সংশয়ীদের মনে সংশয় ছিল। উল্টোদিকে কিছু বরাভয়ও ছিল। যাবতীয় আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণিত করে টিকে গিয়েছিল এ দেশের বহুত্ববাদ, বৈচিত্র। এতকাল বিসমিল্লার সানাইয়ে হিন্দু অনুষ্ঠানের শুভ মহরৎ হয়েছে। যার নামের প্রথম অংশে কাজী, সেই নজরুল নীল যমুনার জলে কৃষ্ণকে খুঁজেছেন। আবার নিজের ধর্মপরিচয় নিয়ে ঘোর সংশয়ী লালনও সাধন-ভজন করেছেন। ভারতবর্ষ নামক ধারণায় লালিত হয়েছে তাদের স্বতন্ত্র ভাবনা, দর্শন। হাজার ফুল এনে গাঁথা হয়েছে ভারতবর্ষের জয়মালা। সেটাকে যে এক লহমায় এমন ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করা হবে কে জানত?
জীবনানন্দ বর্ণিত গাঙুরের জলে ভেসে যাচ্ছে আজকের ভারতবর্ষের বেহুলা। অতীত চারণের পথে দাঁড় টানছে ইতিহাস। গাঙুর যতই ক্ষীণস্রোতা এক নদী হোক, তার প্রতীকী ব্যঞ্জনায় সে তো সুগভীর, ভারত ইতিহাসের দু'কূল ছাপানো জল তার গর্ভে। কে যাও? সাড়াশব্দ আসে না ডিঙি নৌকার সওয়ারির কাছ থেকে। কৃষ্ণা দ্বাদশীর মরা জ্যোৎস্নায় বেহুলা কি এখন দু'পাড়ের শুধু শব গোনেন? এ দেশে আর কি কোনও অজগাঁয়ের বাউল গেয়ে ওঠেন, "গাঁয়ের এই নওজওয়ান হিন্দু মুসলমান, মিলিয়া বাওলা গান আর মুর্শিদিগাইতাম...?' এই দেশের সুরক্ষিত লৌহবাসরে অনেক কালসর্প প্রবেশ করেছে। বেহুলা বুঝতে পারেন। ধর্মীয় উন্মত্ততায় ধ্বংস হয়েছে অপর এক ধর্মের উপাসনাস্থল। শুধু সংখ্যাগুরুর ধর্মবিশ্বাসের জোরে সেই উন্মত্ততা, সেই বীভৎসতা ন্যায়িক প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ভিন্নতায়, উৎকর্ষে সাগর সমান হিন্দু দর্শন আজ সংকীর্ণ পূতিগন্ধময় জলাধারের রূপ নিয়েছে— সেখানে পরমহংস ভাসবে কী প্রকারে?
সুদীর্ঘ যাত্রাপথে ভেসে আসতে আসতে বেহুলা জীবনের স্পন্দনধ্বনি শোনেন না। শুধু দেখেন ইমারতের ধ্বংসের ছবি। যে ইমারতগুলির ওপর এই দেশটা দাঁড়িয়ে সেগুলিরই খণ্ডাংশ জলে ভেসে যায়। একটা ইঁট কাঠ মাটির মসজিদ কি ভারতবর্ষের মতো বিপুলা একটা দেশের জন্য এতটাই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল? এই ভারত তো মসজিদ থেকে ভেসে আসা কাওয়ালি শুনে, গুরুদ্বারের লঙ্গরখানায় পেট ভরিয়ে আর মন্দিরের চাতালে ঘুমিয়ে বেড়ে উঠল। শুধু হিংসা, সন্দেহ আর বিভ্রান্তি ছড়িয়ে এই ভারতকে মেরে ফেলা কি এতই সহজ?
28টা বছর কেটে গেছে। সংখ্যাগুরুর বিশ্বাসকে পুঁজি করে কিছু সংখ্যালঘু ধর্মোন্মাদ গাঁইতি শাবল দিয়ে ভেঙে দিয়েছে আস্ত একটা ঐতিহাসিক স্থাপত্যকে। একটু ভুল বলে ফেললাম বোধহয়। আসলে ওরা আঘাত হেনেছে দেশের বহুত্ববাদের স্তম্ভের ওপর। কিছুক্ষেত্রে সফলও হয়তো হয়েছে। এই সাফল্যের প্রমাণ একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল, সংগঠন এবং মতের চকিত উত্থান। শুধু নির্বাচনী পাটিগণিতের নিরিখেই নয়, সমাজের রন্ধ্রেও এই ধর্মীয় মেরুকরণ সাফল্য এনে দিয়েছে তাদের। প্রায় একই সময়ে সমান্তরাল ভাবে মন্ডল কমিশন জাতপাত এবং গোষ্ঠীভিত্তিক রাজনীতির সূত্রপাত ঘটিয়ে এই ভারতকে কয়েকটা টুকরোয় বিন্যস্ত করে দিয়েছে।
উজানের স্রোতে বেহুলা শুনতে পান উচ্চবর্ণের হাতে নির্যাতিত দলিত রমণীর আর্ত চিৎকার। বেহুলা দেখেন গাঙুরের জলে ভেসে যায় এ দেশের সাংবিধানিক নীতি-কানুন, মূল্যবোধ। নিজের ভেলায় এ কোন শব বহন করছেন বেহুলা? ওটাই কি আজকের ভারতবর্ষ, যার পুনর্জন্মের জন্য ইন্দ্রের সভায় পরীক্ষা দিতে যাচ্ছেন তিনি? কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এই দেশ, আবারও না হয় পরীক্ষা দেবে। কলকারখানায় মজদুর, খোদ রাজধানীর সীমান্তে কৃষকরা যেমন পরীক্ষা দিচ্ছেন গোটা দেশের হয়ে। ছিন্ন খঞ্জনার মতো নেচেই আবারও পরীক্ষা দেবে এই দেশের বেহুলা। তবু নিদ্রিত ভারত জাগবে, জাগবেই।
ঈশ্বরী পাটনি কি মা অন্নপূর্ণার কাছে দুধভাতের আবদার না জুড়ে ফুটেজের আবদার জুড়েছিলেন?
গদ্দারদের সঙ্গে কিভাবে ট্রিট করা হয়, তার একটা নমুনা দেখানো হয়েছিল ৩০শে জানুয়ারি, ১৯৪৮-এ।
কিন্তু আজকাল বড় ধাঁধা লাগে চোখে, খালি চোখে বোঝা যায় না আসলে কে কার পরীক্ষা নিচ্ছে
আইনি ফয়সালা আদালতের অপেক্ষায়, কিন্তু নৈতিকতার পাঠ অসম্পূর্ণ রেখে কোন শিক্ষা দেবেন অঙ্কিতা
বাংলায় রাজনীতি করে বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিকে নিয়ে এমন সংশয় তৈরি করতে পেরেছেন আর কোন রাজনীতিক?
বোম্বে বন্দর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে স্প্যানিশ ফ্লু যা পরে বোম্বে ফ্লু নামে পরিচিত হয়।