×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • রাতের অন্ধকারে চোরের মতো প্রবেশ

    বিতান ঘোষ | 02-04-2020

    প্রতীকী ছবি

    করোনা মহামারীর বিশ্বব্যাপী বীভৎসতার সঙ্গে তুলনীয় 102 বছর আগের আর এক বিশ্বব্যাপী মহামারী। আজকের মতোই সেই মহামারীর মূলেও ছিল আণুবীক্ষণিক ভাইরাস, যার পোশাকি নাম ‘স্প্যানিশ ফ্লু'। মাত্র এক মাসের মধ্যে সে বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ মানুষকে আক্রান্ত করে ফেলেছিল। 60 কোটি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল এই ‘স্প্যানিশ ফ্লু'। করোনা কত দূর গিয়ে কোথায় থামবে এখনও বলা মুশকিল। তবে গত একশো বছরে আধুনিক বিজ্ঞানের যে বিপুল অগ্রগতি হয়েছে, নতুন নতুন অনেক গাণিতিক মডেল আবিষ্কৃত হয়েছে অবং সর্বোপরি কম্পিউটার আসার ফলে সম্ভাব্যতার অঙ্ক কষায় বিপ্লব হয়ে গিয়েছে; তার ভিত্তিতে করোনার যে সম্ভাব্য প্রাণহানি তা কিন্তু স্প্যানিশ ফ্লুয়ের কাছাকাছিও নয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি অবশ্যই তার একটা কারণ।

     

    সালটা 1918। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্তিম ক্ষণ প্রায়। চার বছরের যুদ্ধের ধকল সামলে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে বিশ্ব। সেই সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা এতটা উন্নত না হলেও খবর ছড়িয়ে পড়ল আমেরিকার সেনা ছাউনিতে নাকি এক অদ্ভুত রোগের আবির্ভাব হয়েছে। কেউ কেউ আবার বললেন, ‘না না, ফ্রান্সের সেনা ছাউনি থেকেই রোগটা প্রথম ছড়ায়।' অর্থাৎ তথ্যে একটা বিষয় স্পষ্ট, বিশ্বযুদ্ধের সৈন্যরাই এই মারণ ভাইরাসের চাঁদমারি। অথচ রোগের নামকরণ করা হলো কিনা ‘স্প্যানিশ ফ্লু'। এর স্বপক্ষে বিজয়ী মিত্রপক্ষ বললো, স্পেনেই নাকি প্রথম এই রোগে আক্রান্ত রোগীর নাম নথিভুক্ত হয়। স্পেন অবশ্য পালটা ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে বলল, বিশ্বযুদ্ধে নিরপেক্ষ অবস্থান নেওয়ার শোধ তুলতেই স্পেনের ওপর প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা হচ্ছে।

     

    ঘটনাচক্রে আজকের COVID-19 কে পশ্চিমি দুনিয়ার অনেক দেশই ‘উহান ভাইরাস' বলে অভিহিত করছেন। তাদের অভিযোগ উহানই করোনার সূতিকাগার। চিন অবশ্য আগাগোড়া সেই অভিযোগকে খণ্ডন করে দাবি করে আসছে উহানের সাথে করোনা মহামারীর কোন সম্পর্ক নেই। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে চিনের আবেদন, COVID-19-কে যেন উহান ভাইরাস বলে অভিহিত করা না হয়। 102 বছর আগে একইভাবে স্পেনও সেই মহামারীকে ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ বলে অভিহিত করার তীব্র বিরোধী ছিল।

     

     

    1918-তে বোম্বে বন্দর দিয়েই ভারতে প্রবেশ করেছিল স্প্যানিশ ফ্লু। স্থানীয় মানুষের মুখে সেটাই পরবর্তীকালে ‘বোম্বে ফ্লু' নামে পরিচিত হয়। তৎকালীন ইংরেজ স্বাস্থ্য অধিকর্তা থর্নারের কথায়, ‘রাতের অন্ধকারে চোরের মত ভারতে ঢুকেছিল ‘স্প্যানিশ ফ্লু'। ভারতীয় সৈন্য বোঝাই যে জাহাজ বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গন থেকে ফিরে বোম্বেতে নোঙর ফেললো, সেই জাহাজই নাকি ভারতে এই রোগের ভগীরথ। গুজব অবশ্য কম রটল না। এখন যেমন রটছে আর কী! ফ্লুয়ের করালগ্রাসে যখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষজন মারা যাচ্ছেন তখন গুজব রটে গেল ইংরেজরা নাকি পরিকল্পিতভাবে জনসংখ্যা কমানোর চেষ্টা করছেন। তার জন্য নাকি তারা বিভিন্ন কুয়োয় বিষ ঢেলে এই রোগের আমদানি ঘটিয়েছেন। এর থেকেও উর্বর আর একটা গুজব ছড়ানো হল। ফ্রান্সের কোনও এক গোপন মারণাস্ত্র লক্ষ্যচ্যুত হওয়াতেই নাকি এমনতর বিপর্যয়। বিস্ময়ের ব্যাপার এই 2020-র করোনা বিপর্যয়ের মধ্যেও সেরকম জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটেনি। অনেকেই মনে করছেন, চিনের জৈব রসায়নগার থেকেই করোনা ভাইরাসের জন্ম। এমনকি সোশাল মিডিয়ায় জনসংখ্যা কমাতে চিনের অস্ত্র করোনা – এমন হাস্যকর কথাও কেউ কেউ বিশ্বাস করেছেন এবারও!

     

    আরও পড়ুন: করোনার বাপ ঠাকুর্দা

     

    ভারতে দুটি পর্বে তার অপারেশন চালিয়েছিল এই ফ্লু। প্রথম পর্বের থেকে দ্বিতীয় পর্বের পরিণতি আরও বেশি বিয়োগান্তক ছিল। নিউইয়র্ক টাইমসের তথ্যসূত্র বলছে, দুই পর্ব মিলিয়ে প্রায় 6 কোটি মানুষকে সংহার করেছিল এই মহামারী। 1897-এর প্লেগের মতোই বোম্বের ঘিঞ্জি অঞ্চল থেকে তার অপারেশন শুরু করে দ্রুত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল ফ্লু। রেলপথের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সুগম যাতায়াত তার কাজটা অনেক সহজ করে দিয়েছিল। ঠিক যেমন আজকের ভুবনায়িত মানুষের বিশ্বব্যাপী চলাচলকে অবলম্বন করেই নিজের পরিসরকে দ্রুত বিস্তৃত করে নিচ্ছে করোনা মহামারী। সাধারণত তীব্র জ্বর ও পিঠে ব্যথার লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতেন রোগীরা। তবে মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির এশিয়ান স্টাডিজের অধিকর্তা, প্রফেসর সিদ্ধার্থ চন্দ জানাচ্ছেন, ব্রিটিশ সরকারের সক্রিয়তায় চিকিৎসালয়গুলিতে লাইন পড়ে যায়নি। এখনকার মতোই বহু মানুষকে লোকালয় থেকে দূরে সরিয়ে আলাদা করে রাখা হয়েছিল। আরও একটা বিষয়ে স্প্যানিশ ফ্লুয়ের সাথে আজকের COVID-19-এর মিল আছে। সেইসময় তারও যেমন প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি, এখনও তেমনি করোনায় পায়ে বেড়ি পরাবার মতো কোনও অস্ত্র আমাদের হাতে নেই। 102 বছর আগে তখনকার পরিস্থিতি অবশ্য আজকের মত এতটা উন্নত ছিল না। তখনও অ্যান্টিবায়োটিক দূরে থাক, পেনিসিলিনও আবিষ্কৃত হয়নি।

     

    স্প্যানিশ ফ্লু সবচেয়ে বেশী আঘাত নামিয়েছিল 20-40 বছর বয়সীদের মধ্যে। নিউইয়র্ক টাইমস জানাচ্ছে, মাত্র এক বছরে ভারতের 6% জনসংখ্যা হ্রাস পেয়েছিল এই ফ্লুয়ের প্রকোপে। দেশের 120 বছরের জণগণনার ইতিহাসে জনসংখ্যার হ্রাস পাওয়া ওই একবারই। জিডিপি গ্রোথের পরিমাণ ঋণাত্মক হয়ে নেমে এসেছিল -10.5 শতাংশে। গোটা বিশ্বে স্প্যানিশ ফ্লু মাত্র দুই মাসে যতজন মানুষকে মেরেছিল, চতুর্দশ শতকের 'ব্ল্যাক ডেথ' সেই পরিমাণ মানুষ মারতে গোটা একটা শতক সময় নিয়েছিল। এই বীভৎসতা থেকে শিক্ষা নিয়েই ব্রিটিশ সরকার ভারতের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও পয়ঃপ্রণালি ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করেছিল।

     

     

    করোনার দুর্নিবার গতি স্প্যানিশ ফ্লুয়ের এই সংহারক রূপকেই মনে করিয়ে দেয়। প্রতিষেধক বিহীন এই রোগকে আটকানো গিয়েছিল আজকের এই সেল্ফ আইসোলেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই। সেখান থেকেই শিক্ষা নিয়ে আমাদের প্রত্যেকের আরও বেশি সচেতন এবং কর্তব্যনিষ্ঠ হওয়া উচিত। আর মনকে এই বলেও প্রস্তুত রাখা উচিত, আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে এক বড় ধাক্কার সম্মুখীন হবো আমরা। রোগ মোকাবিলার পাশাপাশি কীভাবে সেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করা সম্ভবপর হবে, সেটাও এখন চিন্তার বিষয়। 
     


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    মুখ্যমন্ত্রী হয়েও নারীবিদ্বেষী কদর্য আক্রমণের শিকার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

    বকলমে লোকাল ট্রেন চলছে, খুশি নিত্যযাত্রীরা; দায় না নিয়ে সেফটি ভালভ থিওরি রাজ্য সরকারের?

    আসামের ফর্মুলায় বাংলা-জয় হল না বিজেপির।

    শিল্পীর শিল্প কালোত্তীর্ণ হয় মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় সরকারের দেওয়া রাষ্ট্রীয় খেতাবে নয়।

    সেই ঔদার্য ‘সব কা বিশ্বাস'-এর সরকারের আছে বলে মনে হচ্ছে না।

    দলের বাইরে বহু চালচোর ছিলই, ভোটের পর দেখা গেল দলের ভিতরেও বহু চালচোর আছে!

    রাতের অন্ধকারে চোরের মতো প্রবেশ-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested