সারা বিশ্বের ঘুম উড়িয়েছে করোনা ভাইরাস। একের পর এক দেশে তাণ্ডব চালানোর পর শেষমেশ ভারতে পদার্পণ। কিন্তু এখানেই করল সে মস্ত বড় ভুল। সারা বিশ্বের মানুষ এখনও গোমূত্রকে পাত্তা দিল না তাই, নয়তো এ ভাইরাস কবে হাপিস হয়ে যেত!
কখনও রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে, কখনও মঞ্চে উঠে, কখনও পার্টি দিয়ে সাড়ম্বরে গোমূত্রকে খোলা সার্টিফিকেট দিয়েছেন কত্ত মান্যগণ্যরা। জোর গলায় তাদের বলতে শোনা গিয়েছে, ‘আগেও খেয়েছি, আবার খাবো। এর মতো ওষুধ নেই।’ কথা শুনে এক জনপ্রিয় বিস্কুট সংস্থার তৈরি বিজ্ঞাপনের ট্যাগ লাইন অনেকের মনে পড়তে পারে, ‘অল্পেতে স্বাদ মেটে না, এ স্বাদের ভাগ হবে না।’ তবে একেবারে তরল নয়, তার সঙ্গে গরুর ত্যাগ করা সেমি সলিড ইষৎ নস্য রঙের ‘মহাপ্রসাদও’ গোমূত্র পার্টিতে চেটেপুটে খেয়েছেন অনেকে।
হিন্দু মহাসভা আয়োজিত গোমূত্র পার্টির দৃশ্য। মূত্রের গ্লাস হাতে স্বামী চক্রপাণি।
সত্যজিৎ রায় ২৮ বছর আগে পরলোক গমন করেছেন। তিনি বেঁচে থাকলে প্রফেসর শঙ্কুকে নিজের আবিষ্কারের তালিকা থেকে সর্বরোগনাশক ওষুধ মিরাক্যুরল-কে বাদ দিতে হতো। আরে গোমূত্রের মতো এত প্রভাবশালী ওষুধ থাকতে কিনা সমান্য বড়ি নিয়ে এত অহংকার! সত্যজিৎ বাবু তা পাল্টাতেন কিনা তা পরের প্রশ্ন, কিন্তু গোমূত্র নিয়ে প্রশ্ন করলে নির্ঘাত তাঁর কপালে দেশদ্রোহী তকমা জুটত। বলা হতে পারত, বিদেশিদের সঙ্গে গা ঘষাঘষি করার ফল। দিশি ওষুধে ভরসা নেই। দেশের প্রতি সম্মান নেই। ব্যস তার পর শুরু হত সোশাল বুলিং। আরে আই টি ভাইটিরা থাকতে চিন্তা কিসের!
আরও পড়ুন |
আরে মাটি লাও... করোনা ভাইরাসের মূর্তি হবে |
পার্টিতে আরও একটি বিষয়ে সকলের চরম আস্থা ছিল। যদিও সেটা সত্যজিৎ রায় তাঁর লেখায় উল্লেখ করে গিয়েছেন। ফেলুদা, তোপসে আর জটায়ু বারাণসীতে পৌঁছে ক্যালকাটা লজ যাওয়ার পথে জটায়ুর একটি প্রশ্নে ফেলুদার মুখে মোক্ষম একটা উত্তর বসিয়েছিলেন তিনি। জটায়ু জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘ফেলুবাবু, বেনারসে কত মন্দির আছে বলুন তো?’ ফেলুদার জবাব ছিল ‘তেত্রিশ কোটি।’ ওই বিশেষ সংখ্যাটি নিয়ে গোমূত্র বিলাসিরা বেজায় নিশ্চিন্ত বোধ করেছেন। আরে এত বডিগার্ড থাকতে চিন্তা কিসের! করোনার বাবাও তাদের কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারবে না।
তবে দুর্ভাগ্যের বিষয়, কেশ ছেড়ে গোটা প্রাণ নিয়ে টানাটানি শুরু করেছে করোনা। মহামারী ঠেকাতে টানা ২১ দিন লকডাউন ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। পরিস্থিতি এমনই জটিল যে ২৪ মার্চ মঙ্গলবার তিন দিনের মধ্যে দ্বিতীয়বার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে হয় তাঁকে। ভাষণে তিনি এটাও বলেন, গুজবে কান দেবেন না। এতেই আরও বেশি মন খারাপ গোমাতার পুত্রদের। শেষ পর্যন্ত কিনা পরিবারের বড়কত্তাও মূত্রখোরদের ওপর বিশ্বাস হারালেন।
এমন ঘোর অন্যায়ের দিনে গরুর পেছনে গ্লাস নিয়ে ঘোরা মহাপুরুষদের মুখে বাণী নেই। কষ্টে প্রাণটা ফেটে যাচ্ছে। চরম কনফিডেন্সের সঙ্গে তারা গটগট করে গোমূত্র গলা থেকে নামিয়েছিলেন, বার বার। প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ৩৩ কোটি দেবী-দেবতার উপস্থিতির কথা জানান দিয়েছিলেন তারা। বলেছিলেন, ‘ভারত দেবী-দেবতাদের দেশ। এখানে করোনা কিছু করতে পারবে না।’ এমনকী করোনার মূর্তি বানিয়ে গোমূত্রে খাইয়ে পুজোও করেছিলেন তারা। আর প্রধানমন্ত্রী কিনা এটুকু বিশ্বাস রাখলেন না তাদের বিশ্বাসের ওপর। শুধুমাত্র স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কথায় বিশ্বাস রাখতে বললেন তিনি। অন্য কেউ এত ক্ষণে দেশদ্রোহী ট্যাগ সেঁটে দেওয়া যেত। কিন্তু এখানে তো সে রাস্তাও বন্ধ!
যদিও আমি এখনও বিশ্বাস করি, গোমূত্র-বিলাসিদের কিস্যু হবে না। তারা বহাল তবিয়তে গরম ধোঁয়া ওঠা গোমূত্রের কাপে চুমুক দিতে দিতে আক্রান্তদের দিকে করুণার চোখে তাকাবে, আর মনে মনে ভাববে, ‘বেশি বিজ্ঞান দেখালে এই অবস্থাই হয়।’ তার পর নিশ্চিন্তে নস্য রঙের মহাপ্রসাদের বাটিতে চামচ নিয়ে মনোনিবেশ করবেন।
জয়, অশিক্ষার জয়।
হলফ করে বলা যায়, সিরিজটি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের সিনেমার আকারেও তৈরি করা যেত।
এই লেখা সেই সব ব্যক্তিদের জন্য যাঁরা এই পেশাকে প্রতিদিন চরম অপমান করে চলেছেন।
দরজা খোলার শব্দে ঘোর থেকে বেরিয়ে এলেন ঠাকুর। ‘কে এলি, রিদে নাকি?’ উত্তর এল, ‘মিত্রোঁওওওও, আমি নরেন'
দাদা তো ঠিকই বলেছে। হাসপাতাল বানিয়ে কী হবে? তার চেয়ে মোড়ে মোড়ে মন্দির বানালে এ দেশের কোনও অমঙ্গল হ
এ এমন এক অন্ধকার, যা সূর্যের আলোতেও দূর হওয়ার নয়। গ্রহণের সময় তো আবার সেই আলো কমে যায়।
যারা আমায় মনের মধ্যে রাখতে পারে না, তারাই চিৎকার করে আমার ভক্ত বলে পরিচয় দেয়।