিসেবে। অর্থাৎ সূচকটি ইঙ্গিত দেয় আর্থিক স্থিতি কতটা সরকারের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে বা কতটা আগামী দিনে চিন্তার কারণ হতে পারে।
    এই বছরের
    (2020-21) কেন্দ্রীয় বাজেটের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্কগুলি ছিল এই রকম:

     

       

    (কোটি টাকায়)

    1. 

    রাজস্ব প্রাপ্তি

    20, 20, 926

    1.1 

    যার মধ্যে কর থেকে আমদানি                                

    (শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের অংশ)

    16, 35, 909

    1.2                                                  

    অন্য স্রোত থেকে

    3, 85, 017

    2. 

    পুঁজিগত প্রাপ্তি                                                   

    10, 21, 304

    2.1                                             

    যার মধ্যে, ঋণ আদায়

    14, 969

    2.2                                                      

    অন্য প্রাপ্তি

    2, 10, 000

    2.3 

    সরকারি ঋণ  থেকে পাওয়া যাবে                            

    (এর মধ্যে বিদেশি ঋণ 4621.65 কোটি) 

    7, 96, 337

    3. 

    সরকারের মোট প্রাপ্তি (1+2)                           

    30, 42, 230

    4. 

    সরকারের মোট ব্যয় (4.1+ 4.2)                         

    30, 42, 230

    4.1  

    যার মধ্যে, রাজস্ব খাতে                             

    26, 30, 144

    4.2  

    পুঁজি খাতে                                                             

    4, 12, 085  

    5. 

    তাহলে রাজস্ব ঘাটতি বা রেভিনিউ ডেফিসিট (4.1-1)

    6,09,219

    (2.7 শতাংশ)*

    6. 

    রাজকোষীয় ঘাটতি বা ফিস্কাল ডেফিসিট [4-(2.1+2.2)] **  

    7,96,337

    (3.5 শতাংশ)*

     

    * বন্ধনীর মধ্যে জিডিপি’র শতাংশ দেখানো হয়েছে।
    **হরে-দরে ফিসক্যাল ডেফিসিট সরকারকে বাজেটের খরচা পূরণ করতে কত ধার করতে হবে তার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
    ***খেয়াল করুন; বিদেশি ঋণ মাত্র
    4621.65 কোটি টাকা। অতীতে প্রতি ভারতের নাগরিকের ঘাড়ের উপর বিদেশি ঋণের বিরাট বোঝা চেপে আছে বলে যে জুজুর ভয় দেখতাম তা আজ অনেকটাই অমূলক মনে হয়। [1]

     

    এই স্বল্প পরিসরে বাজেটের কিছু ব্যয়-বরাদ্দ একনজরে দেখা যাক। বর্ষ 2020-21 আর্থিক বছরের জন্য বাজেটের ব্যয়-বরাদ্দ হল 30,42,230 কোটি টাকা বা 30.42 লক্ষ কোটি টাকা।

     

    আরও পড়ুন

    লকডাউন অর্থনীতি 1: কার রিলিফ বিশ লক্ষ কোটি টাকায়?



    স্বাস্থ্য ক্ষেত্র:
    ভারতে স্বাস্থ্যখাতে সরকারি ব্যয়
    2019-20 সালে ছিল জিডিপির 1.28 শতাংশ, যেখানে বিশ্বের গড় খরচ হল জিডিপির 6 শতাংশ; এমনকি এশিয়ার গরীব দেশগুলো, যেমন নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া বা থাইল্যান্ড এর চেয়ে বেশি খরচ করে। ওদের গড় জিডিপির 1.57 শতাংশ। অন্য কিছু দেশের এই খাতে খরচের উদাহরণ হল, জাপান (9.2 শতাংশ), ব্রাজিল (3.9 শতাংশ), চিন (2.9 শতাংশ)।[2] 

    ’বছর পাবলিক হেলথ কেয়ারে বাজেট বরাদ্দ 1.9 শতাংশ যার বড় অংশ প্রধানমন্ত্রীর আয়ুষ্মান ভারত যোজনায়, যা একটি স্বাস্থ্যবিমা যোজনা যাতে গরিব মানুষ প্রাইভেট হাসপাতালে গিয়ে বিনামূল্যে দামি চিকিৎসা করাতে পারে। কিন্তু নতুন সরকারি হাসপাতাল খুলে স্বাস্থ্য পরিষেবাকে আরও প্রসারিত করার কাজ কিছুই হয়নি।


    সরকার ঘোষণা করেছিলেন আগামী 2025 নাগাদ জনসাধারণের জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবায় সরকারি বরাদ্দ বেড়ে জিডিপি-র 2.5 শতাংশ হবে, যদিও এমনকি তাও বিশেষজ্ঞদের মতে অপর্যাপ্ত।[3] ভারতের স্বাস্থব্যবস্থা এখন অনেকটাই প্রাইভেট সেক্টর এবং স্বাস্থ্যবিমা নির্ভর। তাই বরাদ্দও গত বছরের তুলনায় 10 শতাংশ বেড়ে মাত্র 69,000 কোটি হয়েছে। কিন্তু ডিসেম্বর 2019-এ মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল 7.5 শতাংশ; তাই এতে আমরা 2011 সালে প্ল্যানিং কমিশনের নির্ধারিত লক্ষ্য অর্থাৎ জিডিপি’র 2.5 শতাংশ বরাদ্দ থেকে দূরেই রয়ে গেলাম।[4] 


    কৃষি ক্ষেত্র:
    গত কয়েকবছর ধরেই কৃষি সঙ্কটের মুখে। উৎপাদন ব্যয় বেড়ে চলেছে কিন্তু বাজারে কৃষকেরা পণ্যের যে দাম পাচ্ছেন তাতে খরচা পোষাচ্ছে না। কথা ছিল সরকার বড় ফসলগুলির সমর্থন মূল্য (সাপোর্ট প্রাইস বা যে দামে সরকারি কৃষি আড়ত এবং ফুড করপোরেশন অফ ইন্ডিয়া কেনে) স্বামীনাথন কমিটির রিপোর্ট মেনে উৎপাদন ব্যয়ের
    150 শতাংশ বা দেড়গুণ করে দেবে। সরকার যা করল তাতে কৃষকেরা খুশি হলেন না। কৃষকদের মতে যে ফর্মূলায় উৎপাদন ব্যয় হিসেব করা হয়েছে সেটাই ভুল। তাই 2017 থেকে নিয়মিত কৃষকদের বিক্ষোভ প্রদর্শন আমরা খবরে দেখেছি। রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, তামিলনাড়ু কেউ বাদ যায়নি। 


    যদিও ভারতের জিডিপিতে কৃষিক্ষেত্রের অবদান 16 শতাংশ, তবু সবচেয়ে বেশি কাজ জোগায় কৃষিক্ষেত্র। 2019 সালের হিসেবে এখনও জনসংখ্যার 43.25 শতাংশ কৃষিকাজে নিযুক্ত।[5] 


    এই বাজেটে অর্থমন্ত্রী কৃষকের আয় দ্বিগুণ করার লক্ষ্যে 16 দফা অ্যাকশন প্ল্যান দিয়েছেন। কিন্তু কৃষি উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ মাত্র 3 শতাংশ বাড়িয়ে 1.43 লক্ষ কোটি বা 1.43 ট্রিলিয়ন করেছেন। এর মধ্যে মুখ্য হল পিএম-কিসান যোজনা খাতে 75,000 কোটি টাকা, যাতে সব কৃষক বছরে তিন কিস্তিতে মোট 6000 টাকা পাবে। এর বরাদ্দ গত বছরের মতোই রয়েছে। [6]  আর রয়েছে প্রধানমন্ত্রী ফসল বীমা যোজনায় 15,695 কোটি টাকা। বিশেষ বরাদ্দ হল কৃষকদের জন্য পেনশন যোজনায় 220 কোটি টাকা।[7] 

    শিল্প ক্ষেত্র:
    আগেই বলেছি যে শিল্প, বিশেষ করে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প, এখন এক বিশ্বজোড়া সঙ্কটের মধ্য দিয়ে চলছে। ইদানীং উপভোগ বস্তুর চাহিদা বিস্ময়কর ভাবে কমে যাওয়ায়— মোটরগাড়ি হোক কী পার্লে বিস্কুট— এবং ফ্রড ও অনাদায়ী লোনে বিপর্যস্ত ব্যাঙ্কের লোন দিতে অনীহা ভারতে সমস্যাকে আরও তীব্রতর করেছে।


    জিডিপিতে শিল্পক্ষেত্রের অবদান 31 শতাংশ এবং এতে নিযুক্ত জনসংখ্যার  24.89 শতাংশ।[8] শিল্প এবং বাণিজ্য বিভাগের জন্য বরাদ্দ হয়েছে 27300 কোটি।

     

    আরও পড়ুন

    লকডাউন অর্থনীতি 2. মা যা ছিলেন

     

    সার্ভিস বা পরিষেবা ক্ষেত্র:
    ভারতের অর্থনীতিতে পরিষেবা বা টার্শিয়ারি সেক্টরের অবদান সবচেয়ে বেশি। জিডিপি’র সিংহভাগ, 53 শতাংশ আসে এই ক্ষেত্র থেকে। জনসংখ্যার প্রায় 32 শতাংশ এই সেক্টরে কাজ করে। ভারতে 2017-18 সালে চালু হওয়া জিএসটি বা গুডস অ্যান্ড সার্ভিস ট্যাক্স ক্রমাগতঃ ধারা-উপধারায় পরিবর্তন, কিছু অস্বচ্ছ্বতা এবং ডিজিটাল নেটওয়ার্কের সমস্যার ফলে এই সেক্টরের সমস্যা বেড়েছে।[9] 


    বাজেটে জিএসটি স্ল্যাবে কিছু পরিবর্তন, লভ্যাংশের পর ট্যাক্স এবং নতুন স্টার্ট আপ, রপ্তানি ইত্যাদির জন্য আংশিক ছাড়ের ঘোষণা করা হয়েছে।[10] 

    এম এস এম ই ক্ষেত্র:
    এবার বিশেষভাবে বলতে হবে এম এস এম ই বা মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম ইন্ডাস্ট্রিজ নিয়ে যা সবচেয়ে সঙ্কটগ্রস্ত। শিল্পের এই অংশ গাঁয়ে বেশি, এবং বেশিরভাগই পারিবারিক শ্রমে সামান্য পুঁজি ও নামমাত্র মুনাফায় চলে। অনেক ক্ষেত্রেই এরা বড় শিল্পের অনুষঙ্গী ইউনিট বা ছোট ছোট যন্ত্রাংশ বানিয়ে জোগান দেওয়ার কাজ করে। কিন্তু এদের সংখ্যা 63.4 মিলিয়ন ইউনিট। শিল্প উৎপাদনের ক্ষেত্রে 45 শতাংশ এবং পরিষেবার ক্ষেত্রে 40 শতাংশ এদের অবদান। শিল্প এবং পরিষেবা ক্ষেত্রের 80 শতাংশ কাজ এবং শ্রমিকদের 25 শতাংশ এই ক্ষেত্র থেকে আসে।


    এদের অবদান জিডিপির 29.7 শতাংশ এবং রপ্তানির 49.66 শতাংশ বা সিংহভাগ। অথচ এরা ব্যাঙ্ক থেকে প্রত্যক্ষভাবে লোন পায় খুব কম। এদের বেশির ভাগ টাকা জোগায় এন বি এফ সি (নন-ব্যাঙ্কিং ফিনান্সিয়াল কর্পোরেশন) যারা নিজেরাই এখন সঙ্কটে ধুঁকছে। ব্যাঙ্কের পাওনা চোকাতে পারছে না।[11] 


    এবারের বাজেটে এম এস এম ই বা মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম ইন্ডাস্ট্রিজ- এর বরাদ্দ গতবারের চেয়ে 8 শতাংশ বেড়ে 7572 কোটি টাকা হয়েছে। কিন্তু খুঁটিয়ে দেখলে চোখে পড়ে যে মোট বরাদ্দ বাড়লেও অনেকগুলো উপখাতে বরাদ্দ আগের থেকে কমেছে; যেমন ব্যাজ অনুদান পাত্রতা যোজনায় বরাদ্দ 31 কোটির বদলে এবার শূন্য।[12]  

    টাকা জোগাবে কে? কোথায় গৌরী সেন? এই বাজেটে ভারত সরকারের সামনে সব চেয়ে বড় সমস্যা ছিল শিল্পে মন্দা, ব্যাঙ্কের ক্রমাগত বেড়ে চলা এনপিএ বা অনাদায়ী লোন এবং কৃষকদের অসন্তোষ (ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়ার কারণে)। এই প্রেক্ষাপটে 2020-21 এর বাজেট হল 1 ফেব্রুয়ারি, কেরালায় 30 জানুয়ারি ভারতের প্রথম করোনা কেস ধরা পড়ার দু দিনের মাথায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ওই তারিখেই করোনাকে বিশ্বস্তরে পাবলিক হেলথ এমার্জেন্সি ঘোষণা করেছে।[13] তাই এসব সামলাতে সরকারকে পুরনো এবং নতুন খাতেঅনেক টাকা খরচ করতে হবে। টাকা কোথায়? 


    একনজরে চোখে পড়ছে সরকারের আয়ের চেয়ে প্রস্তাবিত ব্যয় বেশি, তাই  ঘাটতির বাজেট। মানে সরকারের ভাঁড়ারে টান পড়েছে। আয়কর সম্পত্তি কর প্রভৃতি প্রত্যক্ষ কর এবং জিএসটি প্রভৃতি অপ্রত্যক্ষ কর সব মিলিয়ে কর আদায় আশার অনুপাতে বেশ কম। অন্তত 7.5 লক্ষ কোটি টাকা জোগাড় করা দরকার। কীভাবে?


    আমাদের দেশে তো জন্ম থেকে ঘাটতি বাজেটই শুনে আসছি। তবে অর্থমন্ত্রী বলেছেন যে গতবারে ফিস্ক্যাল ডেফিসিট জিডিপির 3 শতাংশতে ধরে রাখার কথা ছিল, অথচ কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি জনকল্যাণকারী যোজনাতে খরচ বেড়ে যাওয়ার ফলে সেটা 3.8 শতাংশ হয়ে গেছে। কিন্তু এ’বছর রাজস্ব বাড়িয়ে সরকারি খরচে নিয়ন্ত্রণ রেখে ওই ডেফিসিট বা ঘাটতি 3.5 শতাংশ রাখা হয়েছে এবং খবরের কাগজে ও বিভিন্ন চ্যানেলে লোকে ধন্য ধন্য করছে। 


    ফিস্কাল ডেফিসিট বেঁধে রাখার মানেটা কী?
    এ নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে দু'রকম কথা আছে। একদল মনে করেন সরকারের ধার একটা সীমার মধ্যে থাকা উচিত। উন্নয়নের নামে ধারের পর ধার করা কোনও কাজের কথা নয়। তাই ভারতের ক্ষেত্রে রাজকোষীয় ঘাটতি
    3 শতাংশের ধারে কাছেই থাকা উচিত। তাই তাঁরা প্রশংসা করছেন সরকার খরচ বাড়িয়ে এই ঘাটতি 4 শতাংশের উপরে যেতে দেবে না বলে। বিশেষ করে আন্তার্জাতিক রেটিং সংস্থাগুলোর এই ভাবনা খুব পছন্দ। এই 3 বা 4 শতাংশের মধ্যে রাজকোষীয় ঘাটতিকে বেঁধে রাখলে মোক্ষপ্রাপ্তি হবে এটা কে ঠিক করেছে? করেছে উন্নত অর্থনীতির আন্তর্জাতিক বাজার এবং ওই রেটিং সংস্থাগুলো। বলা যেতে পারে এটা হল বিশ্বায়নের একটি প্রতিফল।


    কিন্তু সম্প্রতি নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জি, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন তথা অমর্ত্য সেন, এই সময়ে বাজারে চাহিদা বাড়াতে সরকারের উন্নয়ন ব্যয়, বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং কাজ খোয়ানো মানুষের হাতে টাকা দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করছেন। তাতে সরকারকে যদি ধার করতে হয় বা টাকা ছাপাতে হয় তাই সই।


    2003 সালে অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিনহার সময়ে সংসদে ফিসক্যাল রেসপন্সিবিলিটি অ্যান্ড বাজেট ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট (এফ আর বি এম) নামে একটি আইন পাশ হয়। এর উদ্দেশ্য আর্থিক অনুশাসন এবং পাবলিক ফান্ড ম্যানেজমেন্টে উন্নতির মাধ্যমে ক্রমশ ব্যালান্সড বাজেটের দিকে এগিয়ে যাওয়া। এই আইন অনুযায়ী বর্তমানে ভারতে ঘাটতি জিডিপি’র 3 শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়। এটাই রাজ্যগুলির ঘাটতি মিলিয়ে 6 শতাংশ যেতে পারে, ওটাই লক্ষ্মণরেখা। [14] কিন্তু ওই আইনে দুটি উপধারা আছে যাতে বিশেষ পরিস্থিতিতে (যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাষ্ট্রীয় সঙ্কট ইত্যাদি) লক্ষ্মণরেখা ডিঙোনোর নিদানও দেওয়া আছে। [15] COVID-19 অবশ্যই অমন একটি পরিস্থিতি।


    করোনাজনিত বিশেষ পরিস্থিতিতে রাজকোষ ঘাটতি মেটাতে সরকার কী কী করতে পারে?
    জনতার উপর নতুন ট্যাক্স চাপাতে পারে, যেমন এখন যদি করোনা সেস চাপায় তাহলে সরকারের কিছু আয় বাড়বে। কিন্তু দেশের এই অবস্থায় যখন করোনার চোটে কাজকর্ম বন্ধ, লোকের মাইনে কমছে, ইনফর্মাল সেক্টরে কাজ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ট্যুরিজম-হস্পিটালিটি মার খাচ্ছে, কোর ইন্ডাস্ট্রিতে উৎপাদন কমছে, তখন নতুন ট্যাক্স বসিয়ে খুব একটা লাভ হবে না। জিএসটি এবং আয়কর আদায় কমে গেছে।
     


    অন্য রাস্তা হচ্ছে বাজারে সরকারি বন্ড বা ঋণপত্র ছেড়ে টাকা তোলা। কিন্তু লোকের সেভিংস কমে গেছে, আয় কমছে, বন্ড কিনবে কে? অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন এবারের বাজেটে আন্তর্জাতিক বাজারে সরকারি বন্ড ছাড়ার কথা ভেবেছিলেন। এছাড়া বিদেশি পুঁজির ক্ষেত্রে 31 মার্চ 2024- এর আগে পরিকাঠামো এবং কিছু নির্দিষ্ট সেক্টরে বিনিয়োগ করলে সুদ ও লাভের (ডিভিডেন্ডের) উপর ট্যাক্সের ক্ষেত্রে 100 শতাংশ ছাড় দেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছেন।[16] তবে সময়টা খারাপ- বিশ্ব বাজারেও মন্দা চলছে।


    তৃতীয় একটি পথ হল ব্যাঙ্কের কাছে বন্ড রেখে ধার নেওয়া। এটাও মুশকিল। সরকারি ব্যাঙ্কের স্বাস্থ্য ভাল নয়। এন পি এ বাড়ছে, বড় বড় ব্যবসায়ীরা লোন পরিশোধ করছে না। বেশ কিছু বিদেশে পালিয়েছে। ফ্রড / ঘোটালা / ধোঁকাবাজির ঘটনা একের পর এক সামনে আসছে। ফলে এই বন্ডে সুদের হার বেশি, অন্তত 6 শতাংশ না হলে ব্যাঙ্কগুলো কিনবে কেন? এদিকে গত বছরই বাজেটের ঘাটতি মেটাতে সরকার রিজার্ভ ব্যাঙ্কের "ডিভিডেন্ড অ্যান্ড সারপ্লাস রিজার্ভ ফান্ড'' থেকে 1.76 লাখ কোটি টাকা বা 1.76 ট্রিলিয়ন নিয়ে নিয়েছে। স্বাধীনতার পর এই প্রথম কোনও কেন্দ্রীয় সরকার এমন পদক্ষেপ নিল, যা নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে।[17]  

    টাকা জোগাড়ের চতুর্থ পথটি হল বিলগ্নীকরণ (ডিস-ইনভেস্টমেন্ট)। অর্থাৎ সরকারি সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা তোলা। এটা গত কয়েক বছর ধরেই সরকারবাহাদুর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যেমন এয়ার ইন্ডিয়া, যেমন ভারত এবং মহানগর টেলিফোন (বিএসএনএল, এমটিএনএল ইত্যাদির জমি, বাড়ি) এবং এ’বছর বাজেটে যুক্ত হয়েছে জীবন বিমা কোম্পানির একটু শেয়ার বেচার পরিকল্পনা। কিন্তু বাজার খারাপ, কেনার লোক জুটছে না। যেমন এয়ার ইন্ডিয়ার জন্য প্রতিবার নতুন করে লাভজনক শর্তে টেন্ডার হচ্ছে। কিন্তু অবস্থাটা হল ‘আমারে কে নিবি ভাই বিকাতে চাই আপনারে’। এ নিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রভাত পটনায়েক বলেছেন, এই সরকার পাবলিক সেক্টরের গুরুত্ব না বুঝে একে অল্প দামে বেচে ওই ফিসক্যাল ডেফিসিটকে কম দেখিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে নাম কিনতে চাইছে। কারণ উন্নত দেশের অর্থনীতিতে এটাই বাজেটের একটি বিশেষ গুণ বলে ধরা হয়। পটনায়েকের প্রশ্ন যদি প্রাইভেট সেক্টর এয়ার ইন্ডিয়া ইত্যাদি কিনে লাভজনক সংস্থা হিসেবে এদের ভোল পাল্টাতে পারে তো সরকার কেন সেটা করতে পারবে না?[18] 


    পাঁচ নম্বর একটি পথও আছে সরকারের সামনে। তা হল নোট ছাপানো। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে অল্পকালীন ট্রেজারি বিল বা সরকারি বন্ড গচ্ছিত রেখে নতুন ছাপানো নোট নেওয়া। আর সেই নোট দিয়ে এই মন্দা এবং কর্মহীনতার বাজারে গরিবের হাতে সেই নোট গুঁজে দেওয়া। মানুষ খেয়ে পরে বাঁচবে। তাই সেই পয়সা দিয়ে খাবার, জামাকাপড়, ওষুধপত্র কিনবে। বাজারে এই সব জিনিসের চাহিদা বাড়বে। ফলে চাহিদা মেটাতে জোগান বাড়বে, অর্থাৎ উৎপাদন বাড়বে, লোকের কর্মসংস্থান হবে। অভিজিৎবাবু এবং রঘুরাম রাজনদের এটাই বক্তব্য।

    এই টাকা ছাপিয়ে দেশ চালানো নিয়ে ইকনমিস্টদের মধ্যে সোজাসুজি দুটো মত বা দুটো দল। এটা বোঝার জন্য দরকার ধার করে দেশ চালানো বা ডেফিসিট ফাইন্যান্সিং নামক শাস্ত্রটিকে বোঝা এবং মহাজনরা কী বলে গেছেন তা শোনা জরুরি। করোনা মহামারীর সময় রিলিফ জোগাতে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক আলোচনা। এই নিয়ে আগামী কিস্তিতে বিশদে আলোচনা হবে।

    (চলবে)


    তথ্যসূত্র
    ---------------------------------------------------------------------------------
    1.
     ভারত সরকারের বিত্তমন্ত্রকের পোর্টালে বাজেটের বিস্তারিত বিবরণ।
    2.  লাইভমিন্ট, 8 এপ্রিল, 2020
    3.  ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, 19 নভেম্বর, 2019
    4.  অশোকান, সেক্রেটারি আই এম এ, ডাউন টু আর্থ- কে দেওয়া ইন্টারভিউ, 2 ফেব্রুয়ারি, 2020
    5.  ওয়ার্ল্ড ইকনমিক লীগ টেবিল; 3 জানুয়ারি, 2020
    6.  দ্য প্রিন্ট, 1 ফেব্রুয়ারি, 2020
    7.  ইকনমিক টাইমস, 2 ফেব্রুয়ারি, 2020
    8.  
    9.  এইচ প্লেশার, স্ট্যাটিসটিকা; 27 জানুয়ারি, 2020
    10. ভারত সরকারের বিত্তমন্ত্রকের পোর্টালে বাজেটের বিস্তারিত বিবরণ।
    11. বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, 2 ডিসেম্বর, 2019 
    12. ইকনমিক টাইমস, 2 ফেব্রুয়ারি, 2020
    13. ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশন পোর্টাল।
    14. এফ আর বি এম অ্যাক্ট, 2003
    15. কৌশিক বসুর ইন্টারভিউ, ইন্ডিয়া টুডে চ্যানেল, 1 মে, 2020
    16. বাজেট প্রেস নোট (2020-21), ভারত সরকারের বিত্তমন্ত্রক পোর্টাল।
    17. পিটিআই এবং ইকনমিক টাইমস, 27অগাস্ট, 2019
    18. প্রভাত পটনায়েক, পিপলস ডেমোক্রেসি, 15 ডিসেম্বর, 2019

     


    রঞ্জন রায় - এর অন্যান্য লেখা


    আয়ুষ মন্ত্রক তাদের তিনটি ওষুধের প্যাকেজ দিব্য করোনিল, দিব্য শ্বাসারি বটি এবং দিব্য অনুতৈল-কে ‘প্রত

    সাভারকর কি “কুইট ইন্ডিয়া” আন্দোলনের বিরোধিতা করে ব্রিটিশের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন?

    সেরা ভোজনরসিক না বুঝলেও মাংসের হালাল ঝটকা বিচারে নেমেছে দিল্লি পুরসভা

    কৃষি বিল নিয়ে সরকারি আশ্বাসে ভরসা রাখতে পারছেন না কৃষকরা।

    বাঙালির মতোই আবশ্যিক আমিষাশী বাঙালির কালী স্বাধীন পুরুষ নিরপেক্ষ এমনকী মদ্যপায়ী, যে সমাজ মেয়েদের পায়

    করোনা মোকাবিলায় টাকা আসবে কোথা থেকে?

    লকডাউন অর্থনীতি 3: চলতি বছরের বাজেট-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested