বছর ছয়েক আগে তিনি যখন এসেছিলেন, তখন তাঁকে নিয়ে তাঁর দলের অন্দরে কিংবা বাইরে কোনও উৎসাহ উদ্দীপনা ছিল না। তাঁর পূর্বসূরি রাহুল সিনহা কিংবা তথাগত রায়দের তবু একটা রঙিন রাজনৈতিক ইতিবৃত্ত ছিল। তাঁর সেটুকুও ছিল না। 2015 সালে শোনা গেল সুদূর আন্দামানে সংঘের কাজ করা একজন মুখচোরা, প্রচারবিমুখ মানুষ রাজ্য সভাপতি হতে চলেছেন। তপন শিকদার, সত্যব্রত মুখোপাধ্যায়ের মতো পরিচিত মুখের বাইরে এই আনকোরা মানুষটিকে কেউই প্রথমে ততটা আপন করে নেননি। অচিরেই কিন্তু বোঝা গেল দিলীপ ঘোষকে রাজনীতিক হিসেবে ঘৃণা করা যায়, বরণ করেও নেওয়া যায়, কিন্তু উপেক্ষা করা যায় না।
কলকাতায় আধা ভিক্টোরিয়ান ও আধা নবজাগরণকেন্দ্রিক একটা সাংস্কৃতিক স্তর আছে। দিলীপবাবু হয়তো বুঝেছিলেন, এই স্তরকে ভেদ করা অতীব কঠিন। তাই সেই প্রয়াস না করে, তিনি সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে জনগণের নজর ঘোরাতে চাইলেন। আঁতেল বাঙালি কাঁধে শান্তিনিকেতনি ঝোলা নিয়ে যতবার কবিগুরুর ‘সভ্যতার সংকট’ পড়েছে, বাঙালি নারী যতবার বেগম রোকেয়া কিংবা সিমোন দ্য বোভেয়ারকে উদ্ধৃত করে স্বাধিকারের পক্ষে সরব হয়েছে, তার দ্বিগুণবার দিলীপ ঘোষ তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে এসব ‘ন্যাকামো’কে নস্যাৎ করেছেন। এতে হাততালিও কুড়িয়েছেন বিস্তর। অনেকেই মনে করেছেন, আমাদের ফুটিফাটা হয়ে যাওয়া সংস্কৃতির দেওয়ালকে আমরা চটের বস্তা ফেলে ঢেকে রেখেছি। আর দিলীপবাবুর মতো রাজনীতিকরা সেগুলো সরিয়ে আমাদের সংস্কৃতির অন্ত:সারশূন্যতাকে নাকি বেআব্রু করে দিয়েছেন!
অনেকে তো আবার দিলীপবাবুকে সাবঅল্টার্ন গণজাগরণের হদ্দমুদ্দ সাজাতেও বাকি রাখেননি। কী ভাগ্যিস দিলীপবাবু এসব তত্ত্বকথা বুঝতেন না, পথ্যকথা বুঝতেন। মানে ওঁর নিজের কথায়, ‘যার যে ওষুধে কাজ হয়, আমি সেই ওষুধই দোব।' নিশ্চয়ই তাঁর ‘ওষুধ’-এ কিছু ঔষধিগুণ ছিল, না হলে কি আর বিজেপি গত লোকসভায় 18টি আসন পায়? রাজ্যে প্রায় ক্ষমতায় ‘এসেই গেছি’ ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়?
খ্যাতির মধ্যগগনে থাকা মানুষ জানেন খ্যাতির কী ভীষণ বিড়ম্বনা, দিলীপবাবুও জানতেন। তিনি রাজনৈতিক ক্রিজে এসেছিলেন অখ্যাত বিনোদ কাম্বলি হয়ে, দলের স্ট্রাইক রেট বাড়াতে তাঁকে ভিভ রিচার্ডস হতে হয়। তারপর তাঁর রানের নেশা এমনই হয়ে দাঁড়ায় যে, তিনি অফ স্টাম্পের বলও খোঁচাতে থাকেন। দিলীপবাবু বুঝে গিয়েছিলেন, তিনি গান্ধী বা রবীন্দ্রনাথ আওড়ালে কেউ তাঁকে পাত্তাও দেবে না। তার জন্য অনেক রথীমহারথী, নেতামন্ত্রী এই রাজ্যেই আছেন। তাই তাঁকে বলতে হবে এমন কথা, যা অশ্রুতপূর্ব। বাঙালি লুকিয়ে ইরোটিক সিনেমা দেখার মতোই সেগুলো দেখে-শুনে মুচকি হাসবে, তারপর সর্বসমক্ষে চোখ ঢেকে, কানে আঙুল দিয়ে তওবা তওবা করবে।
আরও পড়ুন: কর্ম নেই, বিশ্বকর্মা বহাল তবিয়তেই
সবাইকেই একটা না একটা জায়গায় একটা পূর্ণচ্ছেদ টানতে হয়, দিলীপবাবুকেও টানতেই হত। কিন্তু উমেদারদের স্তুতি আর ক্ষমতালিপ্সুদের বলয়ে মধ্যমণি হয়ে ওঠা দিলীপ ঘোষ মনে করলেন, তিনি বাংলার কৃষ্টি, মেধা, সংস্কৃতির একটা কাউন্টার ন্যারেটিভ তৈরি করতে পেরেছেন। তাই, সোৎসাহে ফাটাতে লাগলেন একের পর এক বোমা। কখনও মুখ্যমন্ত্রীকে বারমুডা পরার নিদান দিলেন, কখনও বা শিল্পীদের ‘রগড়ে দেওয়া’র কথা জানালেন। ভদ্রবিত্তের অন্তরলালিত নারী বিদ্বেষ, সংখ্যালঘু বিদ্বেষ, পুরুষতন্ত্রের অহংবোধ কিছুটা হলেও উৎসাহিত হয়েছিল তাঁর এই সকল ক্রিয়াকলাপে। ভোটের বাক্সে তার ইঙ্গিতও পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু দিলীপবাবু যখন থেকে মনে করে নিলেন কেউ যুক্তি, বিনয় কিংবা জ্ঞানের পরাকাষ্ঠা দেখালেই তিনি ‘সত্যকথন’-এর নামে যা হোক, তা হোক কিছু একটা বলে দেবেন, তখন থেকেই বোধহয় তাঁর ব্র্যান্ড ভ্যালুর পতন শুরু হল।
দিলীপ ঘোষ রাজ্য বিজেপির সভাপতি পদ থেকে সরতেই সোশাল মিডিয়ায় দেখা গেল এমনই হাসি-মশকরা!
তবু গুরুগম্ভীর বঙ্গ রাজনীতির হাইলি সাসপিশাস এক চরিত্র হয়েই থেকে যাবেন দিলীপ ঘোষ। তাঁর রাজনৈতিক ধারাকে বারবার কাল্টিভেট করলেও হয়তো তল পাওয়া যাবে না! গ্রাম থেকে উঠে আসা, সংঘের সুশৃঙ্খলার পাঠ নেওয়া রাউডি ইমেজের দিলীপ ঘোষ রয়ে যাবেন স্বভাবরসিক বাঙালির হৃদয়ে। গরুর দুধে চুমুক দিতে গিয়ে কিংবা ‘রবীন্দ্রনাথের বর্ণপরিচয়’ পড়তে গিয়ে এই ‘রাইনীতিক’কে আমাদের সকলের মনে পড়বেই পড়বে। এই চপল রাজনৈতিক হাস্যরস, এই সপাটে রাজনৈতিক বক্তব্য রাখার ধরন— বিজেপির রাজ্য সভাপতি হিসেবে দিলীপবাবুর অভাবকে অনুভূত করাবে।
ক্লাসরুমের শিক্ষাই পারে কোভিড পরবর্তী বেহাল শিক্ষাব্যবস্থাকে পুনরুজ্জীবিত করতে।
যারা ছিন্নমূল তাদের ভালবেসে ফেরানো হোক, হিংসার প্ররোচনায় আরও মানুষকে গৃহান্তরী করা শাসকের কাজ নয়।
জীবনের সকল অন্ধকারে ভালবাসা আর মমত্বের রোদ্দুর পড়ুক, ক্রান্তিকালে এ'টুকুই তো প্রার্থনা।
পাজি, কাঠিবাজ মিডল ক্লাসকে জব্দ করা মার্ক্সের কম্মো নয়, এই কাজটাও একমাত্র মোদীজিই পারেন!
বিশ্বের পুরুষ প্রধানরা আজ সঙ্কটের দিনে যখন দিশাহীন, তখন সঠিক পথ দেখাচ্ছেন মহিলা রাষ্ট্রপ্রধানই।
সরকার বিরোধী মত উঠে আসাতেই কি মন্ত্রীর কাছে ‘সাম্রাজ্যবাদী’ ইন্টারনেট?