×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • লকডাউন অর্থনীতি 4: মা যা হইয়াছেন

    রঞ্জন রায় | 02-06-2020

    রিলিফ প্যাকেজ এবং কার টাকা কে জোগায়?

     

    গত 29 মে ভারত সরকারের ‘মিনিস্ট্রি অফ স্ট্যাটিসটিক্স অ্যান্ড প্রোগ্রাম ইমপ্লিমেন্টেশন’ (এমওএসআইপি) ঘোষণা করেছে যে, 2019-20 তে ভারতের অর্থনীতি বেড়েছে 4.2% হারে। জিডিপি বৃদ্ধির এই হার গত কয়েক বছরের মধ্যে নিম্নতম[1] লকডাউন শুরু হয়েছে মার্চের 24 তারিখ। স্পষ্টত, ওই এক সপ্তাহে অর্থনীতির বৃদ্ধি পূর্বাভাসের অর্ধেক হতে পারে না। অর্থাৎ, সরকার আগে মন্দার কথা জোর গলায় অস্বীকার করলেও লুকোনো ঘা এখন ফুটে উঠেছে। করোনাজনিত লকডাউন তাকে চলতি বছরে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেবে মাত্র

     

    যদি লকডাউনের ফলে ঘর থেকে বেরোনো, রেল-বাস-মোটর-উড়োজাহাজ, সবই বন্ধ থাকে, অফিস কারখানায় তালা পড়ে, দোকান-রেস্তরাঁ-হোটেলে খদ্দের আসা কমে যায়, সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করতে হবে বলে সিনেমা-থিয়েটার-শপিং মল-পার্ক সবই বন্ধ হয়, তাহলে যা হবার তাই হয়েছে। সকল বাণিজ্য ক্ষেত্রে রাজস্বে টান পড়েছে। ফলে প্রধানমন্ত্রী যতই বলুন, কারও যেন চাকরি না যায়, সেই সদিচ্ছার বাষ্প বাস্তবের কড়া রোদ্দুরে শুকিয়ে যায়। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে কগনিজ্যান্ট থেকে পাড়ার চায়ের দোকান, বা মোটরবাইকে খাবার পৌঁছানো সুইগি/জোম্যাটোর ছেলেরা, মলে ইউনিফর্ম পরে মাল গুছিয়ে দেওয়া, বিল বানানো বা ফ্লোর পরিষ্কার করার ছেলেমেয়েরা—সবার কপাল পুড়ল। কারণ, দেশের শ্রমশক্তির 90% মানুষ হলেন অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক, যাদের নিয়োগপত্র, স্টাফ রুল বা শ্রম আইনের কোনও রক্ষাকবচ নেই

     

    আরও পড়ুন

    লকডাউন অর্থনীতি 1: কার রিলিফ বিশ লক্ষ কোটি টাকায়?

     

    বেকারত্বের হার এবং চিত্র

    ‘সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি’ একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা, যারা প্রতি সপ্তাহে ভারতের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলি প্রকাশিত করে। ওদের হিসেবে লকডাউন শুরু হওয়ার সময় এই দর ছিল 8.8%; পরবর্তী আট সপ্তাহে, ধরুন 24মে তারিখে এই সংখ্যাটি হল 24.2%[2] অন্তত  2.70 কোটি তরুণ (20-30 বয়সের) এপ্রিল মাসেই কাজ হারিয়েছেন[3] এবং এপ্রিলে মোট কাজ হারানো মানুষের সংখ্যা 12.2 কোটির কম নয়[4]

     

    এদের কারও কাছে টাকা নেই

    পনেরো বছর আগে বাবার হাত ধরে বিহার থেকে কলকাতায় আসা সুরজ থাকেন সল্টলেকের খাল পাড়ে একটি ঝুপড়িতে। সেখানেই একটি ঠেলাগাড়ির ওপর গরম কয়লার সেকেলে ইস্তিরি দিয়ে কাপড় ইস্ত্রি করে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়ে নগদ পয়সা পান। আজ দু’মাস হল কোনও কাজ নেই, হাতে পয়সা নেই। কারণ, কেউ ঘর থেকে বেরোচ্ছে না, তাই কাপড় ইস্ত্রিও করাচ্ছে না। একই অবস্থা বাঙ্গুরের কলমিস্ত্রি কালীপদর বা গল্ফগ্রিনের ইলেকট্রিক মিস্ত্রি নিরঞ্জনের। কেউ ডাকে না। কোনও আবাসনে ঢুকতে মানা

     

    নাকতলার সেকেন্ড স্কিমের সুবলচন্দ্র দু’পুরুষের নাপিত। দু’মাস হল দোকানের ঝাঁপ খোলা নিষেধ। বাঁশদ্রোণীর বিরজু মুচির আদিবাড়ি ঝাড়খন্ডে। ফুটপাথের এক কোণে বসে জুতোয় পেরেক ঠোকেন, সুখতলা পালটে দেন। ছাতু আর জল খেয়ে পেট ভরালেও ঘরে কী মানিঅর্ডার করবেন? এসি-র মিস্ত্রি রহমান মার্চের শুরু থেকেই ব্যস্ত থাকেন। মোবাইলে ফোন আসতে থাকে। ঘরে ঘরে এসি মেরামত, গ্যাস ভরা এবং কোথাও নতুন মেশিন ফিট করা। এই সাতটা মাসের রোজগার থেকে গোটা বছরের খরচা চলে। আজ মোবাইল রিচার্জ করাই সমস্যা। সোনারপুরের গৌরী আগে বিউটি পার্লারে কাজ করতেন। এখন মোবাইলে ডাক পেলে ঘরে গিয়ে বাড়ির মেয়ে ও বৌদিদের ফেসিয়াল, হেয়ার ট্রিটমেন্ট ও পেডিকিওর করেন। দু’মাস হল কোনও রোজগার নেই

     

    ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির কাছের পাড়া থেকে স্মৃতি আসেন আমহার্স্ট স্ট্রিটের একটি সেলুনে। সেখানে উনি গ্রাহকদের ছ থেকে আট ঘন্টা মালিশ করেন। সপ্তাহে পাঁচ দিন। প্রতিদিন হাজার বারোশো আয় হয়। তাতে চারজনের সংসার চলে। এখন ঘরেই থাকেন

     

    এরা কেউ ভিখিরি নন। সবাই কাজ করে সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকতে চান। কিন্তু এই অকালবৈশাখী, তৈরি হবার সময় দেয়নি। এক রাত্তির আটটায় মাত্র চার ঘন্টার নোটিশে আছড়ে পড়েছে। এদের সঞ্চয় নেই। হাতে নগদ টাকা চাই; কে দেবে? সরকার

     

    আরও পড়ুন

    লকডাউন অর্থনীতি 2. মা যা ছিলেন

     

    সরকার কেন?  কেন নয়? ‘জিভ দিয়েছেন যিনি, আহার দেবেন তিনি। যখন দেশের স্বার্থে উনি আমাদের ঘরে বন্ধ করেছেন, তো খাবার দেবেন না? উনি যে আমাদের বিপত্তারণ মধুসূদন দাদা! ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ।

     

    এই গল্প দিল্লির, গুরগাঁওয়ের, মুম্বাই, চেন্নাই , বেঙ্গালুরু এবং সমস্ত মহানগর ও শিল্পনগরীর। প্রশ্ন উঠতে পারে, সরকার কোথা থেকে সবাইকে সাহায্য করবে?

     

    সরকারের কি টাকার গাছ আছে?

    দেশের উন্নয়নের এবং সর্বাঙ্গীণ বিকাশের জন্যে সরকার খরচ করে। টাকা আসে মূলত আয়কর, সম্পত্তি কর ইত্যাদি প্রত্যক্ষ কর এবং জিএসটি (পণ্য এবং পরিষেবা কর) ইত্যাদি থেকে। কম পড়লে? বাজারে বন্ড ছেড়ে বা ব্যাঙ্কের কাছে বেশি সুদে বন্ড বিক্রি করে। তাতে না কুলোলে? রিজার্ভ ব্যাঙ্কের থেকে ট্রেজারি বিল বা অল্পকালীন ঋণপত্র গচ্ছিত রেখে টাকা ছাপিয়ে নিয়ে। এই হল ফিস্ক্যাল পলিসি বা রাজকোষ নীতি, যার মাধ্যমে সরকার ঠিক করে টাকা কতটা চাই, কতটুকু এবং কোথা থেকে ধার নেবে, এবং নোট ছাপাবে কিনা। এটা অর্থমন্ত্রীর কাজ

     

    আর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাজ হল, দেশের মুদ্রা নীতি বা মানিটরি পলিসি পরিচালনা করা।  অর্থাৎ, বাজারে কত টাকাপয়সা আছে, এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী কত থাকা উচিত এবং সুদের হার কী হবে তা ঠিক করা। যেমন মুদ্রাস্ফীতি বা ইনফ্লেশনের সময় বাজারে টাকার জোগান কমানো এবং মন্দার সময় বাড়ানো। এগুলো রিজার্ভ ব্যাঙ্ক করে মূলত ব্যাঙ্কগুলোর মাধ্যমে। কীভাবে?

     

    ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার ডায়নামিক্স রেপো এবং রিভার্স রেপো রেট।

    ব্যাঙ্কের কাজ লোকের থেকে অল্প সুদে টাকা জমা নিয়ে চড়া সুদে ধার দেওয়া ঠিক যেভাবে সোনার দোকানে গয়না কেনাবেচা হয়। বাজার চড়লে বেশি লোক ও সংস্থা ধার চাইবে, মন্দার সময় কম। মাঝখানে যে লাভের গুড় (ফিনানশিয়াল মার্জিন) তাই দিয়ে ব্যাঙ্কের ঘর খরচা (স্টাফের মাইনে, অফিসের ভাড়া ইত্যাদি) চলে। লাভ বেশি হলে ব্যাঙ্ক সেই টাকা বিনিয়োগ করে বিভিন্ন রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারি বন্ড কিনে, বা পাবলিক সেক্টরের বিমা ও বন্ড কিনে

     

    টাকায় বড় রকম টান পড়লে? রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে ধার নেয়। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তখন যে হারে সুদ নেয়, তার নাম রেপো রেট। আবার ব্যাঙ্কের সিন্দুকে টাকা খুব বেশি হলে অল্প সময়ের জন্যে সেই টাকা ওরা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে জমা রাখে। বদলে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের থেকে যে হারে সুদ পায়, তার নাম রিভার্স রেপো। এখানেও সোনার দোকানের হিসেব রেপো রেট সবসময় রিভার্স রেপোর চেয়ে বেশি মে মাসে রেপো রেট 4.40% থেকে কমে 4% হয়েছে, এবং রিভার্স রেপো হয়েছে 3.75% থেকে 3.35%[5]

     

    শিল্প ও বাণিজ্যিক সংস্থাগুলোর দাবি মেনে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক গত এক বছরে ক্রমাগত রেপো রেট কমিয়ে গেছে, যাতে ব্যাঙ্কের লোন দেবার ফান্ডের খরচ কমে, এবং ব্যাঙ্কও গ্রাহকদের কম সুদে ঋণ দিতে পারে। কিন্তু তা হয়নি। ব্যাঙ্ক এই পড়তি বাজারে শিল্প-ব্যবসায় সস্তায় ঋণ দেওয়ার বদলে বাড়তি টাকা হয় বিভিন্ন সরকারি বন্ডে লাগিয়েছে, অথবা খুব কম সুদে, মানে রিভার্স রেপোতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে জমা রেখেছে। এনপিএ বা অনাদায়ী ঋণ বাড়ার ঝুঁকি নেওয়ার চেয়ে এটাই ভাল ভেবে

     

    কিন্তু মন্দার সমস্যা হল চাহিদার সমস্যা, লোকের হাতে টাকা চাই।

    সবাই দেখতে পাচ্ছে মন্দা এবং করোনা গোটা বিশ্বেই ধুন্ধুমার লাগিয়ে দিয়েছে। মন্দা মানে দোকানে জিনিস আছে, গুদামে মাল পড়ে আছে, শুধু ক্রেতার সংখ্যা দিনের পর দিন কমছে। ফলে লোক ছাঁটাই হচ্ছে। ফলে বাজারে চাহিদা আরও কমছে। এই চক্র সমানে ঘুরছে। চাকাটা উল্টোদিকে ঘুরিয়ে বাজারে তেজিভাব আনতে গেলে লোকের হাতে সোজা টাকা পৌঁছনো দরকার। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক দেখে বাজারে জোগানের দিকটা। কীকরে ব্যাঙ্কের হাতে সস্তা দরে টাকা দিয়ে ওদের ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতিদের সুলভে ঋণ দিয়ে চাঙ্গা করা যায়। তাহলে উৎপাদন বাড়বে, বেশি লোক চাকরি পাবে। এই মুদ্রানীতি কাজ করে অপ্রত্যক্ষ ভাবে, কিছু সময় নিয়ে

     

    এই সময়ে কাজ করে সরকারের রাজকোষ নীতি। অর্থাৎ, সরকার সিধে খরচ করুক, সেই টাকা ঘুরপথে না এসে সোজা লোকের হাতে আসবে। যেমন, এই করোনার সময় ইউরোপ আমেরিকার মতো আমাদের সরকারও যদি কাজ হারানো গরিবদের বেকার ভাতা দেয়, পরিযায়ীদেরও চাল-ডালের পাশাপাশি কয়েকমাস নগদ টাকা দেয়, তো এরা খেয়ে-পরে বাঁচবে। খাবার, জামাকাপড়, ওষুধপত্তর বাজারে কেনাকাটা করবে। ফলে চাহিদা বাড়ায় জোগান দিতে কলকারখানা দোকানপাট সব জেগে উঠবে এছাড়া, সরকার যদি এখন রাস্তাঘাট, হাসপাতাল এসব বানাতে গিয়ে শ্রমিক ও কাঁচামালের জন্যে খরচা করে, তাতেও লোকের হাতে পয়সা আসবে, যা বাজারে খরচ হবে এবং চাহিদা বাড়বে। অর্থাৎ, মুদ্রানীতি যদি ভিটামিন হয় তো সরকারের রাজকোষ নীতি হল কোরামিন বা অ্যান্টিবায়োটিক

     

    আরও পড়ুন

    লকডাউন অর্থনীতি 3: চলতি বছরের বাজেট

     

    অর্থনীতিবিদরা কী বলছেন?

    হালে নোবেল পাওয়া অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জি বলছেন, এই অবস্থায় সরকারের উচিত মানিটারি বা ফিস্কাল ডিসিপ্লিন নিয়ে বেশি চাপ না নিয়ে, সোজা নোট ছাপিয়ে গরিবদের হাতে টাকা পৌঁছে দেওয়া[6] বাজেট পেশ করার আগে তিনি বলেছিলেন, এই অবস্থায় সরকারের ‘ফিস্কাল টাইটেনিং’ বা হাতের মুঠো চেপে রাখা উচিত না। বরং, সরকার এই অবস্থায় দরাজ হাতে খরচ করলে ভাল হয়। সরকার যতই 3%-এর কাছাকাছি রাজকোষ ঘাটতি ধরে রাখার কথা বলুন না কেন, বাস্তবে সেটা অনেক আগেই উবে গেছে। আরেকটু ঢিলে হলে কোনও মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।[7] বরং সরকার নির্দ্বিধায় টাকা ছাপিয়ে নিক আর সরাসরি সব চেয়ে যাদের দরকার সেই গরিবদের হাতে নগদ পৌঁছে দিক

     

    রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন বলছিলেন, ফিস্ক্যাল ডেফিসিট নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে  বাস্তব অর্থব্যবস্থাকে রক্ষা করার কথা ভাবা উচিত। যেমন গরিবদের খাবার, চাকরি বাঁচানো, বেকার ভাতা, এমএসএমই ইউনিটগুলোকে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল দেওয়া ইত্যাদি। এতে খুব বিরাট একটা টাকা লাগবে না। সরকার ঋণ নিতে পারে।[8]

     

    মুখ খুললেন অমর্ত্য সেনও। ইন্ডিয়া টুডে’র রাজদীপ সরদেশাইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অভিজিৎ এবং রঘুরাম রাজনদের মতোই বললেন যে, সরকারের উচিত এখন ব্যয় সংকোচ না করে খাদ্য, বাসস্থান এবং স্বাস্থ্য পরিকাঠামোয় খরচ করা। আরও বললেন যে, এই ব্যতিক্রমী অবস্থায় রেশন কার্ড না থাকলেও অভাবী লোকের কাছে খাদ্য পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত[9] কিন্তু বাস্তবে সরকার কী করল?

     

    বহুচর্চিত করোনার রিলিফ প্যাকেজের ঝাঁকিদর্শন

    প্রথম প্যাকেজ: 26 মার্চ, 2020 তারিখে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমনের 1.7 লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ  এই প্যাকেজের ঘোষিত লক্ষ্য পরিযায়ী শ্রমিক এবং শহুরে ও গ্রামীণ শ্রমিক। এই প্যাকেজের ফলে এরা কেউ নাকি অভুক্ত থাকবেন না[10] এই প্যাকেজে আছে:

     

    1. পিএম গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনায় 80 কোটি মানুষের রেশন কার্ডের মাধ্যমে বিনামূল্যে তিন মাস ধরে প্রতি মাসে মাথাপিছু অতিরিক্ত ৫ কেজি চাল বা গম এবং পরিবার পিছু 1 কেজি ডাল।
    2. জনধন যোজনায় ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা 20 কোটি মহিলার তিন মাস প্রতি মাসে 500 টাকা করে সহায়তা
    3. প্রায় তিন কোটি প্রবীণ নাগরিক, প্রতিবন্ধী এবং বিধবা মহিলার জন্য দুই কিস্তিতে 1000 টাকা করে তিন মাস ভাতা
    4. উজ্জ্বলা যোজনায় বিপিএল পরিবারের জন্য বিনামূল্যে তিন মাস সিলিন্ডার
    5. কিষাণ সম্মান নিধি থেকে 8.69 কোটি কৃষকের খাতায় বছরে তিন কিস্তিতে 2000 টাকা।
    6. ‘মনরেগা’ যোজনায় দৈনিক মজুরি 20 টাকা করে বৃদ্ধি
    7.  কোভিড-19 পরিচর্যায় নিযুক্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের তিন মাসের জন্যে 50 লাখ করে   স্বাস্থ্যবিমা
    8. দীনদয়াল ন্যাশনাল লাইভলিহুড মিশনের অন্তর্গত মহিলা সেল্ফ-হেল্প গ্রুপকে  কোনও গ্যারান্টি বিনা 20 লাখ অবধি ঋণ, যাতে নাকি 7 কোটি মহিলা উপকৃত হবেন

     

     এর থেকে ম্যাক্রো অর্থনীতির চাহিদার সমস্যা মিটবে?

    প্রথম ছ’টি যোজনায় লোকের হাতে অবশ্যই পয়সা আসবে, যা বাজারে খরচ হয়ে কিছু চাহিদা বাড়াবে। কিন্তু কতটুকু? কারণ, বেশির ভাগ পরিযায়ী শ্রমিকদের রেশন কার্ড আছে গাঁয়ের বাড়িতে, কাজের জায়গায় নয়। আর যারা কাজের জায়গায় সপরিবার আছে এবং কাজ হারিয়ে মাইনে না পেয়ে ঘরছাড়া হচ্ছে, তারা রেশন নেবে কীভাবে? মাসে 500 বা হাজার টাকায় এই বাজারে কারও সংসার চলে? তাই এই প্যাকেজ ঘোষণার পনেরো দিনের মধ্যেই দেখা গেল, দিল্লি, মুম্বাই, হায়দ্রাবাদ, ব্যাঙ্গালোর বা কলকাতায় সরকারি, আধা সরকারি এবং কিছু এনজিও’র প্রচেষ্টায় আয়োজিত লঙ্গরখানায় দু’বেলা দুমুঠো খাওয়ার জন্যে নিরন্ন মানুষের লাইন, এবং রাস্তায় ট্রাকে, বাসে, সাইকেলে বা পায়ে হেঁটে ঘরে ফেরা মানুষের ঢল

     

    কিষাণ সম্মান নিধির পয়সা এবং মনরেগায় দৈনিক মজুরি বৃদ্ধির বরাদ্দ গত বাজেটেই ধরা হয়েছে। করোনা না হলেও নিয়মমাফিক এপ্রিলে দিতে হত

     

    7 এবং 8 নম্বরে সরকারের বিশেষ খরচা নেই; কারণ সরকারকে মাত্র তিন মাসের প্রিমিয়াম দিতে হবে। 8 নম্বরে ঘোষণাই সার। ভারতের কোনও ব্যাঙ্ক এই সময় সেল্ফ-হেল্প গ্রুপকে 20 লাখ টাকা ঋণ দেবে না

     

    কিন্তু সীতারমন এটা বললেন না যে, অদক্ষ মজুরের দৈনিক মজুরি বাস্তবে 300 থেকে 333 টাকা অথচ এই প্যাকেজে মনরেগায় তথাকথিত বর্ধিত মজুরি হয়ে গেল 202 টাকা। অর্থাৎ, ন্যূনতম মজুরির থেকেও কম![11] এই রিলিফকে পরিহাস ছাড়া কী বলা যায়?

     

    দ্বিতীয় প্যাকেজ:

    প্রধানমন্ত্রীর 20 লক্ষ কোটি টাকার আত্মনির্ভর ভারত যোজনা[12]

     

    ভাগ

    (কোটি টাকায়)

    প্রথম

    5,94,550

    দ্বিতীয়

    3,10,000

    তৃতীয়

    1,50,000

    চতুর্থ এবং পঞ্চম

    48,100

     

    উপ-যোগ         11,02,650

    আগের পিএম গরিব কল্যাণ যোজনা

     

    1,92,800

    রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় টাকার জোগান

     

    8,01,603

     

    উপ-যোগ      9,94,403

     

    মোট যোগ     20,97,053  

           

     

    এই প্যাকেজে সরকারের কোষ থেকে কত খরচা হবে? প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা মাফিক জিডিপি’র 10%? আমরা এবার খতিয়ে দেখি সত্যিই কি তাই?

    1. প্রথম ভাগ: অর্থনীতিবিদদের মতে এমএসএমই সেক্টরকে দেওয়া 6 লক্ষ কোটি টাকা আসলে তাদের ব্যাঙ্ক ঋণ দেওয়ার গ্যারান্টিওই ঋণ পুরোপুরি এনপিএ বা অনাদায়ী হলে ব্যাঙ্ক সরকারের কাছে টাকা চাইবে। স্বভাবতই এই বছর এই বাবদ সরকারের কোনও চাপ নেই। ভবিষ্যতে 20 থেকে 50 হাজারের বেশি কোষাগারে চাপ পড়বে না
    2. দ্বিতীয় ভাগ: এই ভাগে পরিযায়ী শ্রমিক, কৃষক, ছোট ব্যাপারি এবং ফেরিওয়ালাদের জন্যে যে 3.1 লক্ষ কোটি বরাদ্দ হয়েছে, তাতে সরকারের কোষাগার থেকে খরচ হবে খুব বেশি হলে 16,000 কোটি টাকা, যা তাদের তিন মাস ব্যাপী বিনামূল্যে মাথাপিছু 5 কিলো চাল বা গম এবং পরিবার পিছু 1 কিলো ডাল দেওয়ায় ব্যয় হবে
    3. তৃতীয় ভাগ: এতে কিষাণ ক্রেডিট কার্ডে ঋণ ভর্তুকি এবং কৃষি পরিকাঠামোতে পরিবর্তন বাবদ যে 1.5 লক্ষ কোটি বরাদ্দ হয়েছে, তাতে সরকারের বাজেট থেকে নগদ খরচ হবে মাত্র 6,000 কোটি
    4. চতুর্থ ভাগ: এ দিনে বেশির ভাগই গেল কয়লা, লোহা, বক্সাইট ইত্যাদি খনিজ উৎখনন  এবং বিমান পরিষেবা ও প্রতিরক্ষায় বেসরকারিকরণের এবং বিদেশি বেসরকারি বিনিয়োগের (এফডিআই) জন্যে দরজা খুলে দেওয়ার নীতি ঘোষণা করতে। এতে সরকারের বাজেট থেকে খরচ হবে খুব বেশি হলে 8,100 কোটি টাকা। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল প্রতিরক্ষা খাতে বিদেশি বিনিয়োগের অংশীদারি 49% থেকে বাড়িয়ে 74% করা
    5. পঞ্চম ভাগ: নির্মলা যে মনরেগা যোজনায় 65% বরাদ্দ বাড়িয়ে অতিরিক্ত 40,000 কোটি টাকা ঘরে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকেদের 100 দিনের কাজ দেওয়ার জন্যে ঘোষণা করলেন, তা অবশ্যই বাজেট থেকে সরাসরি নগদে খরচ হবে[13]

     

    আর্থিক বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?

    অডিট এবং কন্সাল্টিং জায়ান্ট ইওয়াই ইন্ডিয়ার মতে এই 20 লক্ষ কোটির প্যাকেজের মাত্র 2 লক্ষ কোটি, অর্থাৎ জিডিপি’র 1% খালি সরকারের বাজেট থেকে খরচ হবে। বার্কলের মতে এটা 1.5 লক্ষ কোটি বা জিডিপির 0.75%এডেলওয়াইস সিকিউরিটিজ-এর মতে 0.8%স্টেট ব্যাঙ্কের মুখ্য অর্থনীতিবিদ সৌম্যকান্তি ঘোষের মতে এই প্যাকেজে কেন্দ্রীয় সরকারের খরচ জিডিপি’র 1% এর বেশি নয়। সবার মতে গোটা প্যাকেজে মনরেগার 0.4 লক্ষ কোটি এবং গরিব মানুষদের তিন মাস চাল/গম/ডাল বিনামূল্যে দেওয়া বাবদ 16,000 কোটি ব্যয় সত্যিই বাজারে চাহিদা সৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ সাহায্য করবে

     

    দেখাই যাচ্ছে সরকারের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক অভিজি-রাজন-কৌশিক-অমর্ত্য সেনদের চিন্তার উল্টো দিকে হেঁটেছেন। এ নিয়ে 17 মে সাংবাদিক বৈঠকে প্রশ্ন তুললে সীতারামন বলেছেন, অনেক পরামর্শই তো আসে। আমরা যেটা কাজে দেবে মনে হয়েছে, সেটাই করেছি

     

    আর এই রিলিফ প্যাকেজের অতিরিক্ত ব্যয়ের টাকা কোথা থেকে আসবে জানতে চাওয়ায় উনি সেটা এড়িয়ে গিয়ে বলেন, এখন টাকা কোথা থেকে আসবে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কোথায় যাচ্ছে সেটা দেখুন

     

    তাহলে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যে 8 কোটি টাকা অর্থ ব্যবস্থায় ‘ইনফিউজ’ করল, বা স্যালাইন চড়াল তার কী হল? সে টাকা কোথায় গেল?

    [আগামী সংখ্যায়: সরকারের নোট ছাপানো মানে কি শুধুই ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ?]

     

    তথ্যসূত্র: 
    ------------------------------------------------------------------------------------
    1.    ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, 30 মে, 2020
    2.    ইকনমিক টাইমস, 26 মে, 2020
    3.    ঐ ; 13 মে, 2020
    4.    দি হিন্দু, 7 মে, 2020
    5.    ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, 22 মে 2020
    6.    টেলিগ্রাফ, 25/04/20
    7.    বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এবং এএনআই, 11 জানুয়ারি, 2020
    8.    ইকনমিক টাইমস, 25 এপ্রিল, 2020
    9.    অমর্ত্য সেনের ইন্টারভিউ; ইন্ডিয়া টুডে, 5 মে, 2020
    10.     ইন্ডিয়া টুডে, 26 মার্চ, 2020
    11.    চিফ লেবার কমিশনার (কেন্দ্রীয়), বিজ্ঞপ্তি  06/05/2020
    12.    ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস, 17/05/2020
    13.    দ্য প্রিন্ট, 17 মে, 2020

     


    রঞ্জন রায় - এর অন্যান্য লেখা


    দাঙ্গার সময় গান্ধীজির মুসলিম শরণার্থীদের সাহায্যে হিন্দু যুবকদের এগিয়ে আসার আহ্বানে খেপেন সাভারকর।

    ব্যাঙ্কের ভাঁড়ারে পয়সা যথেষ্ট থাকলেও লোন দেওয়ার ব্যাপারে ওরা খুব মেপে মেপে পা ফেলছে।

    সেরা ভোজনরসিক না বুঝলেও মাংসের হালাল ঝটকা বিচারে নেমেছে দিল্লি পুরসভা

    মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী লাভ জিহাদ আইন এখন সুপ্রিম কোর্টে

    ভারতের কিসানের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে গোটা সমাজ

    শিক্ষা স্বাস্থ্যের মতো সামাজিক ক্ষেত্রেও নিছক লাভের জন্য কর্পোরেট ব্যবসা

    লকডাউন অর্থনীতি 4: মা যা হইয়াছেন -4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested