×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • দেখিয়া শুনিয়া খেপিয়া গিয়াছি

    সঞ্চারী সেন | 02-03-2021

    প্রতীকী ছবি।

    দেখিয়া শুনিয়া খেপিয়া গিয়াছি

    কবিতার এই লাইনটি যে কাজী নজরুল ইসলামের লেখা একথা প্রায় সকলেই জানেন। শিরোনামটি লিখতে একটু কিন্তু কিন্তু বোধ করছিলাম, ‘বিধর্মীএক কবির কথা বলছি বলে। ইনি আবার একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান’-এর কথা বলে গেছেন কিনা! তবে সম্প্রতি বাংলার রাজনীতিতে যে গো-বলয়ীয়, ভুল বললাম, যে মহারাষ্ট্রীয় গুর্জর দলের আগমন ঘটেছে, তারা এখন বাংলার সকল কবি-সাহিত্যিককেই স্মরণ করছেন সুযোগ পেলেই। কারণ দলটির কর্তাব্যক্তিরা জানেন বাংলা মুলুক বড় সহজ জায়গা নয়। এখানকার অধিবাসীরা কবি-শিল্পীদের অন্নের সংস্থান না করলেও নিজেরা কবিতা খেয়ে বাঁচে। এখনও অনেক মেধাসম্পন্ন মানুষজন অতীতের মনীষীদের মতোই কেরিয়ারের তোয়াক্কা না করে দেশোদ্ধারে মাতে! তাই এই প্রদেশ দখল করতে হলে বাংলা সাহিত্যপ্রেমের ভেক ধরতে হবে। টার্গেট অডিয়েন্সকে ক্যাপচার করতে এটি এক অনস্বীকরণীয় ম্যানেজমেন্টিয় তত্ত্ব!

     

    একটু বিশদে যদি বলি, কানাডিয়ান মনস্তত্ত্ববিদ এরিকবার্নের লেখা একটি বই আছে, যার নাম গেমস পিপল প্লেখেলাধূলারই গল্প তাতে, কিন্তু সেটা মনস্তাত্ত্বিক খেলা। এরিক বলছেন, আমাদের মন মূলত তিনটি ইগো স্টেট বা মানসিক অবস্থানে থাকে। এক-এক সময় এক-এক রকম, কিন্তু মূলত এই তিনটিই। পেরেন্ট, অ্যাডাল্ট ও চাইল্ড বা অভিভাবক, প্রাপ্তবয়স্ক এবং শিশু। আমরা যখন কারও সঙ্গে বাক্যালাপ করি বা অভিব্যক্তির মাধ্যমে মানসিক সংযোগ ঘটাই, সেই আবেগের আদান-প্রদান তখনই সফল হয়, যদি প্রার্থিত জায়গা থেকে আবেগটি আসে। অর্থাৎ, যে মানুষটি মনের দিক থেকে শিশুর মতো দুর্বল, তাকে পিতার মতো, অভিভাবকের মতো ভরসা দেওয়া হলে, তবেই সে সেই কথাটি গ্রহণ করে। আবার হয়তো কেউ প্রবল যুক্তিবাদী, অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্ক মনের অবস্থানে রয়েছে সেই মুহূর্তে (কোনও আঘাত পেলে সেই একই লোক আবার শিশুর অবস্থানে চলে যেতে পারে), তাকে যুক্তি দিয়ে বোঝালে, অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থান থেকেই তার কাছে আবেদন করলে কথাটি তার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়

     

    সকলেই জানেন ভারতবর্ষের গণতন্ত্র সত্তর বছরেও শৈশবেই রয়ে গেছে। তাই দেশবাসীর কাছে এখনও পর্যন্ত যুক্তির চেয়ে, অর্থনৈতিক তত্ত্বের চেয়ে ভরসার মূল্য বেশি! তা সে যত অলীক, অসম্ভবই হোক না কেন। সেজন্যই তো ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতির গল্পের অবতারণা! আর এই ভরসা জোগানো, আমি তোমাদেরই লোক বোঝানোর জন্যই এত সব খেলা। শোনা যাচ্ছে আলোচ্য দলটির পক্ষ থেকে তামিলনাড়ুতেও তাদের ভাষায় কথা বলার চেষ্টা চলছে। বাংলার তবু হিন্দির সঙ্গে কিছু সাযুজ্য রয়েছে, তামিলে যে কী কাণ্ডকারখানা চলছে...! বাংলার দৃষ্টান্ত দেখে তা নিয়ে ভাবতেই ভয় হয়!

     

    বাংলায় ফিরে আসি। এখানে এঁরা সাহিত্যপ্রেমের খেলাটা খেলছেন নানাভাবেই। যেমন ধরুন, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় যে আসলে ঔপনিবেশিকছিলেন, সে কথা জানানোর মাধ্যমে, কিংবা গুরুবরটেগোরের চলায় চলায়’-কে চোলাই চোলাইবলে নেশা ধরানোর চেষ্টা করিয়ে এবং পরমুহূর্তেই নেশাগ্রস্ত বলেই হয়তো পায়ের বেগে অতি দ্রুত চলার ফলে বেসামাল হয়ে পড়ে গিয়ে নিতম্বদেশ কেটে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটানোর মধ্য দিয়ে!

     

    কী বললেন? বাজে কথায় কান না দিয়ে বাঙালির উচিত গর্বিত হওয়া? গর্ব এজন্য যে, একজন অন্য ভাষার মহান পুরুষ, বিকাশ পুরুষ, তাঁর অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও সময় করে নিয়ে বণিক শিরোমণিদের সঙ্গে বৈঠকের ফাঁকে, অবাধ্য অনমনীয় কৃষকদের উৎপাতের মধ্যেও বাংলা কবিতা মুখস্থ করে আবৃত্তি করছেন বলে?

     


    বাঙালিকে আর কত নিচে নামাবেন ভাই? একেই তো আত্মবিস্মৃত জাত! গত এক দশকে এই বিস্মরণের ভারা পরিপূর্ণ হয়েছিল বলেই মনে করছিলাম, কিন্তু  দেখছি, ‘রজনী এখনও বাকি...’

     

    একথা তো ভুললে চলবে না যে, বিভ্রান্তি আগেও ঘটেছে। 1946 সালে গান্ধীজিকে রবীন্দ্রনাথের ফলের রস খাওয়ানো, ডহরবাবুর খোঁজ করা, সভা-সমিতিতে অশুদ্ধ উদ্ধৃতি, সবই তো ঘটে চলছিল, উদ্রেক করছিল কৌতুকেরও, কিন্তু সে সব কিছুই ঘটছিল বাংলার পরিবর্তন’-এর পরেই। ভুললে চলবে না, এই ক্ষমতা দখলের জন্য বাংলারই ইনটেলিজেনসিয়া বা একাংশের বিদ্বৎজনেদের সাহায্য নেওয়া হয়েছিল, সেখানে কোনও ফাঁকিবাজি চলেনি

     

    আরও পড়ুন: বিজেপির বাঙালি হওয়া

     

    কিছুটা অবিবেচনাপ্রসূত কাজ তারও আগে হয়েছে। সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতের লোকেদের অন্তর্লীন বিশ্বাসের ওপর আস্থা না রেখে শিবিরভুক্ত করার চেষ্টায়। কিন্তু সে সব আলোচনার অবকাশ অন্যত্র। সত্যি কথা বলতে গেলে, বাংলার নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এমন দুর্যোগ কখনও আসেনি, যেমন আজ ঘটছে

     

    অন্য ভাষার সাহিত্যকর্মের প্রতি প্রেম কোনওকালেই কোনও অপরাধ নয়। বরং আনন্দের। বাংলার সাহিত্যকারদের মধ্যে ভারতীয় ভাষায় সবচেয়ে বেশি অনূদিত সম্ভবত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এমনকি প্রেমচন্দের মতো সাহিত্যিকও ছিলেন তাঁর প্রবল অনুরাগী। তাছাড়াও প্রগতি লেখক আন্দোলনের অন্য ভাষার লেখকেরা রবীন্দ্রনাথের কবিতার অনুবাদ করেছেন স্ব-স্বভাষায়। তাঁদের পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে ইংরেজির সঙ্গে বিভিন্ন ভাষায় তাঁর আশীর্বাণীর তর্জমা।

     


    শরৎচন্দ্রের কথায় মনে পড়ল, তাঁর সামতাবেড়ের বাড়িতে অনেক বইয়ের মাঝে দেখেছি বেশ কয়েকটি খণ্ডে Sexual Psychology of Women’ নামের একটি গ্রন্থ। অর্থাৎ নারী সনাতনী হোক বা আধুনিক, তাদের মনস্তত্ত্ব বুঝতে শরৎচন্দ্র এই বইটিও পড়েছিলেন! বাঙালি! যৌনতার ক্ষেত্রেও আধুনিক! এদের লাভ জেহাদবা মনুবাদ খাওয়ানো খুব মুশকিল। মুশকিল, ভ্যালেনটাইনস ডে-তে পার্কে মেলামেশায় বারণ করায়। এমনকি, এখনকার প্রজন্ম সমকামিতার বিষয়েও যে চিন্তা পোষণ করে, তা থেকে তথাকথিত হিন্দুত্ববাদীরা কোটি যোজন দূরে

     

    বাংলা অজ্ঞানতাকে ঘৃণা করে। গরুর দুধের সোনাকে মূর্খের ভাষণ বলে বুঝে নিতে তার কোনও অসুবিধে হয় না। সে এও বোঝে, বাংলার দলীয় কর্মকর্তা, যাঁরা বিদ্যাসাগরকে দিয়ে সহজপাঠ লেখান, তাঁদের মূর্খতা ভুলিয়ে দিতেই এইসব অসম্ভব আবৃত্তির পিছনের খেলাটি। সন্ন্যাসীর ভেকধারী রাবণ ভুলিয়েছিল সাদাসিধে সীতাকে, ভোলাভালা বাঙালি যেন সেই ফাঁদে পা না দেয়! অর্থনৈতিক কারণে অসহায় তার মনটিকে যেন কোনও অলীক অভিভাবকীয় ছলনা ভোলাতে না পারে

     

    ওরে গ্রহবাসীবলে ডাক দিয়ে কোনও দুর্গ্ৰহ আমাদের বাংলাকে অপহরণ করতে পারবে না, এমনটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সেইসঙ্গে বেনিয়াবৃত্তিকে পরিত্যাগ করে জনকল্যাণের নামে নিজস্ব সোনার হরিণের জন্য ধাবিত হওয়ার মনোভাবকে বর্জন করতে জানতে হবে

     

    কারণ, শেষত এবং মুখ্যত বাংলা দেশপ্রেমিকদের দেশ!


    সঞ্চারী সেন - এর অন্যান্য লেখা


    বাংলায় ভোটবাক্স ভরাতে বাংলার সাহিত্যিকদের লেখাকেই ‘টোপ’ হিসেবে ব্যবহার করছেন রাজনীতিকরা।

    বাংলার ভোটে সংযুক্ত মোর্চার হার মানেই তার রাজনৈতিক প্রয়োজনের অবসান নয়।

    পেশোয়ারী খানদান আর অভিনয় দক্ষতার বৈচিত্রে তিনিই যেন মিনি ভারতবর্ষ।

    অমৃতসরের এম এ ও (মহামেডান অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল) কলেজের এক লাজুক মুখচোরা অধ্যাপক ছিলেন আপনি ফয়েজ।

    বুলডোজার চালিয়ে দুষ্কৃতী দমনের কথা বলে ভোটে জিতলেন উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথ।

    একালের এক বিচারপতির সভায় পূর্বকালের কবিরা মিলে গেলেন, এ আজও বড় সৌভাগ্যের।

    দেখিয়া শুনিয়া খেপিয়া গিয়াছি-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested