×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • সিন্ধুপার থেকে আরবপার, ইউসুফই শাহেনশাহ

    সঞ্চারী সেন | 09-07-2021

    দিলীপ কুমারের স্মৃতিতে

    প্রয়াত আরব সাগরের মায়ানগরীর শাহেনশাহ। তিনি দীর্ঘজীবী হোন। শেষ প্রহরে সমাধিক্ষেত্রে উচ্চারিত হবে মন্ত্র, ‘ইন্ না লিল্ লাহে ওয়া ইন্ না ইলাইহে রাজেয়ুন’, ঈশ্বরের কাছ হতেই এসেছি আমরা, ফিরে যেতে হবে সেখানেই; ঠিক যেন উপনিষদের প্রতিধ্বনি, "আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে... আনন্দস্বরূপ ব্রহ্ম হতেই জন্ম আমাদের, আনন্দেই লয়! হাজির হবেন ধর্মনির্বিশেষে সকল মানুষজন, নামী অথবা অনামী! কোরানের আয়াত এবং গীতার শ্লোক, উভয়ই স্মৃতি থেকে আবৃত্তি করতে সক্ষম এই মহান অভিনেতার শেষযাত্রা তো এমনই হওয়া উচিত, যেসব হিন্দুত্ববাদী এককালে তাঁর সাদা পরিধেয়তে কালি লাগাতে চেয়েছিল, পাকিস্তানের সর্বোচ্চ নাগরিক উৎকর্ষ পুরস্কার নিশান এ ইমতিয়াজকে কেন্দ্র করে, তাদের হটিয়ে দিয়ে, তফাৎ করে দিয়ে!

    পেশোয়ারী পাঠান যে পাঠানের সম্যক পরিচয় বাঙালি মুজতবা আলীর কাছে পেয়েছে। তিনি তাঁর দেশে বিদেশে গ্রন্থে লিখেছেন, “খাস পাঠান কারও জন্যে রাস্তা ছেড়ে দেয় না। সে স্বাধীন।'' সে কারণেই কি মহম্মদ ইউসুফ খান ওরফে দিলীপ কুমার অভিনয়ক্ষেত্রে কাউকে এক ইঞ্চিও জমি ছাড়েননি! পর্দায় যখন তিনি, তখন তো শুধুমাত্র তিনিই, সহ অভিনেতারা তো বটেই এমনকি অপরূপ সুন্দরী অভিনেত্রীরাও সে মুহূর্তে শুধুই তাঁর অনুভূতি প্রকাশের সহায়ক মাত্র, আর কিছু নন। দেখেছিলাম তো, বেশ কিছু বছরের স্বেচ্ছা নির্বাসনের পর ফিরে এসে শক্তি ছবিতে তাঁর শক্তি প্রদর্শন! সে সময়ের এবং এই সময়েরও প্রবল শক্তিশালী অভিনেতা অমিতাভ বচ্চনকে তাঁর সামনে রীতিমতো অসহায় লাগছিল। এক সৎ, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুলিশকর্তা এবং একইসঙ্গে এক স্নেহশীল পিতার অন্তর্দ্বন্দ্ব যেভাবে মূর্ত করেছিলেন ইউসুফ, ভোলা যায় না। অমিতাভকে মনে হচ্ছিল খুব মন দিয়ে অভিনয় শিখছেন তাঁর কাছে। ক্যামেরার সামনে তাঁর মুখের পেশী সঞ্চালন, তাঁর বাচনভঙ্গী, তাঁর কন্ঠস্বরের ওঠানামা। অমিতাভ শুধু নন, পরবর্তীকালে নাসিরুদ্দিন শাহ, শাহরুখ খান, শাবানা আজমি সহ আরও অনেক অভিনেতা অভিনেত্রীই যে মনে মনে তাঁকে শিক্ষাগুরু মেনেছেন, এ কথা স্বীকার করতে কেউ কখনও দ্বিধাবোধ করেননি। এমনই ছিল তাঁর ক্যারিশমা হ্যাঁ, দারুন সুদর্শন না হয়েও শুধুমাত্র একটি বিশ্বাসযোগ্য মুখ এবং অভিনয়গুণে এই মসনদটি তিনি অর্জন করেছিলেন। সে অভিনয় যতটা শরীরী, যতটা মুখমণ্ডলীয়, ততটাই কন্ঠগত! মুম্বই নগরীর প্রথম খান এভাবেই চলচ্চিত্রের ইতিহাসে জ্যোতিষ্ক হয়ে উঠেছিলেন তাঁর জীবদ্দশাতেই!


    জন্ম 11 ডিসেম্বর, 1922 সালে পেশোয়ারে। কিন্তু শুধু পেশোয়ারই তো নয়, মহারাষ্ট্রের দেওলালিতেও ছিল ইউসুফের বাবার বিশাল ফলের খামার। তাই 1930-এ প্রায় গোটা পরিবার চলে আসে সেকালের বোম্বাই নগরীতে। লেখাপড়া হয়েছিল সেখানকারই বার্নস স্কুল ও মুম্বইয়ের গুরু নানক খালসা কলেজে। মাত্র 18 বছর বয়সেই কী এক কারণে পিতার সঙ্গে মতপার্থক্য, ফলে গৃহত্যাগ এবং পুনেতে কয়েক বছরের বসবাস। সেখানে থাকতেন একটি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবারে। বেচতেন অভিনয় নয়, শুকনো ফল এবং স্যান্ডউইচ। তারপর গেলেন বম্বেতে। ভাল ইংরেজি বলতে ও লিখতে পারার কারণে সেনাবাহিনীর লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগ হল, তাদের ক্যান্টিনে কাজ নিলেন। এরপরই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হল বম্বে টকিজের কর্ণধার দেবিকা রানী এবং হিমাংশু দত্তের। তাঁদের জহুরির চোখ! দেবিকার পরামর্শেই ইউসুফ হলেন দিলীপ কুমার। তখন বোধহয় এমন প্রয়োজন ছিল, না হলে আর মধুবালা, মীনা কুমারীদের ইসলামী নাম সম্পূর্ণ গায়েব হয়ে যায় কী করে! যা হোক, সেখানেই দেখা হল আর এক অভিনেতা অশোক কুমারের সঙ্গে, শোনা যায় তিনিই নাকি দিলীপ কুমারকে পর্দায় স্বাভাবিক অভিনয়ের পরামর্শ দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে সেই স্বাভাবিকতা বজায় রেখেই অভিনয়কে একটিমাত্র ম্যানারিজমে সীমাবদ্ধ না রেখে, বহুমাত্রিক করে নিয়ে এক অসম্ভব উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন দিলীপ কুমার। সেই পরিসরে শহরের শিক্ষিত তরুণ, ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ান, কারখানার মেকানিক, সামাজিক পরিস্থিতির চাপে ডাকাত বনে যাওয়া একজন ভাল মানুষ, সঙ্গীতপ্রেমী রাজপুরুষ, মৃদুভাষী কিংবা মরণোন্মুখ ব্যর্থ প্রেমিক, চিত্রকর, চা বাগানের কুলি, গ্রাম্য ধনী, ব্রিটিশ আমলের বিপ্লবী এবং মুগল শাহজাদা সেলিম, সব রকমের চরিত্রই সগৌরবে অবস্থান করছে। কখনও বা একই ছবিতে একাধিক এবং বিপরীতমুখী চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। রাম অওর শাম যার প্রকৃষ্টতম উদাহরণ। 1944-এ প্রথম ছবি জওয়ার ভাটায় তাঁর কেরিয়ারে জোয়ার না এলেও তার বছর তিনেক পরে জুগনুর জোনাকি উড়ে গেল এক অসীম সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের দিকে।

     


    তারপর একে একে প্রায় 60টির মতো ছবি, সংখ্যার বিচারে খুব বেশি নয়, একাদিক্রমে বাছবিচারহীন ছবি করে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না তিনি এবং ভারতীয় অভিনেতাদের মধ্যে নজির আটটি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার, শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে। তাছাড়াও ভারত সরকার প্রদত্ত পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ, দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার তো আছেই! এবং রয়েছে আরও বেশ কিছু দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মান।


    এসব তথ্য এদেশের মানুষের স্মৃতিতে যদি তেমন ভাবে জাগ্রত নাও থাকেতবু রয়ে যাবে এক বিষণ্ণ প্রেমিক, তার স্মরণপটে!

     

    আরও পড়ুন: নীলকন্ঠ পাখিদের ‘অবিচুয়ারি’


    কার পক্ষে ভোলা সম্ভবযখন শাহজাদা সেলিম সমস্ত বাদশাহী রসম ও রিওয়াজ উপেক্ষা করে হাজির হলেন নিতান্তই শাহী পরিবারের এক কানিজ, অর্থাৎ দাসীর কাছে। বললেন...না তারও আগে দেখে নেওয়া যাক সুহানা সফর অওর ইয়ে মৌসম হসিঁ গাইতে গাইতে এগিয়ে আসা তরুণটিকে। ঋত্বিক ঘটকের কাহিনী, সলিল চৌধুরীর সুর, বিমল রায়ের নির্দেশিত ছবি মধুমতী প্রেমের গল্প, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিয়োগান্তক নয়। বড়ই ভাল লাগে দর্শকের শেষ দৃশ্যে ট্রেনের কামরায় ওদের...ছবিটা দেখেই নিন বরং, শোনা যায় ঋত্বিক এক রাতের মধ্যে গল্পটি লেখা শেষ করেছিলেন।


    কিংবা যে ছবিটি শুরু হয়েছিল মহাত্মা গান্ধীর কোটেশন দিয়ে যার মর্ম হল, যন্ত্রকে কখনওই এমনভাবে ব্যবহার করা যাবে না, যাতে তা গ্রামীণ শ্রমকে উৎখাত করে কিংবা মুষ্টিমেয় মানুষকে ধনী করে তোলে। বরং তাকে কাজে লাগাতে হবে সাধারণ মানুষের সুবিধার জন্য। আখতার মির্জার ছবি নয়া দৌড় সেই ছবিতে ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ান শেষ দৃশ্যে লড়াই দিল মোটর গাড়ির সঙ্গে। বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন না তুলে ছবির বার্তাটি ধরা জরুরি


    কিংবা এই বার্তা অর্থেই পয়গাম নামের ছবিটি বলছে, দরিদ্র এবং ধনবান, মালিক এবং শ্রমিক, এই দুস্তর ব্যবধান দূর হওয়া উচিত। নেহেরু যে ধরনের সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন, তারই প্রতিচ্ছবি এইরকম কয়েকটি ছবিতে। সেজন্যই দিলীপ কুমারকে বলা হয় নেহরুভিয়ান হিরো হিরো যখন, এবং ছবি যখন হিন্দি (দুটি বাংলা ছবিতে অভিনয় করেছিলেন, ‘সাগিনা মাহাতো এবং পাড়ি’), তখন নাচ গান থাকবেই এবং রসিক দর্শকমাত্রেই জানেন গ্রামের ঠেঁট হিন্দি গানের সঙ্গে দিলীপ কুমারের কোমরের একটুখানি লচক্, কত কুঁয়ারির হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে দিয়েছে! নয়া দৌড় ছবিতেই যখন তিনি ভ্রু ভঙ্গি করে তুঝে চাঁদ কে বাহানে দেখুঁ, তু ছাত পর আ যা গোরিয়ে বলেছেন, কিংবা গঙ্গা জুমনা ছবিতে ন্যায়ন্ লড় যাইহে গেয়েছেন, তখন আপামর দর্শক বিপুল পরিমাণ হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়েছে। এ দেশের গরিব মানুষকে তাদের মতো করে রোম্যান্স করতে শিখিয়েছেন দিলীপ কুমারের মতো নায়কেরা। প্রেমের জন্য যে জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দেওয়া যেতে পারে তা শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের হাত ধরে ভারতীয় পুরুষদের শিখিয়েছেন দেবদাস দিলীপ কুমার। তাঁর মতো ভাগ্যহীন প্রেমিকের সঙ্গে অশ্রুবর্ষণ করেছে সমগ্র দর্শককুল। এমনই কয়েকটি ছবির জন্য দুঃখী রাজার খেতাব জুটেছে তাঁর। কিন্তু তাঁর অভিনয় প্রতিভার সুবিশাল ক্যানভাসের পক্ষে এইটুকু পরিচয় যথেষ্ট নয়।


    এমন যে প্রেমিক নায়কতাঁর জীবনে একাধিক প্রেম আসবেই। কাজেই সে তালিকায় রয়েছেন নায়িকা কামিনী কৌশল, বৈজয়ন্তীমালা। অনেকদিন রোম্যান্টিক সম্পর্কে আবদ্ধ ছিলেন এবং প্রায় পরিণয় হতে যাচ্ছিল মধুবালার সঙ্গে কিন্তু দুজনের ব্যক্তিত্বের সংঘাতের ফলে শেষ পর্যন্ত সে সম্পর্ক ভেঙে যায়। একমাত্র শর্তহীন প্রেম ছিল সম্ভবত তাঁর থেকে 22 বছরের ছোট সায়রা বানুর, যিনি ফিল্ম দেখেই তাঁর প্রেমে পড়েছিলেন তিনিই রয়ে গেলেন জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। মাঝে দিলীপ কুমার নতুন উষ্ণতার খোঁজে পাকিস্তানের এক নারী আসমার কাছে গিয়েছিলেন বটে, কিন্তু সেখানে তাঁর আকাঙ্ক্ষা যথাযথ মূল্য পাওয়ার পরিবর্তে প্রবঞ্চনাই পেয়েছিল।

    ইউসুফ ভাষা জানতেন একাধিকতার মধ্যে বাংলাও পড়ে গান গাইতেন অসাধারণ, কন্ঠস্বর অনেকটাই তালাত মাহমুদের মতো মধুর লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে ডুয়েট গেয়েছেন মুসাফির ছবিতে, ‘লাগি নহীঁ ছুটে  উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে যথেষ্ট দখল না থাকলে পিলু রাগাশ্রিত এই গানটি গাওয়া একেবারেই সম্ভব হত না। আসলে এমনটাই আমাদের ভারতবর্ষ। যুগল সঙ্গীতের দেশ। সাহির লুধিয়ানভির কথায় ওপি নইয়ারের সুর, পর্দায় দিলীপ কুমার বৈজয়ন্তীমালার যৌথ অভিনয়, কন্ঠে মহম্মদ রফি আশা ভোঁসলে! মাঙ্গকে সাথ তুমহারা ম্যায়নে মাঙ্গ লিয়া সনসার।'

    মুম্বই দাঙ্গার সময় নিজের ঘর খুলে দিয়েছিলেন দুর্গতদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য।

    সেই শাহেনশাহযিনি সমস্ত রসম ও রিওয়াজ উপেক্ষা করে দয়িতা আনারকলিকে বলেছিলেন, ভুল যাও কে তুম এক কানিজ হো, অওর সলিম কো অপনী আঁখোঁ মে উয়ো দেখ লেনে দো যো  তুমহারী জবান কহ্তে হুয়ে ডরতী হ্যায়।' ভুলে যাও তুমি একজন ভৃত্য, সেলিমকে তোমার চোখে দেখতে দাও সেই কথা, যা তোমার কন্ঠ উচ্চারণ করার সাহস পায় না। মিলন হয়নি তাঁর প্রেয়সীর সঙ্গে সেই থেকেই আজও বিষণ্ণ নায়ক।


    আজও মেলেনি এ উপমহাদেশের উঁচু নীচুএদিক ওদিক, এপার আর ওপার। যতদিন না মেলেততদিন তাঁরই ছবির গানের মতো পুরনো পথ থেকে তাঁকে ডেকে আর কী হবে!


    সঞ্চারী সেন - এর অন্যান্য লেখা


    দুর্গা বুকের ছাতি প্রদর্শনকারী বলদর্পী এই ছলনায়কের নাম দিয়েছেন নরাসুর আমোদী। বা সংক্ষেপে নদো।

    শাসন, শুধু শাসনই। দেশভক্ত-দেশদ্রোহী, হিন্দু-মুসলমান, মন্দির-মসজিদের রাজনীতির ওপর সজোরে ঘা।

    সত্যি এবারে চৈত্র বড়ই অবহেলায় গেল।

    আমাদের ছোটবেলায় জন্মদিনে বই দেওয়ার প্রথা ছিল

    চিড়া খাইতে পারুম না ... কী ZE কয় !

    মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সুপ্রিম কোর্টের গর্ভপাত বিরোধী রায় দক্ষিণপন্থী দেশগুলিতে নারীদের উদ্বেগের কারণ

    সিন্ধুপার থেকে আরবপার, ইউসুফই শাহেনশাহ-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested