×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • আমরা এগোচ্ছি, কিন্তু পিছন দিকে

    রজত কর্মকার | 23-06-2020

    বেশ ভাল ভাবেই মনে আছে, দিনটা ছিল মঙ্গলবার। 1995 সালের 24 অক্টোবর। পুজোর ছুটি চলছিলনিয়মের ব্যতিক্রম করে সেইদিন গৃহশিক্ষক আসেননি। সকাল থেকে পড়াশোনা পুরোপুরি গুটিয়ে শিকেয় তুলে দিয়েছিলাম। তার আগের কয়েক মাসে সূর্যগ্রহণ নিয়ে নানা আর্টিকল-প্রবন্ধ ইত্যাদি পড়ে ফেলেছি। বিজ্ঞান মঞ্চ থেকে আমাদের স্কুলে পুজোর ছুটির আগে একটা সচেতনতা সভাও করেছিল। মনে আছে, প্লাস্টার অফ প্যারিসের তৈরি সূর্য-চাঁদ আর পৃথিবী নিয়ে গ্রহণের বিষয়টা বোঝানো হয়েছিল আমাদের, মানে যারা অপেক্ষাকৃত নীচের ক্লাসে পড়তাম। এত অপেক্ষার পর যখন সেই কাঙ্ক্ষিত দিন এল, সে দিন কি আর বাকি পাঁচটা দিনের মতো রুটিন হবে? মোটেই না।

     

    গ্রহণের দিন খাওয়া-রান্না ইত্যাদি নিয়ে তখন বিশেষ প্রচার ছিল না। এই মহাজাগতিক দৃশ্য দেখার আগ্রহে মানুষ সে দিন রাস্তায়-বাড়ির ছাদে, মাঠে, মানে যেখান থেকে আকাশ পরিষ্কার দেখা যাবে সেখানে জড়ো হয়েছিলেন। বাবা দিন দু’য়েক আগে রবিবার একটা চশমা এনে দিয়েছিলেন। গ্রহণ দেখার জন্য। চশমার উপরে লেখা ছিল, 3 সেকেন্ডের বেশি তাকালে তা ক্ষতিকারক হবেদুপুরে আমাদের ক্লাবের ক্রিকেট ম্যাচ ছিল। তাই একটু আগে খেয়ে নিতে হবে। সে জন্যই ছাদে খান দু’য়েক কেক নিয়ে চশমা পরে বসে রেডি। ঠিক গ্রহণ শুরু হবে, আর খেতে শুরু করব। এটাই ছিল তখনকার আমার শিশু মনের বিশ্বাসের ভিত্তি। গ্রহণের সময় খেতে নেই, বা জীবাণুর ভয় ইত্যাদি সবই ভিত্তিহীন। পুরাণে রাহু-কেতুর গল্প তো শুধুমাত্র গল্পই। করেছিলামও তাই। কেক খেতে খেতেই গ্রহণ দেখেছিলাম। গ্রহণের মধ্যেই মা রান্না করেছিলেন। গ্রহণের মধ্যেই খেয়েছিলাম। কিট ব্যাগ পিঠে করে ম্যাচ খেলতেও বেরিয়েছিলাম। সব মিলিয়ে মেজাজটা উৎসবের ছিল। হইচই, বিস্ময়ের বহিঃপ্রকাশ, সমবেত কণ্ঠস্বরে গমগম করেছে গোটা অঞ্চল।

     


    ১৯৯৫-এর বিখ্যাত ডায়মন্ড রিং

     

    এ বার 25 বছর এগিয়ে আসা যাক। আমি এখন মধ্য ত্রিশের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা লোক। নিজে একজন বাবা। করোনার আবহে পরিবারকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে বাড়িতে সম্পূর্ণ একা গ্রহণ দেখেছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, এ বারের গ্রহণটা যেন প্রকৃত অর্থেই গ্রহণ। মানুষ একটা বিশ্বমহামারীর সঙ্গে লড়ছে। বেঁচে থাকাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কত মানুষ রাষ্ট্র্রের উদাসীনতার মাসুল দিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন তার ঠিক নেই। নিঃস্ব, নিরন্ন, নির্জলা থেকে ক্লান্তিতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন অনেকে। তার মধ্যে সূর্য গ্রহণের নামে যে ভাবে কুসংস্কার বিলিয়ে দেওয়া হল, তা এক অর্থে নজিরবিহীন।

     

    25 বছর আগে গ্রহণ চলাকালীন খাওয়া-দাওয়া, বাড়ি থেকে বেরনো, পড়াশোনা-খেলাধুলো ইত্যাদি নিয়ে কোনও কুসংস্কার দেখিনি। 25 বছর পেরিয়ে এসে সে অর্থে অনেক প্রাজ্ঞ অবস্থায় যা দেখলাম তা ভীতিপ্রদ। কলকাতা কোনও অজ-পাড়া গাঁ নয়। গ্রামের বৃদ্ধ মোড়ল তাঁর ঠাকুমার কাছ থেকে শোনা গ্রহণ নিয়ে নানা রীতিনীতি ধমকে গ্রামবাসীকে শুনিয়ে যাবেন, এখানে এমনটা হওয়ার নয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেখা গেল সেই চিত্রই। অনেকে বাড়ির জানালা-দরজাই খুললেন না। ছাদে ওঠা বা রাস্তায় বেরনো দূরস্থান। কারও বাড়ির হেঁশেলের খবর কোনও দিন রাখার ইচ্ছে ছিল না, এখনও নেই। ফলে কে রান্না করলেন, কে করলেন না তা নিয়ে কোনও উৎসাহ নেই। কিন্তু পাশের বাড়ির মহিলা হোম ডেলিভারির জন্য রান্না করেন। তাঁকেও অন্যান্য দিনের মতো রান্না করতে না দেখে খানিক অবাকই হলাম। জিজ্ঞাসা করে জানলাম, বেশিরভাগ বাড়ি থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সকাল সাড়ে দশটার মধ্যে খাবার দিয়ে যেতে, নয়তো তাঁরা খাবার নেবেন না। এক অর্থে যা সম্ভব ছিল না। ফলে তিনি বৃথা চেষ্টা করেননি।

     

    এ তো গেল একটা উদাহরণ। খবরের কাগজ এবং সোশাল মিডিয়ার পাতায় চোখ রাখলে এমন ঝুড়ি ঝুড়ি ঘটনা দেখা যাবে। সৌরপৃষ্ঠের পরিষ্কার ছবি তুলতে পারে এখন এমন ক্যামেরা তৈরি হয়ে গিয়েছে। আমরা কম-বেশি সকলেই সেই ছবি দেখেছি। চাঁদের অন্ধকার দিকে রোবট পাঠিয়ে তার রহস্য ভেদ করতে চাইছে এ দেশেরই বিজ্ঞানীরাআর এ দেশেই গ্রহণের সময় জানালা-দরজা বন্ধ করে অরন্ধন পালন করছেন এমন মানুষ গুনে শেষ করা যাবে না। কী অদ্ভুত বৈপরীত্য! 25 বছর আগে যা দেখিনি, এখন প্রযুক্তির চরম পরাকাষ্ঠার যুগে সে জিনিস দেখতে হচ্ছে। হোয়াটসঅ্যাপে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন ছেঁদো যুক্তি। নানা রকম জুজু। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এক আশ্চর্য নিদর্শন হাতে নিয়ে সেখান থেকেই কুসংস্কারকে মনের মধ্যে বসিয়ে নিচ্ছেন, প্রতিনিয়ত।

     


    ২০২০-র বিখ্যাত রিং অফ ফায়ার

     

    কত যুগ আগে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় “সত্য ও অসত্য’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন,

     

    “প্রায় অর্ধ-শতাব্দী ধরিয়া আমি অধ্যাপনার কাজ করিয়া আসিতেছি এবং সেই উপলক্ষে কত হাজার হাজার ছাত্রকে বুঝাইয়া দিয়াছি যে, সূর্য এবং চন্দ্র গ্রহণ রাহুনামক কোনো রাক্ষসের ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টায় সংঘটিত হয় না, এবং শেষে মর্ত্যবাসীদের কাঁসর, ঘণ্টা, ঝাঁঝর এবং খোল - করতালের সহযোগে পূজা-অর্চনায় রাক্ষসাধিপতি রাহু তৃপ্ত এবং তুষ্ট হইয়া চন্দ্র - সূর্যকে ছাড়িয়া দেওয়ার ফলেই তাহার মুক্তি সংঘটিত হয় না। এই যে জনশ্রুতি - ইহা নিছক মিথ্যা এবং কল্পনাপ্রসূত।

    প্রায় অর্ধ-শতাব্দী ধরিয়া ছাত্রদিগকে এই বৈজ্ঞানিক সত্যের ব্যাখ্যা করিয়া বুঝাইয়া আসিলাম। তাহারাও বেশ বুঝিল এবং মানিয়া লইল, কিন্তু গ্রহণের দিন যেই ঘরে ঘরে শঙ্খ ঘণ্টা বাজিয়া উঠে এবং খোল-করতালের সহযোগে দলে দলে কীর্তনীয়ারা রাস্তায় মিছিল বাহির করে, অমনি সেই সকল সত্যের পূজারীরাও সকল শিক্ষাদীক্ষায় জলাঞ্জলি দিয়া দলে দলে ভিড়িতে আরম্ভ করে এবং ঘরে ঘরে অশৌচান্তের মতো হাঁড়িকুড়ি ফেলার ধুম লাগিয়া যায়।

    আমি অশিক্ষিত অথবা নিরক্ষর লোকের কথা বলিতেছি না, কারণ যুক্তির দ্বারা সত্য মিথ্যা বাছিয়া লইবার মতো শিক্ষা বা সামর্থ্য তাহাদের নাই। কিন্তু যে জাতির শিক্ষিত সম্প্রদায় সত্য কী তাহা জানে, অথচ জীবনে তারা বরণ করিয়া লইতে প্রস্তুত নহে, যে মনের গোপনে সত্যের নিকট লজ্জায় মস্তক অবনত করিতেছে, অথচ বাহিরে জনসমাজে এবং সভার মাঝারে তাহাকে স্বীকার করিবার সাহস নাই- সে জাতি কেমন করিয়া জগতের নিকট সগর্বে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইবে, তাহা আমার বুদ্ধির অতীত।

     

    তাঁর মতো প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি যা করে দেখাতে পারেননি, সময় হয়তো তা একদিন করবে। এমনই বিশ্বাস ছিল। কিন্তু যে দেশ ক্রমশ পিছনের দিকে এগোচ্ছে, সময় তার কী করবে! যে দেশে ক্যান্সার নিরাময়ের জন্য গরুর প্রথম প্রস্রাব পান করতে হাতে ঘটি নিয়ে মানুষ গোয়ালের বাইরে লাইন দেয়, সেখানে কোনও বিজ্ঞান, কোনও যুক্তি, কোনও মহাপুরুষের বাণীতে কাজ হওয়ার নয়। এ এমন এক অন্ধকার, যা সূর্যের আলোতেও দূর হওয়ার নয়। গ্রহণের সময় তো আবার সেই আলো কমে যায়।

     

    তাই না!

     

     


    রজত কর্মকার - এর অন্যান্য লেখা


    এমনিতেই মোদীবাবুর গুণের শেষ নেই। এত গুণের সঙ্গে তিনি কি ভবিষ্যৎদ্রষ্টাও?

    দেশের মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে, তাদের তো গুলি করেই মারা উচিত, তাই না?

    2018 সালে সাংসদ আদর্শ গ্রাম যোজনায় চতুর্থ গ্রাম হিসাবে দোমারি-কে দত্তক নেন নরেন্দ্র মোদী।

    করোনার কালো গ্রাসে এ বছর সবই গিয়েছে। না রয়েছে বিক্রেতাদের পসার, না হয়েছে মেলা, বাতিল হয়েছে বাউল গান

    স্টেশনে পুলিশের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রত্যেক যাত্রীর ই-পাস দেখে তবেই স্টেশনে প্রবেশের অনুমত

    ৫ জানুয়ারি রবিবার সন্ধ্যায় জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে মুখ ঢাকা গুন্ডাদের আক্রমণের পর এ ভাষায় গর্জে

    আমরা এগোচ্ছি, কিন্তু পিছন দিকে-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested