"আজ সে রাজা কাল সে ফকির’, শ্রীলঙ্কার জন্য এই কথা বোধহয় যথাযথ। কয়েক বছর আগেও যে দেশটি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম উন্নয়নশীল দেশ ছিল আজ তারাই প্রায় গৃহযুদ্ধের সম্মুখীন। আর্থিক সংকট চরমে পৌঁছেছে। পরিবারতন্ত্র, সরকারের অদূরদর্শিতা, এবং স্বেচ্ছাচারিতা মাত্র দুই দশকের মধ্যে একটা দেশের পরিণতি কী করে তুলতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ হল শ্রীলঙ্কা।
মানব সম্পদ, মাথা পিছু রোজগার, শিক্ষা, প্রভৃতি বিষয়ে শ্রীলঙ্কার স্থান দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বেশ উঁচুতে ছিল। বস্ত্রশিল্পে চোখে পড়ার মতো উন্নতি করেছিল একসময় দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপরাষ্ট্র। দেশের মোট রফতানি পণ্যের 40 শতাংশই আসত বস্ত্রশিল্প থেকে। দেশের উৎপাদন শিল্পের (manufacturing industry) 33 শতাংশ কর্মসৃষ্টিও হত এই বস্ত্রশিল্প থেকেই। কিন্তু কোভিড মহামারীর পরে তা অনেকটাই মার খেয়েছে। 2020 সালের শেষে বস্ত্রশিল্প রফতানি বাবদ শ্রীলঙ্কার আয় ছিল 4.4 বিলিয়ন ডলার (440 কোটি ডলার), যা 2019 সালের তুলনায় 1.3 বিলিয়ন ডলার (130 কোটি ডলার) কম। একইভাবে মার খেয়েছে শ্রীলঙ্কার পর্যটন শিল্প, যার জন্য এই দ্বীপরাষ্ট্র বিখ্যাত। ২০১৯ সালে এই ছোট্ট দেশে 19 লক্ষ বিদেশি পর্যটক আসায় আয় হয়েছিল 3.5 বিলিয়ন ডলার (350 কোটি ডলার)। কিন্তু সেটাও মুখ থুবড়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে কমেছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী শ্রীলঙ্কার মানুষদের তরফে নিজেদের পরিবারের কাছে শ্রীলঙ্কায় পাঠানো অর্থের পরিমানও। 2021 সালের এপ্রিলে বিদেশ থেকে শ্রীলঙ্কায় পাঠানো অর্থের পরিমাণ ছিল 518 মিলিয়ন ডলার (51.8 কোটি ডলার), তা 2022 সালের জানুয়ারিতে কমে দাঁড়িয়েছে 259 মিলিয়ন ডলারে (25.9 কোটি ডলার)। অন্যদিকে, শ্রীলঙ্কার জ্বালানি পুরোটাই আমদানি নির্ভর। উক্রাইনে রাশিয়া যুদ্ধ শুরু করার পর জ্বালানির দাম হু হু করে বেড়েছে। ফলে,এই অবস্থায় শ্রীলঙ্কা আর্থিক দিক থেকে দুভাবে বিপদে পড়েছে। একদিকে, তার রফতানি অনেক কমেছে, আমদানি বেড়েছে। অন্যদিকে, দেশের মধ্যে নিজস্ব আয়ও ব্যয়ের তুলনায় অনেকটাই কমেছে। ফলে, এই দুই ক্ষেত্রেই ঘাটতির সামনে পড়ে শ্রীলঙ্কা আজ আর্থিক ভাবে দেউলিয়া। তাদের আয়ের থেকে ব্যয় বেশি। বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতির হার 21.5 শতাংশ।
শ্রীলঙ্কা একেই ছোট রাষ্ট্র, ফলে তারা বিপদে পড়লে তা চট করে সামাল দেওয়া যায় না, যেটা কোনও বড় রাষ্ট্র পারে। তার মধ্যে দীর্ঘ পনের বছর ধরে ভুল পদ্ধতিতে অর্থনীতিকে চালিয়ে নিয়ে গেছে শ্রীলঙ্কার সরকার। শ্রীলঙ্কার সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের (ভারতের রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সমতুল্য) হিসাবে সে দেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমান 2021 সালের শেষে 50724 মিলিয়ন ডলার (5072 কোটি ডলার)। অথচ অন্যান্য সূত্রে দেখা যাচ্ছে, তাদের ঋণ পরিশোধ করার ক্ষমতা বছরে মাত্র 150 থেকে 200 কোটি। ফলে যা অবস্থায় পড়ার কথা ছিল তাদের ঠিক তাই হয়েছে।
এর ফলে প্রচণ্ড ধাক্কা এসে পড়েছে সাধারণ মানুষের জীবনে। তেল ও গ্যাসের জন্য বিশাল লম্বা লাইন এখন রোজকার দৃশ্য। খাবার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম এখন আকাশছোঁয়া। মানুষের ক্রোধ আছড়ে পড়ছে দেশের সরকারের উপর। তারা দায়ী করছেন এতদিন ক্ষমতায় থাকা রাজাপক্ষ পরিবারকে। ইতিমধ্যেই জনবিক্ষোভকে সামাল দিতে না পেরে পুলিসকে দিয়ে গুলি চালানোয় প্রাণ হারিয়েছে কিছু মানুষ। প্রধানমন্ত্রী পদে ইস্তফা দিয়ে মহিন্দ্র রাজাপক্ষ সপরিবারে নৌবাহিনীর একটি ঘাঁটিতে আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁর জায়গায় সিরিল বিক্রমসিংঘে প্রধানমন্ত্রভ হয়েছেন। কিন্তু তাতেই জনরোষ শান্ত হওয়ার লক্ষণ নেই। কারণ রাজাপক্ষ পরিবারের অনেকেই এখনও ক্ষমতায় রয়েছেন। দেশের প্রধান চেম্বার অব কমার্সের তরফে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষকে চিঠি পাঠিয়ে দাবি করেছে, অবিলম্বে পদত্যাগ করতে।
প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট সহ মোট চারজন শ্রীলঙ্কার মন্ত্রিসভার সদস্য। এ ছাড়াও আরও তিন ডজন আত্মীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে অধিষ্ঠিত। তাঁরা পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে স্বেচ্ছাচারিতা করে গিয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের কথা শোনেননি। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার চেষ্টায় না সব জায়গায় উন্নয়ন করতে পেরেছেন তাঁরা, না অর্থনীতিকে সামলাতে পেরেছেন। অর্থনৈতিক পরিকাঠামোকে দাঁড় করিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া তো দূর সামলাতেই পারেননি ওঁরা। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ভরাডুবি ঘটল। যদিও 2017 সালেই এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের রিপোর্টে বলাই হয়েছিল শ্রীলঙ্কা যে পথে চলছে সেটা ঠিক নয়, তবুও সেই দেশের কেউই রিপোর্টকে পাত্তা দেয়নি। যাঁরা অর্থনীতি, দেশের অর্থনৈতিক দিক দেখত তাঁরা এটা নিয়ে ভাবেইনি।
আসলে রাজাপক্ষ পরিবারের এই বিপুল উত্থানকে প্রায় তিন দশক ধরে চলা গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষিতেই দেখতে হবে। এল টি টি ই-র নেতৃত্বে পৃথক রাষ্ট্রের দাবিতে জাফনায় তামিলরা যে যুদ্ধ শুরু করে, তা বহু রক্তক্ষয়ের পর 2009 সালে তামিলদের শোচনীয় পরাজয়ের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। সে সময় মহিন্দ্র রাজাপক্ষ ছিলেন দেশের প্রেসিডেন্ট এবং তিনি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলীদের কাছে জাতীয় নায়ক হয়ে ওঠেন। ফলে, তার পরের অনেক বছরই দেশবাসী তাঁকে ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখে এসেছে। আর সেই সুযোগে রাজাপক্ষ পরিবারতন্ত্র শ্রীলঙ্কার শাসনব্যবস্থায় গেড়ে বসেছে।
আরও পড়ুন:পিছন দিকে দ্রুত এগোচ্ছে মোদীর ভারত
কিন্তু গৃহযুদ্ধের অন্তিমপর্বে জাফনায় ব্যাপকহারে গণহত্যার রক্ত এখনও রাজাপক্ষ পরিবারের হাতে লেগে রয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন সহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা এনিয়ে সরেজমিনে তদন্ত করতে চাইলেও রাজাপক্ষ সরকার তা করতে দেয়নি। এই অবস্থায় চিন ছাড়া অন্য অনেক দেশ এখানে বাণিজ্য করতে চায় না তাদের রক্তাক্ত ইতিহাসের জন্য। আর এই অবস্থা থেকে শ্রীলঙ্কার ঘুরে দাঁড়াতে বহু বছর সময় যে লেগে যাবে তা স্পষ্ট। অথচ এই শ্রীলঙ্কাই কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম উদারনীতি নিয়ে এসেছিল, এমনকি চিনেরও আগে। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান যখন ভাবতে অবধি পারছে না নিজেদের বাইরে তখন 1960-65 সালে শ্রীলঙ্কা উদারনীতি ব্যবস্থার মধ্যে আসে।
এখন শ্রীলঙ্কাকে ঘুরে দাঁড়াতে গেলে সবার আগে রাজাপক্ষ পরিবারের পতন দরকার। এই একনায়কতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র ভাঙা দরকার। যখন অর্থনীতি একটু একটু করে ভেঙে পড়ছে সরকার কিছু না ভেবে স্রেফ রাসায়নিক সার ব্যবহার বন্ধ করার হুকুম দিয়ে জৈব চাষ শুরু করতে বললেন খরচ কমাতে। কিন্তু ফল হল উল্টো। খরচ কমার বদলে আরও বাড়ল। সরকারের অদূরদর্শিতার পরিণাম সাধারণ মানুষকে ভোগ করতে হচ্ছে। তা
কিন্তু শ্রীলঙ্কা নিয়ে এত কথা হচ্ছে তখন তার নিশ্চয় কোনও কারণ আছে। ভারতও কিন্তু অল্প অল্প করে শ্রীলঙ্কার পথেই পা বাড়াচ্ছে। একনায়কতন্ত্র, স্বেচ্ছাচারিতা আমাদের দেশেও চলছে। ভারতের বর্তমান বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ হচ্ছে জিডিপির 70 শতাংশ। এটা যদি আরও বাড়ে তাহলে সমস্যা বাড়বে। গোটা দেশ দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে। শ্রীলঙ্কার সরকারের মতো আমাদের দেশের সরকারেরও সদিচ্ছার যথেষ্ট অভাব আছে। নইলে এভাবে বিশেষজ্ঞদের মতামতকে গ্রাহ্য না করে ঋণের বোঝা বাড়াত না। শুধু ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার নয়, পশ্চিমবঙ্গ সরকারও দুহাতে বাজার থেকে টাকা ধার করে চলেছে। অর্থনীতিবিদ শৈবাল কর এই বিষয়ে বললেন, শ্রীলঙ্কা থেকে আমরা শিক্ষা নিয়ে নিজেদের শুধরাতেই পারি। এখনই সংযত হতে হবে সরকারকে। ব্যালেন্স করে এগোতে হবে। নইলে ভারতেরও শ্রীলঙ্কার অবস্থা হবে। একনায়কতন্ত্রের প্রবণতা আটকাতে হবে। সরকার না শুনলেও বারবার বলে যেতে হবে সরকারের কী করা উচিত কী নয়।" শ্রীলঙ্কা অন্যান্য সব দেশের কাছেই একটা উদাহরণ হয়ে থাকবে, অদূরদর্শিতা, একনায়কতন্ত্রের পরিণাম কী হয় শেষ পর্যন্ত তার।
বিশ্ব জুড়ে হুহু করে ছড়াচ্ছে মাঙ্কি পক্স। কিন্তু কী এই রোগ, কী ভাবে হয়?
75 বছর বয়সী শিক্ষক সুজিত চট্টোপাধ্যায় পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হলেন
প্রায় সারাদিনটাই গল্পের বই পড়াতেই আটকে আছি!
2021 -এ উত্তর পূর্ব ভারতে প্রায় 30-60 শতাংশ ঘাটতি দেখা গিয়েছে প্রাক বর্ষার বৃষ্টিতে।
বাংলা সিনেমার দর্শক সংখ্যা কী কমছে? নেপথ্যে কী কারণ?
যে জায়গায় সারা বছর তুষারপাতই নিয়ম, হিমাঙ্কের উপরে ওঠে না তাপমাত্রা, সেখানে টানা তিনদিন ভারী বর্ষণ।