×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • রামচন্দ্র যখন পরাজিত

    রজত কর্মকার | 05-10-2020

    প্রতীকী ছবি।

    সন্তান সন্ততি নিয়ে সুখের ভরা সংসার। বাইরে থেকে দেখে অন্তত তেমনটাই মনে হয়। তবে সুখী সম্পর্কের তলে তলে চোরাস্রোত সবসময় বইতে থাকে। কয়েক হাজার বছর পেরিয়ে গেলেও সীতা তাঁর স্বামী রামচন্দ্রকে ক্ষমা করতে পারেননি। বাগানে এক হরিণ শাবককে খাওয়াতে ব্যস্ত ছিলেন সীতা। সে সময় রাম তাঁর কাছে এসে বসেন। রামের উপস্থিতি টের পেয়ে সীতা সংযত গাম্ভীর্যের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলেন। এর পর যা যা কথোপকথন হল তা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।

     

     

    রাম: কেমন আছ প্রিয়ে?

    সীতা: ভালই তো। খারাপ তো আর বলতে পারব না। মিথ্যে আমি বলি না। তবু আপনার যদি বিশ্বাস না হয় তবে দাস-দাসী বা অনুচরদের জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারেন।

     

     

    রাম: এ কেমন কথা সীতে...! তোমার সংবাদ আমি অনুচর মারফত জানব কেন? সাধারণের কাছে তাহলে কেমন বার্তা যাবে বলো? তুমি কি আজও আমায় ক্ষমা করতে পারোনি?

    সীতা: আপনি হলেন প্রভু, আমার স্বামী। আপনাকে ক্ষমা করব না এত সাহস আমার আছে? ক্ষমা করা বা না করা তো আপনার অধিকারভুক্ত। আপনি ভাল করেই জানেন আমি মিথ্যা বলি না। তবুও...

     

     

    রাম: তবুও কী সীতা? এতদিন আগেকার ক্ষোভ তুমি আজও ভুলতে পারলে না?

    সীতা: নিজেকে আমার স্থানে রেখে তবে এই প্রশ্ন করুন। প্রজাদের মন রাখার জন্য আগুনের উপর আমায় যে দিন হাঁটতে বললেন আপনি, আমার সতীত্বের পরীক্ষা দিতে বললেন, সে দিনও কিন্তু আপনার উপর কোনও ক্ষোভ জন্মায়নি আমার। কিন্তু আমি যখন গর্ভবতী, তখন আমায় আবার ত্যাগ করলেন। একবার জানতেও চাইলেন না আমাদের সন্তান কেমন আছে। আমার ছেলেরা যখন আপনার ঘোড়া আটকে রাখল সেদিন রণাঙ্গনে ওদের সঙ্গে আপনার প্রথম সাক্ষাৎ। বাহ্... চমৎকার! আপনাকে যুদ্ধে হারিয়ে যখন তারা নিজের মাতাকে সসম্মানে কোশল রাজ্যে পুনরায় ফিরিয়ে নিয়ে গেল, সে দিন আপনি আবার অগ্নি পরীক্ষা দিতে বললেন আমায়! কতবার? কতবার সতীত্বের প্রমাণ দিতে হয় নারীকে? আসলে আপনার ভক্তরা মনে করে স্ত্রীকে ত্যাগ করার মধ্যেই যাবতীয় গৌরব লুকিয়ে রয়েছে। ছিঃ! ধিক্কার জানাই এমন মানসিকতাকে।

     

     

    রাম: অভিসম্পাত করো আমায়। যা প্রাণে চায় বলো, কিন্তু এমন ভাবে মুখ ফিরিয়ে থেকো না প্রিয়ে। তুমি তো জানো, প্রজাদের সুখ শান্তির জন্য আমি কোনও দিন কোনও ত্রুটি রাখিনি। মর্যাদা পুরুষোত্তম নামে আমায় ভূষিত করেছিল তারা। তাদের সন্দেহ, বক্রোক্তি নিরসন আমায় করতেই হতনা হলে...

    সীতা: না হলে আপনার সম্মান নষ্ট হত, তাই তো? কিন্তু যিনি নিজের স্ত্রীর সম্মান বারবার নষ্ট হতে দেখেও কিছু বলেন না, তাঁকে আপনি কী বলবেন? যিনি স্ত্রীর মর্যাদা রাখতে পারেন না, তাঁকেই বা কী বলবেন? যিনি নিজের সন্দেহভাজন ছেঁদো যুক্তি দেওয়া প্রজার কথা শুনে বারবার স্ত্রীকে সন্দেহ করে তাঁকে আপনি কী বলবেন? আগে এই উত্তরগুলো দয়া করে আমায় দিন। তবে উত্তর দেওয়ার আগে একটা কথা আপনাকে স্মরণ করাই, দয়া করে সাবধানে উত্তর দেবেন। এমন যেন মনে না হয়, আপনি নিজেই নিজেকে গালমন্দ করছেন। তা হলে প্রজারা খানিকটা মর্যাদা কমিয়ে দিতে পারে।

     

     

    অস্বাভাবিক ক্রোধে কথাগুলি এক নিঃশ্বাসে বলে থামলেন সীতা। রামকে মৌন দেখে খানিক বাদে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন,

     

    সীতা: থাক, আপনাকে আর কষ্ট করে কঠিন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে না। যদি আপত্তি না থাকে, তবে আপনার আগমনের হেতু বলুন।

    রাম: (কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে) ক’দিন ধরে নানা সংবাদে বড় বিচলিত বোধ করছিলাম মৈথিলিতাই তোমার কাছে এসেছি। একটু শান্তির খোঁজে।

     

     

    সীতা: আজ্ঞা করুন...। আপনার মানসিক শান্তি ফেরাতে আমি কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?

    রাম: এসব কী শুনছি রমা? এরা বলে এককালে নাকি আমি ওখানে রাজত্ব করেছি। আমার রাজত্বে প্রজারা যেমন সুখী ছিল, এরা সেই সময়ের সঙ্গে এখনকার সমাজের তুলনায় টানছে। রামরাজ্য বলছে একে। এত নৃশংস মানুষ হতে পারে? পশুরা ক্ষুধা নিবারণের জন্য শিকার করে, কিন্তু তাকে হত্যা বলা যায় না। তবে মানুষ হয়ে এমন আচরণ কীভাবে করতে পারে এরা? মানুষ শব্দের অর্থ কি সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছে এদের?

     

     

    সীতা: মহারাজ, দু’ পায়ে হাঁটা সমস্ত জীবকে যদি আপনি মানুষ আখ্যা দেন, তবে আসল মানুষরা হাসবে যে! আপনার রাজত্বের সময় থেকেই বর্ণাশ্রমের যে বিষাক্ত বীজ বপন করা হয়েছিল, তা আজ মহীরুহে পরিণত হয়েছে। এটা তো ভবিতব্য। মানবরূপী কিছু নরকের কীট আজও সকলকে মানুষ ভাবতে পারে না। তারা তথাকথিত জাতপাত নিয়ে বড়ই গৌরবান্বিত। তারা মনে করে, বর্ণাশ্রমের নীচের দিকে যাঁদের অবস্থান তাঁদের মানুষ হিসাবে কোনও অধিকার নেই। হয়তো ঠিক, কারণ মানুষ তো বড়দের দেখেই শেখে। এরাই তো আপনাকে মর্যাদা পুরুষোত্তম উপাধি দিয়েছিল, তাই না? সেই উপাধির কোনও দাম আছে কিনা আর একবার ভেবে দেখতে পারেন।

     

     

    রাম: এরা আমার জন্মতিথিতে কত উৎসব করে। বিজয়া দশমীতে দশমাথাওয়ালা রাবণের কুশপুতুল পোড়ায়। এসব কি শুধুই দর্শন মাত্র?

    সীতা: এতদিনেও যদি তা আপনি অনুধাবন করতে না পারেন তবে আর বৃথা চেষ্টা করবেন না। আর রাবণের কুশপুতুল পোড়ায়? তাঁকে সসম্মানে পুজো করা উচিত এদের।

     

     

    রাম: কী বলছ জানকী? যে তোমায় অপহরণ করে বন্দি করে রাখল, যার জন্য এত বড় যুদ্ধ হল, তাকে তুমি পুজো করতে বলছ?

    সীতা: ঠিকই বলছি। তিনি আমায় অপহরণ করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু কোনও দিন অসম্মান করেননি। বয়সে অনেক প্রবীণ হওয়ায় তিনি আমায় কন্যাসম দেখেছেন বরাবর। সকলের সামনে না হলেও, আড়ালে তাঁর স্নেহকরুণাময় পিতার হৃদয় আমি অন্তর দিয়ে অনুভব করেছি। আপনি যুদ্ধে জয়লাভের জন্য অকাল বোধনে দেবী মহামায়াকে জাগ্রত করলেন। পুজোর অভীষ্ট সাধনের জন্য ব্রাহ্মণের প্রয়োজন ছিল আপনার। কিন্তু লঙ্কায় ব্রাহ্মণ কোথায় পাবেন আপনি! তবুও পেলেন। কেমন করে বেদজ্ঞ, শাস্ত্রজ্ঞ, মহাপণ্ডিত ব্রাহ্মণ এসে আপনার অভীষ্ট সাধনে আপনাকে সাহায্য করল তা কোনও দিন ভেবে দেখেছেন? আপনি তখন যুদ্ধে জয়লাভ করা ছাড়া আর কিছুই ভাবেননি।

     

     

    রাম: তুমি কি তবে বলতে চাও যে...

    সীতা: বলতে চাই না, বলছি। কারণ তিনি যাওয়ার আগে আমায় গোপনে অশোক বাটিকায় দেখতে এসেছিলেন। চাপা স্বরে তিনি নিজের সঙ্গেই কথা বলছিলেন। তা আমি শুনেছি। তিনি বলছিলেন, ‘আমার মুক্তির দিন সমাবিষ্ট। আজ তারই উপাচারে যাচ্ছি মা। ভাল থাকিস।' তারপর ছদ্মবেশ ধারণ করে তিনি সমুদ্রতটে উপস্থিত হন। বিভীষণও জানতেন সে কথা। মন্ত্রোচ্চারণের সময়ই তিনি সহোদর ভ্রাতাকে চিনতে পেরেছিলেন। কিন্তু তাঁর মুখে একটি শব্দও শোনা যায়নি। আর তাঁকেই কিনা আপনি লঙ্কার রাজা নিযুক্ত করেছিলেন। চমৎকার!

     

     

    সীতার কথা শুনে রাম মাথা নিচু করে খানিক ক্ষণ স্থবির হয়ে রইলেন। সীতা আবার বললেন,

     

    সীতা: কখনও ভেবে দেখবেন, যদি রাবণের স্থানে আপনার এই ভক্তরা আমায় অপহরণ করত, তবে এক বছর দূরস্থান, এক দিনের মধ্যে আমার কাটা জিভ, ক্ষত বিক্ষত, টুকরো করা বা জ্বালিয়ে দেওয়া দেহ হয়তো আপনাকে পথের ধার থেকে কুড়িয়ে নিয়ে আসতে হত

    রাম: সীতে! (রীতিমতো আঁতকে উঠে)

     

     

    সীতা: ভয় পেলেন প্রভু? না আমার জ্বলে যাওয়া, ক্ষত বিক্ষত দেহের কথা ভেবে শিউরে উঠলেন? নাকি আমায় শুধুমাত্র ভোগ্যবস্তু হিসাবে ছিঁড়ে খাওয়ার মানসিকতায় আপনি ভীত হলেন?

    রাম: সবই সীতা, সবই...। সব মিলিয়ে আমি লজ্জায়-ঘৃণায় কুণ্ঠিত হয়ে রয়েছি। এতদিন এদের পুজো গ্রহণ করেছি ভেবে নিজেকে অপবিত্র-অশুচি মনে হচ্ছে রমা। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। তুমি আমায় ক্ষমা করো প্রিয়ে, আমায় ক্ষমা করো।

     

     

    রামের এ অবস্থা দেখে বহু যুগ পর সীতার মুখ থেকেও কয়েকটি সহানুভূতির বাণী শুনলেন রাম। তিনি বললেন...

     

    সীতা: এদের জন্য নিজেকে অশুচি-অপবিত্র ভাববেন না। আসলে এরা আপনার চরিত্রের সহানুভূতি সম্পন্ন দিকগুলোকে আপনার চারিত্রিক দুর্বলতা ভেবে নিয়েছে। তাই আপনার আমাকে ত্যাগ করার সিদ্ধান্তকেই শুধু এরা বড় করে দেখেছে। আপনার চারিত্রিক দৃঢ়তা, সুশাসনের চিন্তাকে এরা সম্মান করেনি। তাই আজও যদি কেউ নিজের স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে তাকে এরা মহান প্রতিপন্ন করার নিরন্তর চেষ্টা করতে থাকে। যে নিজের স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, তবে সে অন্য কোনও দায়িত্ব পালন করতে পারে না, এ সহজ সরল সত্যিটা তারা বোঝে না। এরা আরও বোঝে না, যারা সন্তান শব্দের অর্থ বোঝে না, তারা অন্যের সন্তান হারানোর দুঃখ বেদনা কোনও দিন বুঝবে না। কাঞ্চনমূল্যে সেই দুঃখ আর নির্যাতিতার পরিবারের সম্মান কেনার চেষ্টা করবে। এটাই হচ্ছে, এটাই হয়ে আসছে। আপনি হয়তো এতদিনে দেখতে পেলেন।

     

     

    সীতার কথা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন রাম। তিনি বলেন...

     

    রাম: আমি এদের কথা শুনে তোমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করেছি! ধিক্, শত কোটি ধিক্ আমায়। ছিঃ ছিঃ! ওরা কোনও দিন ভেবে দেখেনি, রাবণকে পোড়ানোটা আসলে প্রতীকী। ওই দিন অশুভ শক্তির উপর শুভ শক্তির জয় হয়েছিল। নিজের মধ্যে যে অশুভ শক্তি রয়েছে তাকে হারিয়ে, তাকে পুড়িয়ে দেওয়ার দিন ওরা আতসবাজি পুড়িয়ে আনন্দ করে। যারা আমায় মনের মধ্যে রাখতে পারে না, তারাই চিৎকার করে আমার ভক্ত বলে পরিচয় দেয়। এর চেয়ে মৃত্যুও শ্রেয়। এই দেশে একদিন আমি জন্মেছিলাম, তা ভেবেও নিজেকে নরাধম পাপী মনে হচ্ছে প্রিয়ে। আমি হেরে গিয়েছি রমা, আমি হেরে গিয়েছি...

     

     


    রজত কর্মকার - এর অন্যান্য লেখা


    মাননীয় হঠাৎ আটের আস্ফালন ছেড়ে ৯-এর ঘাড়ে চড়ে বসলেন কেন? কারণ নিশ্চয়ই আছে।

    আমিও তোমায় অভিশাপ দিচ্ছি, ঢপেন্দ্র ছোদ্দা, তুমিও 56-র গেরোয় আটকে যাবে বারবার।

    এ বার নিজের দফতরের দায়িত্ব নিচ্ছেন দিয়েগো... এল দিয়েগো... দ্য গ্রেট দিয়েগো...

    সম্প্রতি দিল্লিতে হিন্দু মহাসভা ‘ভগবানের অবতার করোনা ভাইরাস’ থেকে বাঁচতে গোমূত্র পার্টি অরগ্যানাইজ ক

    খাদ্য-খাদক সম্পর্ক না থাকলেও যে এ ভাবে অন্য প্রজাতির খাবার লোপাট করা যায়, তা দিল্লি গেলে বুঝবেন।

    পোধানমন্তীর ডাকে সাড়া দিয়ে ঘটি-বাটি-খোল-করতাল-কাশি-বাঁশি সব নিয়ে দলবল-সহ বেরিয়ে পড়েছিলেন রাস্তায়।

    রামচন্দ্র যখন পরাজিত-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested