×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • মনের কতা শুধু বলেই গেলি, শুনলি নে: ঠাকুর

    রজত কর্মকার | 19-05-2020

    এ ভাবেই জীবনযাত্রা-মরণযাত্রা চলছে পরিযায়ী শ্রমিকদের

    বিগ্রহের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রয়েছেন ঠাকুর। গালে চোখের জলের দাগ শুকিয়ে রয়েছে।

     

    মাঝে মাঝেই দিগ্‌ভ্রান্তের মতো চেঁচিয়ে উঠছেন - না, না, এত মরণ আর দেখাস নে মা। ওরা তোর কী খেতি করলে মা, তুই এমন নিষ্ঠুর হতে পারলি? ওরাও তো তোর সন্তান। কেন ওদের দেখে তোর দয়া হয় না? বল মা বল। চুপ করে থাকিস নে। বল রাক্ষুসি বল। তোর এত ক্ষিদে! তুই আমায় নে তা হলে। আর এই ধরায় রাখিস নে। মা হয়ে তুই এটুকু দয়া করবি নে?’

     

    সহসা পেছনে দরজা খোলার শব্দে ঘোর থেকে বেরিয়ে এলেন ঠাকুর। কে এলি, রিদে নাকি?’ উত্তর এল, মিত্রোঁওওওও.... আমি নরেন।

     

    ঠাকুর: হ্যাঁ! (খানিকটা আঁতকে উঠলেন) নরেন এলি?

    মুখ ঘুরিয়ে আগুন্তুককে দেখেই খেঁকিয়ে উঠলেন, তুই কে রে? যা যা যাঃ, দেখছিস নে আমি মায়ের সঙ্গে দুটো কতা কইচি। কে তোকে ঢুকতে দিল এখেনে?’

     

    মিত্রোঁ: পেন্নাম ঠাকুর। আমায় কেউ ঢুকতে দেয়নি। আমি নিজেই ঢুকেছি। তা ছাড়া আমায় আটকায় এমন সাধ্য কার আছে? আমি আপনার সঙ্গে এট্টু দেখা করতে এলুম। অনেক দিন গঙ্গার হাওয়া খাওয়া হয়নি। তা ছাড়া সামনের বছর ঘটা করে ইলেকশন উৎসব করতে হবে এ রাজ্যে। তাই একবার মায়ের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে যাব ঠিক করলাম। ভালই হল আপনি এত রাতেও মন্দিরের দরজা খোলা রেখেছেন। তা মায়ের ঘুমোনোর সময় হয়নি এখনও?

     

    ঠাকুর: ধুর শালা! মা আবার কখন ঘুমোয়? মা সব দেখেন। নরেনের নাম নিয়ে এসিচিস বলে ভাবলাম সত্যিই নরেন এসেচে। ভুলে গেসলাম যে, ও মায়ের বড় প্রিয় সন্তান। মা তাই তাড়াতাড়ি ডেকে নিয়েছিলেন ওকে। নরেন নাম হলেই যদি সত্যিই নরেন হওয়া যেত, তা হলে তোর আগেও লক্ষ লক্ষ নরেন এসে মায়ের পায়ে মাথা ঠুকে যেত। লোকের সেবা করত। আমার এই অভাগা দেশটা কোনও কালেই বিশেষ সুখী ছিল না। চিরকাল না খেয়ে থাকা রুগ্ন মনিষ্যিদের ভাল হয়নি। লালামুখো সায়েব-সুবো থেকে এ দেশের শাসক, কেউই ওদের দিকে কোনও দিন মুখ তুলে চায়নি। ওরা যেন কীট-পতঙ্গ! বাঁচলেই যেন ঢের পেয়েছে মনে করে। মরণ তো ওদের দুই পা দূরেই দাইড়ে থাকে।

     

    মিত্রোঁ: এত ক্ষণে বুঝলাম, কেন বড় বড় লোকেরা আপনার দেখা পাওয়ার জন্য হা-পিত্যেস করত। কত সহজে বলে দিলেন সারসত্য। মরণ যাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে, তারা তো বেঘোরেই মরবে। এতে এত অবাক হওয়ার কী আছে কে জানে বাপু! তা ট্রেনের চাকার নীচে মরল না ট্রাকের চাকার নীচে, তাতে কী যায় আসে। মরণই তো কনসট... আরে আমার মনিটরটা কেউ নিয়ে আয় তো। কতবার বলেছি, আমার ডায়ালগে যেন বেশি ইংজিরি বিদ্যে না ফলায়। সব ফাঁকিবাজের দল আমার কপালে জোটে। কী যেন বলছিলাম... হ্যাঁ, মরণই তো কনস্ট্যান্ট।

     

    ঠাকুর: ধুর মুখপোড়া, ও সব সায়েবি বিদ্যে আমার কাছে ফলাস নে। ও সব ছাইপাস আমি বুঝিনে। বাংলায় কতা কইতে পারিস তো থাক, নইলে দূর হ...

     

    মিত্রোঁ: ঠাকুর এ জন্যে আপনাকে আমার আরও ভাল লাগে। দুপাতা ইংজিরি পড়ে নিজেকে কী সব ভাবে লোকজন! কথায় কথায় ফ্যাট ফ্যাট করে দু-চারটে ইংজিরি ঝাড়বেই। আপনার ওসব বালাই নেই। সোজা কথা সোজা করে বল, ব্যস। সহজ নীতি, সবার উন্নতি।

     

    ঠাকুর: তা তুই কার কার উন্নতি করলি?

     

    মিত্রোঁ: অনেকের উন্নতি করেছি। তাদের অনেককে দেশের বাইরেও বেশ সুরক্ষিত ভাবে পৌঁছে দিয়েছি। লোকে ওদের চোর বলে ঠিকই, কিন্তু যত টাকা ওরা পকেটে নিয়ে পালিয়েছে, ওদের চোদ্দ পুরুষের আর কিছু করার দরকার পড়বে না। তা ছাড়া এ দেশেরও বহু গরিব ব্যবসায়ীকে দাঁড় করিয়েছি। যাতে কাজে গতি আসে, তার জন্য রেল থেকে ভেল, সব বিক্রি করে সেই টাকা দেশের কাজে লাগাচ্ছি। আমার সহজ নীতি, যত দিন আছি, তত দিন বেচি। কেনা-বেচা নিয়েই তো সংসার।

     

     

    ঠাকুর: বাহ্, তা বেশ। ভালই করিচিস। বেচে দে, সব বেচে দে। তা হলে লোকে আর আমার আমার করবে না। ধম্মে কম্মে মন নেই, শুধু আমার আমার। মাঝে শুনিচি কোন হত্তা কত্তা নিজের কোটে নিজেরই নাম লিখিয়ে পরেছিল। হ্যাঃ... বোঝো ঠ্যালা। বলি নিজের নাম কী জানা ছিল না যে জামার ওপর লিকতে হল। তার পর কত মানুষ নাকি অস্তর ঘোরানোকেই ধম্ম বলে মনে করে। ধম্ম তো বিনয় শেখায় রে, ধম্ম শেখায় সেবা। আমার নরেন যেমন সারাজীবন আর্তের সেবা করে গিয়েচে। সেই কত বচ্চর আগেকার কতা। তখন থেকেই তো ধম্মের আসল রূপটা মানুষকে দেখিয়েছে। কতবার করে ও বলে গেসল, জীব সেবাই শিব সেবা। সেই দেশেই কিনা কালী-কৃষ্ণের নাম করে মানুষ মানুষকে মারে! তা তুই কি ব্যবসাদার? ওই জিনিসপত্র বেচা-কেনার কতা কইলি, তাই ভাবলুম।

     

    মিত্রোঁ: (স্বর নিচু করে ঠাকুরের কানের সামনে মুখ নিয়ে) এই কথাটা সবাইকে বলবেন না। ব্যবসায়ী তো বটেই, এ জন্য শুধু বিজনেস ক্লাসই আমার পছন্দ। কিন্তু এ দেশে তেমন মানুষ তো আর বেশি নেই। যত সব হাড়-হাভাতেদের নিয়ে সংসার করতে হয়। এই দেখুন না, দলে দলে রাস্তায় নেমে হেঁটে বাড়ি ফিরছে সব কীট-পতঙ্গ। কেউ পিষে মরছে, কেউ না খেয়ে, কেউ ক্লান্তিতে। বড় কাজ করছে যেন! আরে গরিব হয়ে জন্মেছিস, এত খাই খাই কেন। চুপচাপ গর্তে ঢুকে থাকলেই তো ল্যাঠা চুকে যেত। তা না, সব লোটা-কম্বল নিয়ে রাস্তায় নেমেছে।

     

    ঠাকুর: তুইও ওদের কীট-পতঙ্গ বললি বুঝি। বাহ্ বাহ্...। তুই তা হলে কোনও হোমড়া চোমড়া হবি। সারা দিন কী করসি তুই?

     

    মিত্রোঁ: কথা বলি। মনে যা আসে সেটাও বলি। যা আসে না সেটাও টেনে এনে বলি। এমন কথা বলি লোকে মাথা চুলকেও ঠিক করতে পারে না, কী বললাম। পরীক্ষার খাতায় সব শেষে লেখা আনকমন প্রশ্নের উত্তরের মতো। এগজামিনার লেখা পড়েই যান, কিন্তু উত্তর আর খুঁজে পান না। আরে প্রশ্ন না থাকলে জীবন চলবে বলুন? সে জন্যেই কথার জালে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে লোকজনকে প্রশ্ন দিয়ে টিপে মারি। দেশের জনসংখ্যা বেশ ভয়ানক জায়গায় পৌঁছে গেছে। সবই তো বোঝেন। এক দিকে বাড়াতে বলব, আর এক দিকে হালকা করে কমিয়ে দেব। ব্যালান্স করতে হবে তো।

     

    ঠাকুর: মনের কতা শুধু বলেই গেলি। লোকের মনের কতা শোনার জন্যিই তো তোর জায়গায় লোকে বসে তাই না? অবিশ্যি তোর আসনে বসে কে কবে আর মনের কতা শুনেচে বল। সবাই তো আর আমার নরেন হয় না। ও যা কইত সেটাই লোকের মনের কতা ছেলো। লোকের মনেই তো থাকত, তাই তাদের কতাও বেশি শুনতে পেত। এখন আর কেউ ওকে মনে ধরে না। ধরার খ্যামতাই নেই। যারাই ধরবে, তারাই মরবে। তা মরুক। কতই তো মরচে রোজ। ভালই হচ্চে। বেঁচে যাচ্চে। আর বাঁচতে হচ্চে না। কী যেন বলচিলি, মরণই সত্যি, বাকি সব কদিনের যাওয়া আসা। তা সে দলে তুইও আচিস কিন্তু। মনে আচে কতাটা?

     

    (হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে)- আর নয় আর নয়... শোন মা কইচেন তোর গা থেকি মরা মানুষের রক্তের গন্ধ বেরুচ্চে। তিনি আর সহ্যি করতে পাচ্চেন না। তুই বেরো এখন। আর কখনও এ মুখো হোস নে। তুই-ই বোধহয় দিন কতক আগে গঙ্গার ও পাড়ে আমারই আর এক বাড়িতে রাত কাটিয়ে গেচিস না? তখনও হাওয়ায় ভেসে এই রক্তের গন্ধ আমার নাকে এসেচে। কিন্তু আর আসিস নে। তোর জুতোর মধ্যি রক্ত জমাট বেঁধে আচে। হাঁটলেই ছাপ পড়ে। যাঃ, দূর হঃ...

     

     


    রজত কর্মকার - এর অন্যান্য লেখা


    গরুর পেছনে গ্লাস নিয়ে ঘোরা মহাপুরুষদের মুখে বাণী নেই। কষ্টে প্রাণটা ফেটে যাচ্ছে।

    ওহঃ, একজন পুরুষ বটে! না, তিনি পুরুষ নন, মহাপুরুষ। না হলে এমন কথামৃত মুখ থেকে বার হয়?

    যারা গণধর্ষণে অভিযুক্ত, যারা দু’ জন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলার উপক্রম করেছিল, তারা জামিন পায় কী ভাবে?

    যে কোনও চলে যাওয়া শূন্যতা তৈরি করে যায়। এস পি-র শূন্যতা ভরাট হওয়ার নয়।

    এ এমন এক অন্ধকার, যা সূর্যের আলোতেও দূর হওয়ার নয়। গ্রহণের সময় তো আবার সেই আলো কমে যায়।

    ৫ জানুয়ারি রবিবার সন্ধ্যায় জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে মুখ ঢাকা গুন্ডাদের আক্রমণের পর এ ভাষায় গর্জে

    মনের কতা শুধু বলেই গেলি, শুনলি নে: ঠাকুর-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested