পরীক্ষা বিষয়ে পড়ুয়াদের ভীতি থাকাই স্বাভাবিক। তা বলে দেশের বিরোধীরা পড়ুয়াদের পরীক্ষা দেওয়া আটকাতে এত হইহল্লা করছেন কেন বোঝা যাচ্ছে না। বিরোধীরা ভুলে যাচ্ছেন, স্বয়ং প্রজাপালক রামচন্দ্রও শুধু পাবলিক ডিম্যান্ডে নিজের প্রিয় স্ত্রীয়ের অগ্নিপরীক্ষা নিয়েছিলেন। আর এখানে তো মামুলি একটা খাতায় কলমের পরীক্ষা। অনেকেই করোনার দোহাই দিচ্ছেন বটে, কিন্তু সেটাকে চূড়ান্ত ফাঁকিবাজ আর কাঠিবাজদের এক অসহায় প্রতিযুক্তি ছাড়া আর কিস্যু মনে হচ্ছে না। আরে বাবা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পরীক্ষা দেওয়ার মধ্যে যে গৌরব আছে, যে হিরোইজম আছে, সেটা কি সাধারণ অবস্থায় হেসে খেলে পরীক্ষা দেওয়ার মধ্যে আছে? দেশের প্রধানমন্ত্রীর কথাই ভাবুন না। প্রান্তিক এক পরিবার থেকে উঠে এসে জীবনের প্রতিটি পরীক্ষায় সফল হয়ে আজ তিনি কীভাবে রাজসিংহাসনে আরোহন করেছেন— যা যে কোনও রূপকথাকেও হার মানাবে!
বিরোধীরা গত 70 বছর ধরে সার্বিকভাবে এই পরীক্ষার বিষয়ে উদাসীনতা দেখিয়েছেন বলেই তো আজ দেশের এই শোচনীয় পরিণতি হয়েছে। এর ফলে কাশ্মীরি নিজেকে কাশ্মীরিই ভেবেছে, সে কতটা ভারতীয় তার পরীক্ষা নেওয়া হয়নি। দলিত নরনারী এতকাল দিব্যি উচ্চবর্ণের মাঠঘাট দিয়ে হেঁটে বেড়িয়েছে, অথচ তাদের আনুগত্যের পরীক্ষা নেওয়া হয়নি। আসামের বাঙালিও জীবন-চাকরি সুরক্ষিত রাখতে নিজেদের অসমের ভূমিপুত্র বলে দাবি করে এসেছে। এখানেও একইভাবে তারা কতটা অহম জাতীয়তাবাদের শরিক, আর কতটাই বা সাচ্চা দেশবাসী তার পরীক্ষা নেওয়া মুলতুবি থেকে গেছে। কিন্তু দেশের বর্তমান শাসক ঠিক করেছে, মুফতে এসব স্বেচ্ছাচার আর চলবে না। কমবেশি প্রত্যেক ভারতীয়কেই এবার কঠিন পরীক্ষায় বসতে হবে। সেখানে সসম্মানে উত্তীর্ণ হতে পারলে, তবেই কিছু নাগরিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য মিলতে পারে! অনুত্তীর্ণদের জন্য রাষ্ট্রই বিকল্প কিছু ব্যবস্থার সংস্থান রাখছে!
কাশ্মীরের 19 বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী— সুহেল আব্বাস মহরমের মিছিলে হাঁটছিল। একেই কাশ্মীরি, তায় মুসলিম— রাষ্ট্রের বৃহত্তর পরীক্ষায় তার উত্তীর্ণ হওয়ার কথা ছিল না। আর সে হয়ওনি। তার শরীরে জম্মু কাশ্মীর পুলিশ 50 টি ছররা গুলি গেঁথে দিয়েছে। শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, তরুণটি তার দুই চোখের দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি হারাতে চলেছে। আসামের হাইলাকান্দির সফিয়া খাতুন, বয়স 50-এর কোঠায়। ভোটার কার্ডে নাম ভুল থাকায় সন্দেহজনক নাগরিক (সরকারি পরিভাষায় ডি-ভোটার) তালিকায় নাম উঠেছিল। জাতীয় নাগরিক পঞ্জীর সর্বশেষ তালিকায় সফিয়ার নাম ওঠেনি। তবে সফিয়ার স্বামী, দুই পুত্র এবং পাঁচ ভাই এ যাত্রায় নাগরিকত্ব প্রমাণের পরীক্ষায় সফল হতে পেরেছেন। সফিয়া খাতুনের কাহিনি শুনে স্বয়ং সুপ্রিম কোর্টও বিস্মিত। পরিবারের সকলে নিজেদের বৈধ নাগরিক প্রমাণ করতে পারলেও, সফিয়া কেন পারলেন না, প্রশ্ন তুলেছে দেশের শীর্ষ আদালত। কিন্তু রাষ্ট্রের পরীক্ষীয় কে কীভাবে পাশ করবে, সেতো রাষ্ট্র আর তার নির্বাহকরা ছাড়া কেউ জানে না।
বেশ কিছু ঘটনায় অবশ্য এই পরীক্ষাটাকে স্রেফ সময় এবং অর্থের অপচয় বলে মনে হয়। রাষ্ট্র এবং সরকার সেক্ষেত্রে আগাম ফলাফলটা জানিয়ে দিয়েই পরীক্ষা শুরু করে। উত্তরপ্রদেশের আকলাখের ফ্রিজে যে গো-মাংসই ছিল, তার পরীক্ষার প্রয়োজন ছিল না। উপসংহারে উপনীত হয়েই আকলাখের কাছে কিছু মানুষ পরীক্ষা চেয়েছিল। আকলাখ যে সেই পরীক্ষায় অসফল হয়েছিলেন, এমনটা প্রমাণিত হয়নি। তবে অনুত্তীর্ণদের জন্য যে বিকল্প ব্যবস্থা, তার মধ্য দিয়েই যেতে হয়েছিল আকলাখকে। একই কথা প্রযোজ্য রাজস্থানের পহেলু খানের ক্ষেত্রেও। গোরু-পাচারকারী সন্দেহে পিটিয়ে খুন করা হয়েছিল তাঁকে। মুসলিম এবং গোরুর সহাবস্থান হলে আধুনিক ভারতে পরীক্ষার প্রয়োজন আর পড়ছে না। বিশুদ্ধ হিন্দুত্ব, বিশুদ্ধ দেশপ্রেমের পরীক্ষায় অসফল হলেই রাষ্ট্রের খাতায় ঘ্যাচাং ফু। আপনি সফল হোন বা অসফল— এই অসম পরীক্ষায় আপনাকে বসতেই হবে। বছরে তিনবার করে বন্যা হওয়া কাছাড়-বরাক উপত্যকার মানুষেরা 40 বছর আগেকার কাগজ খুঁজে ট্রাইবুনালের লাইনে দাঁড়াচ্ছেন, মুসলিম ভিক্ষুক ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে ‘জয় শ্রী রাম’ বলছেন— আর লাখ ত্রিশেক ছেলে মহামারীর মধ্যে পরীক্ষা দিতে পারবে না, অ্যাঁ?
সাম্প্রতিক করোনা আবহে সরকারের লোকজন অবশ্য ভার্চুয়াল জগতে মৌখিক প্রশ্নের মাধ্যমেও পরীক্ষার সুবন্দোবস্ত রেখেছে। এই যদি এখন আপনি প্রশ্ন তোলেন, দেশের করোনা সংক্রমণের হার যখন উর্দ্ধমুখী, তখন কি মন্দির না বানিয়ে কিছু হাসপাতাল বানানো যেত না? তখন উল্টোদিক থেকে প্রশ্ন আসবে, 'তোর জন্ম কোথায়?', 'জন্মদাতা কি মুসলিম?' ইত্যাদি। সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দলিত অধ্যাপিকা এই পরিস্থিতিতে পরীক্ষা নেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ফেলেছিলেন। ভুলে গিয়েছিলেন পরীক্ষা কার, কখন এবং কীভাবে নেওয়া হবে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার শুধু রাষ্ট্রের। যাইহোক, তাঁর কাছে প্রশ্ন ধেয়ে এসেছে, কোটায় কাকে ধরে তিনি এই চাকরিটা বাগিয়েছেন। জানিনা সেই অধ্যাপক সেই প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিতে পেরেছেন কিনা। না হলে রাষ্ট্রের বিকল্প ব্যবস্থা যে তাঁর উপরও বলবৎ হবে না, এমন নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না।
দেশের গণতন্ত্রের বিজ্ঞাপনী প্রোমোতে বলা হয়, এখানে পাঁচ বছর অন্তর সরকারকে জনগণের পরীক্ষার সামনে দাঁড়াতে হয়। কিন্তু আজকাল বড় ধাঁধা লাগে চোখে, খালি চোখে বোঝা যায় না আসলে কে কার পরীক্ষা নিচ্ছে। সংসদ হোক বা সোশাল মিডিয়া, শাসককে প্রশ্ন করা মানা। কিন্তু শাসকের কাঠগড়ায় প্রতিদিন দাঁড়াতে হবে দেশের জনগণকে। শাসকই ঠিক করবে কে বেকসুর খালাস হবে, কে-ই বা যাবজ্জীবন। পরীক্ষা দিতে দিতে ক্লান্ত দেশবাসী ভাবে, ‘কোন খেলা যে খেলব কখন’।
কথা রাখে না সরকার, রেললাইনে মরাই যেন ভবিতব্য পরিযায়ী শ্রমিকদের।
শিল্পীর শিল্প কালোত্তীর্ণ হয় মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় সরকারের দেওয়া রাষ্ট্রীয় খেতাবে নয়।
রাজ্যের নির্বাচনী সাফল্যের সূত্র ধরে দলের প্রসারের চেষ্টা করছে তৃণমূল কংগ্রেস
যুদ্ধ-যুদ্ধ আবহে আপাতত ‘দেশপ্রেমী' সাজতে চাইছেন সবাই
কুচক্রীরা সারাক্ষণ গুজরাত মডেলকে গাল পাড়লেই বা, উন্নয়ন বলতে দেশবাসী তো গুজরাতকেই বোঝে!
স্বাধীনতার 75 তম বছরে যে গণ-আন্দোলন প্রতিস্পর্ধী শাসককে নতজানু করল, সেই আন্দোলনেরও প্রেরণা মহাত্মা।