×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • গর্বিত ক্ষত্রিয়ের আজকের অস্ত্র বুলডোজার

    সঞ্চারী সেন | 20-03-2022

    নিজস্ব ছবি

    ভাগ্ওয়া ঝান্ডা- এমনটাই পরিচিতি বিজেপির নিশানের। আসলে গৈরিক পতাকার সমনাম এটি, মারাঠি মূল শব্দ ভাগ্ওয়া কেতন কিংবা কেসরিয়া ধ্বজ! ইতিহাস অনুযায়ী ছত্রপতি শিবাজীর পতাকা ছিল এই রঙের। তাঁকে এ সময়ে নানা হীন কৌশলে হিন্দুত্বের প্রতীক বলে বর্ণনা করা হলেও অনেক ঐতিহাসিকের মতেই তিনি ছিলেন 'সমাজতন্ত্রী ধর্মনিরপেক্ষ'‌। যেমন সাধারণ মানুষের প্রতি ছিল তাঁর দরদ, তেমনই বিশ্বাস ছিল ধর্ম নির্বিশেষে, সকলে মিলেমিশে শাসনযন্ত্র এবং সামরিক বাহিনী পরিচালনায়। এমন দূরদর্শী না হলে কি আর তাঁর রাজত্ব এখনকার পাকিস্তানের একটি অঞ্চল থেকে দক্ষিণে তামিলনাড়ু পর্যন্ত বিস্তৃত হয়!

     

    তবে সে অন্য প্রসঙ্গ, কিন্তু ভাগ্ওয়া ঝান্ডা শব্দটার মধ্যে কেমন এক সন্ত্রাস লুকিয়ে আছে। আমার মন এটি নিয়ে প্রথম সন্ত্রস্ত হয়েছিল একটি ঘটনায়। তখন কয়েক মাস আগে মাত্র বাবরি মসজিদ ভাঙা হয়েছে। সে সময় আগ্রার বাজারে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের একটা বড় আকারের মিছিল দেখেছিলাম। সে মিছিলের লোকেরা গৈরিক পতাকা কাঁধে নিয়ে গর্জন করছিল। সে গর্জনে মিশে ছিল পূজামন্ত্রের স্বর।

     

    আমাদের সেদিনের রিকশাচালকের নাম ছিল রাম সেবক। ভেবেছিলাম সেও নিশ্চয়ই সংকীর্ণ রামভক্তদের একজন হবে। কিন্তু সে দৃঢ় গলায় জানিয়েছিল, " হম মেহনতকে পূজারী হ্যাঁয়, মেহনত হি হমারে ঈশ্ওয়র হ্যাঁয়!'

     

    সে কি কমিউনিস্ট ছিল? জানা হয়নি। এমন জরুরি কত প্রশ্নই অজানা রয়ে যায়! অথচ এই একটি অমোঘ বাক্যই  তো যে কোনও দাঙ্গা ঠেকিয়ে দিতে পারত। এখনও যে কোনও মুহূর্তে এই একটি বিশ্বাসই ধূলিসাৎ করে দিতে পারে ধর্মের নামে  ধ্বংসযজ্ঞের গৈরিক চক্রান্তকেওআমরা সেদিন সে শহরে বহিরাগত ছিলাম। মিছিলের সামনে পড়ে আতঙ্কের এক চোরা হিমস্রোত নেমে গিয়েছিল শিরদাঁড়া দিয়েএমনই ‌শীতল এক আতঙ্ক কি কাজ করে এদেশের তথাকথিত সংখ্যালঘুদের মনেও? হঠাতই নিজভূমে পরবাসী হয়ে যাওয়া ভারতবাসীর একাংশের হৃদয়ে? উত্তর খুঁজে চলি।

     

    সামনে মেলে ধরা কয়েকটি উর্দু দৈনিক, সংখ্যার হিসেবে চার, সেখানেই খোঁজ চলে অবিরাম। বুলডোজারের রাজনীতি। সম্ভাব্য মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ হুমকি দিয়েছিলেন নির্বাচনী সভায়, ভোট শেষে আবার বুলডোজার বেরোবে এবং চিহ্নিত লোকেরা নিশ্চিতভাবে পড়বে সেই বুলডোজারের মুখে। যোগীর বক্তব্যের উদ্দিষ্ট অংশ হলেন সিএএ বিরোধী প্রতিবাদকারী এবং মূলত সংখ্যালঘু মানুষ, এর আগে যাঁদের বসতি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

     

    আরও পড়ুন:বিজেপি-র হয়ে ভোটের প্রচারে আম্বানির রিলায়েন্স

     

    এ প্রসঙ্গে নির্বাচন চলাকালীন "আওয়ামী নিউজ' নামক একটি পত্রিকা, "বুলডোজার কী সিয়াসত ইয়া...?' এই শিরোনামে লিখছে, "... বিজেপির উচ্চতম নেতৃত্বের জন্য খবর, গোটা রাজ্য জুড়ে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ এখন এমন তীব্র যে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে ফারাক তৈরির সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। সে জন্য এবার বিজেপির সরকার হওয়া তো দূরস্থান, একশোটা সিট পাওয়াও মুশকিল হয়ে যেতে পারে!'

     

    ফল প্রকাশের পর সহৃদয় পাঠক এই মন্তব্যকে নিশ্চয়ই পরিহাস করবেন না। ওই যে বলছিলাম, এক অন্তর্লীন আতঙ্ক ছড়িয়ে রয়েছে এদেশের অ-হিন্দুধর্মী মানুষের মনে। যে কোনও সময় বিপন্ন হতে পারে তাঁদের অস্তিত্ব। হতে পারে "জান ও মালের লোকসান'। মুজঃফরনগরের ঘটনা তো আজও অতীত নয়, যেভাবে জার্মানির ইহুদি বর্জনের কায়দায় মুসলমানদের ভোটকে সংকুচিত করা হয়েছে, তা অকল্পনীয়! অবশ্য গুজরাত গণহত্যায় এই ফর্মূলাই প্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল, এবং তা হয়েছিল আরও বিস্তৃত রূপে!

     

    কিন্তু ভোটের কী মহিমা, এই যোগীজিই আবার শেষ দফার ভোটের আগে শাক্ত থেকে পরম বৈষ্ণবের রূপ ধারণ করলেন! বললেন, "ম্যায় মুসলমানোঁ সে পেয়ার করতা হুঁ, অওর মুসলমান মুঝসে'!! (সূত্র:দৈনিক রাষ্ট্রীয় সাহারা)

     

    আহা কী অসাধারণ প্রেমের বাণী, যত বড় মিথ্যেই হোক না কেন, শুনে কিছু লোকের তো কান জুড়োয়! যেমন দরবারী মিডিয়ার (শাসকের স্নেহধন্য মিডিয়া উর্দু সংবাদপত্রে এভাবেই উল্লিখিত হয়), কিংবা মোদী ও যোগীভক্ত মনুষ্যকুলের। আসলে  আশি এবং কুড়ি শতাংশের তত্ত্ব দিয়ে বিপাকে পড়া যোগী ভোটের শেষ লগ্নে ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে চেয়েছেন, এমনটিই অনুমান করছে সংবাদপত্রটি।

     

    আরও পড়ুন:ছদ্ম খবররূপী বিজ্ঞাপনের প্রভাবই বেশি

     

    তবে একা রামে রক্ষা নেই, সুগ্রীব দোসর, যোগীজি একা নন, মোদীজিও গিয়েছিলেন চরম মেরুকরণ সম্পন্ন করতে! এ প্রসঙ্গে একটি বিশেষ ধরণের প্রচারের উল্লেখ না করলেই নয়! উর্দু পত্রিকার সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, রীতিমতো আপত্তির সুরেই, মোদী আদালতের বিভিন্ন রায়কে নিজেদের অর্থাৎ বিজেপির সাফল্য বলে বর্ণনা করেছেন বিভিন্ন সভায়। এর মধ্যে পড়ে বাবরি মসজিদের জমি সংক্রান্ত মামলা, আহমেদাবাদে ধারাবাহিক বিস্ফোরণের রায়, হিজাব সম্পর্কে তখনও পর্যন্ত নিম্ন আদালতের রায় ইত্যাদি। বাবরি মসজিদ এমনিতেই একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর জায়গা, হিজাবও কিছুটা তাই, সেই ক্ষেত্রে ক্রমশ অধিকার সংকুচিত হওয়ার অপমান যে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের কতটা বুকে বাজে, সেটা বোঝার মতো সংবেদনশীলতা  মোদী বা যোগীর নেই। না ভুল বললাম, তাঁরা তো খয়েরি হাফপ্যান্ট কষে মুসলমান বিতাড়নে নেমেছেন, এতটাই হিংস্র সে অ্যাজেন্ডা যে এই প্রচারের ফলে যে আদালতকে প্রভাবিত করার সম্ভাবনার কথাও বিরোধীদের মনে আসতে পারে, তাতেও ভ্রূক্ষেপ নেই। এমনই উদগ্র সে প্রচার! মোদী এমনকি আদিত্যনাথকে "সখ্ত মিজাজ' ও "তংগ্ মিজাজ', রাফ অ্যান্ড টাফর অভিধা দিয়েছেন। আওয়ামী নিউজ' লিখছে, "আদিত্যনাথ  এমনিতে সাধু এবং যোগীর পোষাক পরলেও আসলে নিজের যুদ্ধবাজ উন্মত্ততা ও ক্ষত্রিয়তার কারণে তিনি গর্বিত। তাঁর পছন্দের শব্দ "বুলডোজার'।

     

    সেই "বুলডোজার', যা অনুকূল পরিস্থিতিতে আবার গুঁড়িয়ে দেবে সংঘ পরিবারের উদ্দিষ্ট তিন প্রধান শত্রুর আবাস, মুসলমান, কমিউনিস্ট এবং ক্রিশ্চিয়ানের। আর সে জন্যই উর্দু সংবাদপত্রগুলো বারবার লিখেছে, নিজেদের আশ্বস্ত করতে চেয়েছে এই বলে যে, বিজেপির আসন টলমল, আরএসএসের তাঁবুতে "কোহরাম' অর্থাৎ কান্নাকাটি পড়ে গেছে! সাইকেল নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই!

     

    পাশাপাশি অবশ্য এমন কথাও লেখা হয়েছে যে "ইলেকশান মে আওয়ামী রুঝান কা অন্দাজা আসান নেহি।..' অর্থাৎ জনমানস পাঠ করা খুব সহজ হচ্ছে না। "অখবার ই মশরিক' এ প্রকাশিত এই নিবন্ধটিতে অবশ্য শুধু উত্তর প্রদেশ নয়, দেশের অন্যান্য রাজ্যগুলির কথাও বলা হয়েছে, যেখানে যেখানে নির্বাচন হয়েছে। এই কাগজটির মতো অন্য কাগজেও বাংলার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বেনারস গমন নিয়ে উৎসাহ প্রকাশ করা হয়েছে। বড় খবর হয়েছে প্রিয়ঙ্কা গান্ধীকে নিয়েও। অখিলেশ যাদবের অগ্রগতির খবরও প্রকাশিত হয়েছে বারংবার।

     

    বাংলা কাগজে যখন  "দাবাং যোগী'র সাম্প্রদায়িক অতীতের কথা উঠে আসছে, তখনও উর্দুভাষী মানুষ আশায় বুক বাঁধছেন সুদিনের, "ইউপি মে সিম্ টেগী বিজেপি', উত্তরপ্রদেশে সংকুচিত হবে বিজেপি, ক্ষীণ আশা ছিল এক্সিট পোলের ফল বেরোনোর পরেও। সে আশা কি আমাদেরও ছিল না!

     

    আরও পড়ুন:শাসকের জন্য বিজ্ঞাপনের রেটও সস্তা!

     

    তার পরের ঘটনা তো সকলেরই জানা। ‘ভাগওয়া লহর’! গৈরিক লহরী। তবে আশার কথা, ফলাফলে পশ্চিম উত্তর প্রদেশে কৃষক আন্দোলনের প্রভাব যেমন পড়েছে, তেমনি মুজঃফ্ফরনগরের তিন সাম্প্রদায়িক পান্ডা সু্রেশ রানা, সঙ্গীত সোম এবং উমেশ মালিক পরাজিত হয়েছেন। পক্ষান্তরে নির্বাচনে জেতার পর আরএসএসের নতুন করে উৎসাহ বৃদ্ধির খবর আসা শুরু হয়েছে! কিন্তু সে আর এক কাহিনী।

     

    এক সিনিয়র উর্দুভাষী সাংবাদিক খুব দুঃখ করে লিখেছেন, অধিকাংশ ভারতীয় মুসলমান এখনও সুচিন্তিত ভাবে ভোট দেন না। তাঁদের কাছে এটা এখনও একটা সেলফি তোলার উৎসব! আসলে সিয়াসত বা রাজনীতিই তাঁদের কাছ থেকে এখনও সত্যকে আড়াল করে রেখেছে। নিজের অধিকার বুঝে নেওয়ার প্রক্রিয়া সুদূরেই রয়ে গেছে!

     

    তিনি তাঁর নিবন্ধ শেষ করেছেন দু ছত্রের একটি কবিতা দিয়ে-

    বুঝনে হি নেহি দেতি সিয়াসত হামকো সচ্চাই

    কভি চেহরা নেহি মিলতা

    কভি দর্পণ নেহি মিলতা।

     

    রাজনীতি সত্য থেকে দূরে রেখেছে,

    কখনও মুখ ছিল দূরে

    কখনও বা আয়না।

     

    তবে কি আতঙ্ক আর বাড়বে? বাড়বে হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাস? সে কাহিনীও উঠে আসবে সংবাদপত্রের পাতাতেই। মূল দরবারী মিডিয়ার বাইরে অন্য পরিসরে!

     

    সূত্র: উর্দু সংবাদপত্র-

    অখবার ই মশরিক

    রাষ্ট্রীয় সাহারা

    আওয়ামী নিউজ

    আক্কাস

    এবং বাংলা দৈনিক


    সঞ্চারী সেন - এর অন্যান্য লেখা


    আজও বাস্তব গালিবের সাধের দিল্লীর বিশেষ বিশেষ মহল্লার ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ঘটনা।

    একালের এক বিচারপতির সভায় পূর্বকালের কবিরা মিলে গেলেন, এ আজও বড় সৌভাগ্যের।

    দুর্গা বুকের ছাতি প্রদর্শনকারী বলদর্পী এই ছলনায়কের নাম দিয়েছেন নরাসুর আমোদী। বা সংক্ষেপে নদো।

    বাংলায় ভোটবাক্স ভরাতে বাংলার সাহিত্যিকদের লেখাকেই ‘টোপ’ হিসেবে ব্যবহার করছেন রাজনীতিকরা।

    সত্যি এবারে চৈত্র বড়ই অবহেলায় গেল।

    কিছুদিন আগের জন্মদিনে ইসমতের বয়স হল একশো পাঁচ। কিন্তু আজও কী তারুণ্য তাঁর লেখায়!

    গর্বিত ক্ষত্রিয়ের আজকের অস্ত্র বুলডোজার-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested