×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • শ্রমবাজারে পিছিয়ে ভারতের নারী

    শুভস্মিতা কাঞ্জী | 05-05-2022

    নিজস্ব ছবি

    কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের সংখ্যা কমছে। অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতীয় নারীরা কাজে কম অংশগ্রহণ করছে। ভারতে কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো কমছে। 2005 সালে যেটা 26 শতাংশ ছিল, 2020তে সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমির হিসেব অনুযায়ী সেটা 10 শতাংশেরও বেশি কমেছে। বর্তমানে ভারতের কর্মরত নারীদের সংখ্যা 12 শতাংশ হয়েছে। ভারতীয় মহিলাদের কাজে অংশগ্রহণের হার কয়েক দশক ধরে লক্ষণীয় ভাবে কমছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী এটি 1983 সালে 29.6 শতাংশ ছিল, সেখান থেকে 2011-2012 সালে এটি 21.9 শতাংশে নেমেছে। এবং সাম্প্রতিক সময়ের পিরিয়ডিক লেবর ফোর্স সার্ভের রিপোর্ট অনুযায়ী 2017-2018 সালে এটি 16.5 শতাংশে নেমে আসে।

     

    ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের গ্লোবাল ইনডেক্সের তথ্য অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশের থেকেও কম ভারতের বর্তমান কর্মরত নারীদের সংখ্যা। বাংলাদেশে মহিলারা অনেক বেশি সংখ্যায় কাজে অংশগ্রহণ করছে, 35 শতাংশ। শ্রীলঙ্কায় 31 শতাংশ। নেপালে 75.7 শতাংশ। চিনে 62, ভুটানে 52 শতাংশ। এমনকি পাকিস্তানেও ভারতের তুলনায় মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে যোগদানের সংখ্যা বেশি, 21 শতাংশ।

     

    অন্যান্য দেশ এবং ভারতের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হল এই দেশের অনেক মহিলারাই অন্যান্য দেশের মতো বেতনভুক্ত কাজ করে না। অত্যন্ত কম সংখ্যক নারী কাজে অংশগ্রহণের কারণে ভারতের সামগ্রিক কাজে অংশগ্রহণের হারও কম। ভারতের জনসংখ্যার প্রায় 50 শতাংশ নারী। যদি তাদের একটি বড় অংশ শ্রমবাজারে প্রবেশ না করে তবে আমাদের দেশের কাজে অংশগ্রহণের হার এভাবেই কমতে থাকবে। হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ দ্বারা প্রকাশিত একটি রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে যে নারীদের কর্মক্ষেত্রে প্রতি 10 শতাংশ বৃদ্ধির হলে মজুরিতে 5 শতাংশ বৃদ্ধি হয়। অংশগ্রহণের হার একটি দেশের আরও দ্রুত বৃদ্ধির সম্ভাবনা নির্দেশ করে। 

     

    2020 সালে ভারতে প্রায় 2.1 কোটি মহিলা কাজ ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। অবস্থার আরও অবনতি ঘটেছে করোনা এবং করোনা পরবর্তী সময়ে। যদিও বাস, অটো, ট্রেনে কর্মরত মহিলাদের অফিস যেতে, কাজে জয়েন করতে দেখা যায় তবুও প্রতি বছর কর্মরত মহিলাদের কাজে যোগ দেওয়ার সংখ্যা কমছে। এই দেখা এবং তথ্যের মধ্যে যে অসামঞ্জস্য রয়েছে তার কারণ একটাই, যত সংখ্যক মহিলা প্রতি বছর কাজে যোগ দিচ্ছে বা কাজ করছে তার থেকে অনেক বেশি সংখ্যক মহিলা প্রতি বছর শিক্ষিত হয়ে, গ্র্যাজুয়েশন পাশ করার পর বেকার হচ্ছে। অর্থাৎ কাজে যোগ দেওয়ার মতো মহিলাদের সংখ্যা যে ভাবে বাড়ছে সেই তুলনায় খুবই কম সংখ্যক মহিলা কাজে যোগ দিচ্ছে, ফলে কাজের জায়গায় মহিলাদের শতকরা শতাংশ কমছে। 

     

    ভারত হচ্ছে পৃথিবীর ষষ্ঠ বৃহত্তম অর্থনীতি আমেরিকা, চিন, জাপান, জার্মানি, ইংল্যান্ডের পর। এমনকি রাশিয়া, কোরিয়া ইত্যাদির থেকেও বৃহত্তম অর্থনীতি ভারতের, কিন্তু তাও এখানে মেয়েদের অংশগ্রহণ কর্মক্ষেত্রে চোখে পড়ার মতো কম। যেখানে অর্থনীতিতে ভারত ষষ্ঠ স্থান অধিকার করেছে সেখানে সে মহিলাদের কাজের নিরিখে প্রায় শেষের দিকে রয়েছে আফগানিস্তান, আলজেরিয়া, ইজিপ্ট, ইরান, ইরাকের সঙ্গে। এদের সকলেরই "উইমেন ওয়ার্কফোর্স" ভ্যালু 11 থেকে 15 এর মধ্যে। ভারতের প্রায় কাছেই। অর্থনীতিতে এগিয়ে থেকেও কাজের ক্ষেত্রে মেয়েদের সংখ্যা ভীষণ কম, ভারতের এই অসামঞ্জস্য অত্যন্ত চিন্তার বিষয়। কাজের জায়গায় মেয়েদের অংশগ্রহণের শতকরা শতাংশের হ্রাস দেখেও নীতিনির্ধারক, আইন প্রণেতা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর উদাসীনতা আরও চিন্তার বিষয়। 

     

    পলিসি সলিউশন নারীদের ঋণ নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে স্লেফহেল্প গ্রুপে যোগদান করে নিজেদের আরও অনেক বেশি দক্ষ করে তোলার জন্য। কারণ মহিলারা যত বেশি দক্ষ হবে তারা তত বেশি কাজে যোগ দিতে পারবে। কিন্তু সমীক্ষাগুলি দেখায় যে যখন মহিলারা এই ধরনের কাজ করতে ইচ্ছুক হয় তখন তাদের মধ্যে অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করে যে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, তাদের বেতন এবং কাজের শর্ত এতটাই খারাপ হয় যে তারা কাজ ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।খারাপ নেটওয়ার্ক কানেকশন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা, দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করার কারণ এবং, কর্মস্থানের বিভিন্ন শর্তাবলী, বিশেষ করে মজুরি, ছুটি এবং সাধারণ মর্যাদার অভাবের কারণেও মহিলারা কাজের প্রতি  আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে। 

     

    কাজে অংশগ্রহণে একটা অসমতা ছিলই, করোনা সেটাকে বহুমাত্রায় বাড়িয়ে তুলেছে। গোটা বিশ্ব জুড়ে মহিলাদের কাজে যোগ দেওয়ার যে অগ্রগতি দেখা যাচ্ছিল তা আবার করোনার সময় পিছিয়ে যায়।  করোনার প্রথম বছর অর্থাৎ 2020 সালে বিশ্ব জুড়ে 5.4 কোটি মহিলা কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। এর ফলে কর্মক্ষেত্রে নারী পুরুষ ব্যবধান বাড়ছে। ইন্টারন্যাশনাল লেবর অর্গানাইজেশন এর রিপোর্ট অনুযায়ী মহিলাদের কর্মসংস্থান 4.2 শতাংশ কমেছে গোটা বিশ্বে, পুরুষদের ক্ষেত্রে যেটা 3 শতাংশ। আর এই যে গ্যাপ তৈরি হয়েছে সেটা পূরণ করতে ইন্টারন্যাশনাল লেবর অর্গানাইজেশনের মতে কয়েক প্রজন্ম লেগে যাবে। 

     

     লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ভারতে যে অনুপাতে স্কিলড এবং শিক্ষিত যুবতীদের সংখ্যা বাড়ছে, সেই অনুপাতে কিন্তু বাড়ছে না কাজের জায়গায় তাদের অবদান। ইউনাইটেড নেশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের 2015 এর রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতের গ্রামাঞ্চলের প্রায় 67 শতাংশ শিক্ষিত, গ্রাজুয়েট মহিলা কোনও চাকরি করেন না। শহরে এই শতাংশ খানিকটা বেশি, 68.3 শতাংশ, যারা বেতনভুক্ত কাজের সঙ্গে যুক্ত নয়। ভারতে কাজের জগতে সব থেকে কম অবদান শিক্ষিত গ্রাজুয়েট এবং নিরক্ষর মহিলাদের। এর অর্থ শিক্ষায় যে বিনিয়োগ তারা করছে সেটার রিটার্ন নেই। 

     

     যে পরিমাণ অর্থ শিক্ষায় বিনিয়োগ করা হচ্ছে সেটার অনেকটা অংশই আনপ্রোডাক্টিভ থেকে যাচ্ছে। প্রথমত, করোনার কারণে "চাইল্ড কেয়ার" সেক্টর ভীষণ রকম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে যাদের সন্তান খুবই ছোট, বা সদ্য যারা মা হয়েছে তাদের অনেকটা সময় ব্যয় করতে হচ্ছে সন্তান প্রতিপালনের কারণে। সন্তানকে সময় দিতে গিয়ে কাজে ব্যাঘাত ঘটছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে আয়ে। অনেকে বাধ্য হচ্ছেন চাকরি ছেড়ে দিতে। দ্বিতীয়ত, ভারতের কিছু অংশে এখনও মেয়েদের বাড়ির সম্মান রক্ষার্থে কাজ করতে বাইরে বেরোতে দেওয়া হয় না। আবার অনেকক্ষেত্রে নারীরা শ্রমবাজারে প্রবেশ করতেই চায় না। তারা এমনকি পুরুষদের মতো চাকরি খোঁজে না। একটি সাম্প্রতিক পিউ রিসার্চ রিপোর্ট বলছে যে ভারতে মহিলারা বিশ্বাস করে যে তাদের থেকে পুরুষদের চাকরির উপর বেশি দাবি রয়েছে। ফলে এই কারণেও ভারতে মহিলারা শ্রমবাজারে পুরুষদের তুলনায় কম অংশগ্রহণ করে। তাই তারা শিক্ষালাভ করলেও সেটা কোনও প্রোডাক্টিভ কাজে লাগে না। 

     

    আরও পড়ুন:অকর্মক ক্রিয়ায়, বেকারত্ব বিভক্তি!

     

    ইন্টারন্যাশনাল লেবর অর্গানাইজেশনের মতে গত এক দশক বা তারও বেশি সময় ধরে, ভারত মেয়েদের জন্য শিক্ষার অ্যাক্সেস বাড়ানোর ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি করেছে কারণ কর্মক্ষম বয়সের মহিলারাও মাধ্যমিক স্তরের বিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছেন৷ তা সত্ত্বেও, দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির প্রকৃতির বুঝিয়ে দিচ্ছে দেশের বিভিন্ন সেক্টরগুলিতে প্রচুর পরিমাণে চাকরি তৈরি করা হয়নি যেখানে সহজেই মহিলারা কাজ পেতে পারে, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকার জন্য। এছাড়াও ভারতের বেশিরভাগ মহিলারা বিভিন্ন ভাবে অর্থনীতিতে অবদান রাখে, তবে তাদের বেশিরভাগ কাজ নথিভুক্ত করা হয় না বা সরকারী পরিসংখ্যানে ধরা হয় না।  এই কারণে মহিলাদের কাজ কম রিপোর্ট করা হয়।

     

    2011 সালের ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভের রিপোর্ট অনুযায়ী শহর এবং গ্রামাঞ্চলের এক তৃতীয়াংশ মহিলাই বাড়ির কাজের সঙ্গে যুক্ত, যারা এমন কাজ করতে চায় যেখান থেকে তারা রোজগার করতে পারবেন। কিন্তু বাস্তবে সেটা হয়ে ওঠে না। এর অন্যতম কারণ, মহিলারা পুরুষদের মতো একই কাজ করেও পুরুষদের তুলনায় প্রায় 43 শতাংশ কম রোজগার করে। নারী পুরুষের বৈষম্য এই ক্ষেত্রে স্পষ্ট ভাবে বোঝা যায়। যদিও আমাদের সংবিধান বলে একই রকম কাজের জন্য একই রকম পারিশ্রমিক পাওয়া উচিত। এছাড়াও কোর সেক্টর, অর্থাৎ তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ব্যাঙ্কিং এবং ফিন্যান্স, টেলিকম ইন্ডাস্ট্রিতে মহিলাদের সংখ্যা ভীষণ কম। ইন্ডিয়া স্কিল রিপোর্ট 2017 অনুযায়ী টেলিকম ইন্ডাস্ট্রিতে পুরুষ কর্মীদের সংখ্যা 83.84 শতাংশ, ব্যাংকে 78.79 শতাংশ, গ্যাস, তেল, ইত্যাদি জায়গায় 74.75 শতাংশ।

     

    অধিকাংশ সময় নারীরা কাজ ছেড়ে দেয় বা করে না কারণ তারা তাদের দক্ষতা, শিক্ষা বা যোগ্যতার উপযুক্ত চাকরি খুঁজে পায় না। তারা পুরুষদের তুলনায় একই কাজ করে কম আয় করে। নারীরা কাজ করল কী না সেটাকে ভারত বিশেষ পাত্তা দেয় না। সুযোগের অভাবে হতাশ বেকার নারীদেরকে উপেক্ষা করে সরকার সফল নারীদের দেখায়, তাদের গল্পই সবার সামনে তুলে ধরে।

     


    শুভস্মিতা কাঞ্জী - এর অন্যান্য লেখা


    23°C-এর বেশি তাপমাত্রায় করোনা ভাইরাস ছড়ায় না এমন কোনও দাবি বিজ্ঞানী মহল থেকে আজ অবধি করাও হয়নি।

    নিজের গায়ে আঁচ না লাগা অবধি সবাই গা বাঁচিয়ে চলতে চায়।

    এটাই হেডলাইন। সঙ্গে পাওয়া গেছে এই সুইসাইডের একজন প্রত্যক্ষদর্শী আর একটা চিরকূট। 

    ক্রমাগত ভাঙনের ফলে ফুলহার নদ এবং গঙ্গার ব্যবধান এক কিলোমিটারে এসে দাঁড়িয়েছে

    একদিকে বিশ্ব উষ্ণায়ন, অতিরিক্ত জলের চাহিদা আরেকদিকে বাঁধ নির্মাণ, সবের চাপে পড়ে ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্

    করোনা আবহে ভার্চুয়াল পিকনিকেই ভরসা রাখছে স্কুলগুলি

    শ্রমবাজারে পিছিয়ে ভারতের নারী-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested