গ্রামের দিকে যাত্রাপালার মহড়া দেখতে গিয়ে একবার এক মজার ঘটনার সাক্ষী হয়েছিলাম। মঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকা অভিনেতাকে সবাই মঞ্চ থেকে নেমে আসার কাতর আর্জি জানালেও, তিনি কিছুতেই নামতে রাজি হচ্ছিলেন না। বরং পাল্টা গর্জনে তিনি বলছিলেন, '20 টাকা চাঁদা দিয়েছি কি এত তাড়াতাড়ি নামব বলে?' গ্রামবাসীদের মুখেই শোনা গেল, যাত্রার জন্য গ্রামের আর পাঁচ জনের থেকে একটু বেশি চাঁদা দিয়েছেন বলে তিনি একটু বেশি সময় ধরে মঞ্চে অভিনয় করতে চান। তাঁর নিজের পার্ট ফুরিয়ে গেলেও, তিনি নিজেই নাকি সংলাপ বানিয়ে বলে চলেন। কিন্তু মঞ্চ থেকে নামতে তাঁর মন সায় দেয় না। অবশ্য মঞ্চে একবার উঠে পড়ার যে মজা, সেই মজায় মোহিত হয়ে অনেকেরই আর থামার কথা মনে থাকে না। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলে মনে হয়, সর্বত্রই পরিমিতিবোধের এক অভাব বড় প্রকট হয়ে উঠছে দিন দিন। বিশেষ ভূমিকায় যাঁদেরকে মঞ্চে অবতীর্ণ করা হচ্ছে, তাঁরাও প্রয়োজনের অতিরিক্ত মঞ্চে থেকে উপরমহলের বিড়ম্বনা বাড়াচ্ছেন।
ঈশ্বরী পাটনি কি মা অন্নপূর্ণার কাছে দুধভাতের আবদার না জুড়ে ফুটেজের আবদার জুড়েছিলেন? মানুষজন অকাতরে এত ফুটেজ খেয়ে বেড়ায় কী করে? বলিউডের জনপ্রিয় অভিনেত্রীকে বলা হল, ঈশানকোণে মেঘ জমেছে। পাল্টা হাওয়া দিয়ে মেঘ কাটিয়ে দেওয়ার কাজটা করতে হবে। ওমা, সে নিজেই রানী-ফানি সেজে আর এক ঝড় বাঁধিয়ে বসে রইল। তাকে বলা হয়েছিল বিশেষ এক "সেনা'র উদ্দেশ্যে তীর-ধনুক ছুঁড়তে। সে আহাম্মক নিজের পারঙ্গমতা দেখাতে যাকে পারল তার দিকে তীর ছুঁড়তে শুরু করে বিপদ বাঁধাল। ওই যে পরিমিতিবোধের পাঠটা না থাকলে যা হয় আর কী! তবু, উপরমহলের চেষ্টার খামতি নেই। পরিস্থিতি বিশেষ অনুকূলে নেই, এটা বুঝেই একসঙ্গে অনেকজনকে মঞ্চে তুলে দেওয়া হয়েছে। মুশকিল হল এদের প্রত্যেকেই এত ফুটেজখোর যে, একজন নেমে গিয়ে অন্যজনকে স্পটলাইটে যে জায়গা করে দেবে, তা নয়। সবাই মিলে উপরমহলের কাছে নম্বর বাড়ানোর জন্য রীতিমতো ধাক্কাধাক্কি করছে। হেঁ হেঁ, আসলে ওদেরও বিশেষ দোষ দিয়ে লাভ নেই। গত 6 বছরে দেশের সরকার এত এত সংস্থাকে বেচে দিয়েছে আর বেচে দেওয়ার গুণাগুণ বুঝিয়েছে যে, বেচারিরা আস্ত সরকারটাকেই বেসরকারি কর্পোরেট হাউস ভেবে ফেলেছে। এই বাজারে যদি চাকরিটাই ঘ্যাচাং ফু হয়ে যায়...! তাই, বসের নেকনজরে থাকতে তাদের ধরে আনতে বললে, বেঁধে এনে হাজির করছে। বেসরকারি জিনিসের কী মহিমা!
যাইহোক, অভিনেত্রীর কথা অনেক হল। এবার একটু অভিনেতার কথায় আসি। কী সুন্দর সামাজিক বার্তা দেওয়া সিনেমা করে বিনোবা ভাবে সুলভ ইমেজ তৈরি করে ফেলেছিলেন তিনি। হঠাৎ এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে বলে বসলেন, সুস্থ থাকতে তিনি নাকি গোমূত্র খান! আরে বাবা, অভিনেতাটি যে বস কাম পরিচালকের খুব ঘনিষ্ঠ, তা গোটা ভূ-ভারত জানে। কিন্তু তাই বলে কেউ এমন চরমপন্থী স্ট্যান্ড নেয়? গাভাসকার হঠাৎ ভিভ রিচার্ডস হতে চাইলে টিম ম্যানেজমেন্টের বিড়ম্বনা বাড়ে বই কমে না। সবাইকেই তো নির্দিষ্ট দায়িত্ব দেওয়া আছে, নাকি! ওদিকে মঞ্চে উঠে জনৈক যোগী বলেছেন, এই দেশে মুঘলদের দাসত্ব করা মানা যায় না। সামনে বসে থাকা পরিচালক হাঁহাঁ করে বলে উঠলেন, "আবার স্ক্রিপ্টের বাইরে কথা বলছিস? ওরে বগা, লালকেল্লা থেকে এই যে ক'দিন আগেই বক্তিমে দিলুম, সেটা কোন যোগী বানিয়েছে একটু বলতে পারবি? শাহজাহানের তাজমহল থেকে উত্তরপ্রদেশ সরকার কতটাকা রাজস্ব পায় তার হিসাব কষেছিস?' অবোধ যোগী অবশ্য এসব শুনতে চায় না। তার এসব গরমগরম কথা বলাতেই আনন্দ।
আর এক অবোধ তো বিড়ম্বনা বাড়াতেই মঞ্চে ওঠে। প্রথমে তো উপরমহলে ঠিক হয়েছিল করোনার ব্যাপারটাকে স্রেফ অশুভ শক্তির উত্থান বলে চেপে দেওয়া হবে। কিন্তু প্রদীপ জ্বালিয়ে, ঘণ্টা বাজিয়েও তো তাকে বাগে আনা গেল না। মাঝখান থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকটাই কিছুদিনের জন্য অভিভাবকহীন হয়ে রইল। তা এই পরিস্থিতিতে সেই অবোধ বলে কিনা করোনা চলে গেছে! কবে গেল? তাছাড়া সে চলে গেলেও, সেই ঘোষণাটা তো একমাত্র পরিচালকই করবেন। তালি বাজিয়ে, বুক বাজিয়ে বাকিরা সেই করোনা-প্রস্থানকে উদযাপিত করবে মাত্র। তা নয়, এক অকিঞ্চিৎকর চরিত্র করোনার বিদায়বাণী শোনাচ্ছে! আবার আঙুল উঁচিয়ে বলেছে, পুলিশের ছেলেপুলেকে নাকি পরিযায়ী শ্রমিক করে ছাড়বে। পরিচালক যে এই পরিযায়ী শ্রমিকদের ব্যাপারটা পুরোপুরি উপরওয়ালার হাতে ছেড়ে দিয়েছেন, সেটা ভুলে আবার ফুটেজ খেতে নেমে পড়েছে এরা। এরা এত "আমিত্বে' ভোগে কেন কে জানে! মাথার ছাতাটা এখন নেই বলে দিল্লি পুলিশের সবকটাও এখন নিজেদের জেমস বন্ড ভাবছে।
তবে যা খবর পাওয়া যাচ্ছে, পরিচালক খুব দ্রুত কাট বলে, এদেরকে প্যাকআপ করে নিতে বলবেন। ঢের হয়েছে, আর নয়। এবার আইপিএল আসছে। পুজোপার্বণও আছে পিছে পিছে। চার-ছক্কা, উৎসব অনুষ্ঠান নিয়ে দর্শকরা আপাতত মজে থাকুক। এদেরও আরও তালিম প্রয়োজন। মঞ্চে উঠে ফুটেজ খাওয়ার প্রবণতায় রাশ টানার জন্য এদের তালিম চলবে বলে খবর। তবে এদের মধ্যে একজন নাকি, পরিচালককে কাছে পেয়ে বলেছিল, "আপনার জন্য আমরা যে এতটা অভিনয় করছি, ভাবীকাল কি আমাদের মনে রাখবে?' পরিচালক অট্টহাসি দিয়ে বলেছেন, 'দু'মাস আগের পরিযায়ী শ্রমিকদের ডেটা রেকর্ডই আমরা হারিয়ে ফেলেছি, আর তোরা আশা করিস ভাবীকাল তোদের মনে রাখবে?' পাশ থেকে অনুনয়ের সুরে, "স্যার কিছু তো কমপ্লিমেন্ট দিয়ে যান।' পরিচালক হেসে বললেন, "বেশ, শোন তবে, আমার জন্য তোদের এই ওভার-অ্যাকটিং আমার দাড়ি বৃদ্ধির সমানুপাতিক আর দেশের জিডিপি পতনের ব্যস্তানুপাতিক! চালিয়ে যা, তবে ভবিষ্যতে আরও ভাল করতে হবে।'
আপাতত রণে ভঙ্গ দিলেও সুনার বঙ্গালের কারিগরদের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
প্রবাসী সন্তানের অভাব ভুলিয়ে সন্তানের মতোই প্রবীণদের আগলাচ্ছেন তুর্ণীরা।
আচ্ছা মৃত্যুর পর কী? মৃত্যুতেই কি সবকিছুর পরিসমাপ্তি নাকি, তার মধ্যে থেকেই সৃষ্টির বীজ উপ্ত হয়?
কাজ দেয় না সরকার, চাকরি হবে কীসে?
রাজনৈতিক দলকে দানের নামে আর্থিক অনাচার, অস্বচ্ছতার লজ্জাজনক কাহিনি।
বীরপুজোয় মত্ত শাসক এবং ভক্তরা ইতিহাস-বিস্মৃত হলে তাদেরই চরম মূল্য চোকাতে হবে।