×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • সাত বোনের গৌরবে আছে, যন্ত্রণায় নেই বড় দাদা

    বিতান ঘোষ | 04-03-2021

    শর্মিলা চানু ও মীরাবাই চানু: উত্তর-পূর্ব ভারতের দুই চানুর প্রতি বাকি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি দু'রকম।

    লাভলিনা বরগোঁহাইয়ের অখ্যাত গ্রামের কাঁচাপাকা রাস্তায় এখন নেতামন্ত্রীদের ভিড়। গ্রামের মেয়ে অলিম্পিকের মঞ্চে ব্রোঞ্জ জিতেছে। সারা দেশ তাই নিয়ে উদ্বেলিত। নেতামন্ত্রীদের যাতায়াত সুগম করতে কালো পিচ পড়ছে সেই মেঠো রাস্তায়। লাভলিনার কষ্টার্জিত ব্রোঞ্জের বিনিময়ে স্বাধীনতার সাড়ে সাত দশক পর পাকা রাস্তা পাচ্ছে উত্তর-পূর্বের একটা জনপদ।

     

     

    অরুণাচল প্রদেশ, সম, মেঘালয়, মিজোরাম, মণিপুর, ত্রিপুরা ও সিকিম— উত্তর-পূর্ব ভারতের এই সাতটি রাজ্যকে একত্রে ‘সেভেন সিস্টার্স’ বলা হয়। কিন্তু বাকি ভারতের কাছে এই ‘সাত বোন’ যেন সৎ বোন। কালেভদ্রে কিছু খেতাব, সম্মান জুটলে তার ভাগীদার হওয়ার প্রত্যাশায় বাকি ভারত এদের ‘ভারতীয়’ বলে মনে নেয়। উত্তর-পূর্ব ভারতের আর্থ-সামাজিক মানোন্নয়নের সূচকের দিকে যদি চোখ রাখা হয়, তবে লজ্জিত হতে হবে আমাদের, আমরা যারা মীরাবাই চানু বা লাভলিনার জয়ে শরিক হতে চাইছি।

     

     

    উত্তর-পূর্ব ভারতের বাসিন্দা মানেই তো বাকি ভারতের কাছে সে ‘চিঙ্কি’ বা ‘চাইনিজ’ভারতের মূলস্রোতের রাজনীতি, সমাজ থেকে যেন সহস্র যোজন দূরে অবস্থান করে মণিপুর কিংবা অরুণাচল প্রদেশ। এখানকার অজস্র উপজাতি, তাদের লৌকিক আচার-অনুষ্ঠান, সামাজিকতা দিয়ে পুষ্ট করে দেশের বহুত্ববাদকে। তবু ব্যবধান ঘোচে না। এখনও খাস দিল্লির বুকে উত্তর-পূর্বের নিডো তানিয়াদের স্বতন্ত্র মুখাবয়ব থাকার দায়ে মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে মরতে হয়। মণিপুরের মীরাবাই চানুকে নিয়ে সমাজ মাধ্যম উচ্ছ্বাসে ভেসে যায়, দেশ ভুলে যায় মণিপুরের আর এক চানুকে, যার নাম শর্মিলা।

     

     

    ইরম শর্মিলা চানু। দীর্ঘ 16 বছর অনশন আন্দোলন করেছেন সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আফস্পা প্রত্যাহার করার দাবিতে। এই বিশেষ ক্ষমতাবলে দেশের সেনাবাহিনী নির্দিষ্ট কিছু স্থানে যে কোনও সন্দেহভাজনকে সরাসরি গুলি করতে পারে। এবং সেখানে নিরীহ কোনও মানুষকে সেনাবাহিনী গুলি করে মেরে ফেললেও, তার সাত খুন মাফ। এমন ‘খুন’ উত্তর-পূর্বে কম হয়নি। শর্মিলা এর বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। কিন্তু উত্তর-পূর্ব ভারতে মানবাধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা খুবই শৌখিন কিছু ব্যাপার।

     

     

    নাতিদীর্ঘ নাক, গোল মুখ, অপেক্ষাকৃত ছোট চোখ, ফর্সা গায়ের রঙ— নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে প্রাচীন নর্ডিক জাতির এই সমস্ত বৈশিষ্ট উত্তর-পূর্বের অধিকাংশ বাসিন্দার মধ্যেই বিদ্যমান। এখানকার অধিকাংশ পুরুষই কর্মসূত্রে ভিনরাজ্যে থাকে। বাড়ির মেয়েদেরই সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিতে হয়। প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়তে লড়তে বাঁচার মন্ত্র শিখে যায় এরা। আর এই মন্ত্রবলেই এখানকার মেয়েরা দেশের জন্য পদক আনে। একটি মেডিকেল জার্নালের সমীক্ষাও জানাচ্ছে, দেহের ক্ষুদ্র গড়ন, পরিশ্রমী শরীরে ভাতের মতো কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার অভ্যাস এখানকার মেয়েদের বক্সিং, ভারোত্তোলনের মতো কঠোর পরিশ্রমের খেলাগুলোয় টেনে আনে। আর যারা এসব পারে না, যাদের ভাগ্য এত সুপ্রসন্ন নয়, তাদের দেখা যায় দেশের বিখ্যাত সব যৌনপল্লীগুলিতে। পদক বা আন্তজার্তিক খেতাব জয়ের সময়টুকু ছাড়া, এক ওই জৈবিক তাড়নায় কিছু সময়ের জন্য বাকি ভারত উত্তর-পূর্ব ভারতকে ‘আপনার’ করে নেয়। অন্যান্য সময় ভারত রাষ্ট্রের স্বাধীন জায়গীর হিসাবেই মানচিত্রে ঠাঁই করে নিতে হয় এই রাজ্যগুলিকে। দেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে মোতায়েন থাকা সেনাবাহিনীর কর্তাব্যক্তিদের মনোরঞ্জনেও এখানকার মেয়েরা ব্যবহৃত হয়। কখনও পারস্পরিক সম্মতি ও যৎসামান্য টাকার বিনিময়ে, কখনও বা জোরপূর্বকই পুরো বন্দোবস্তটা চলে। তাই মণিপুরের মেয়েরা নগ্ন হয়ে যখন হাতে ব্যানার নিয়ে বলে, ‘এসো, আমাদের ধর্ষণ করো’, তখন বাকি ভারত খুব বেশি নড়েচড়ে বসে না।

     

    আরও পড়ুন: মেয়েরাই দেশের গৌরব আনছে টোকিও থেকে

     

    দেশের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক পরম্পরায় দেখা গিয়েছে কেন্দ্রে যে দল ক্ষমতাসীন হয়েছে, সেই দল কিছুদিনের মধ্যেই উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে নিজেদের পছন্দমতো সরকার তৈরি করেছে। সেক্ষেত্রে সেখানকার স্থানীয় রাজনীতি, অভাব অভিযোগ খুব বেশি গুরুত্ব পেয়েছে বলে মনে হয় না। বৃহত্তর ভারত শুধু কাশ্মীরে নয়, উত্তর-পূর্ব ভারতেও দখলের মনোভাব নিয়েই এগিয়েছে, সামাজিক-অর্থনৈতিক ভাবে পশ্চাৎপদ এই রাজ্যগুলির দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। আর্যাবর্তের জটিল রাজনীতির ঘূর্নিপাকে বনবন করে ঘুরেছে উত্তর-পূর্ব ভারত। সয়েছে চিনা হামলা। এখন যেমন উত্তাপ ছড়াচ্ছে মিজোরাম-সম সীমানা।

     

     

    সমাজ মাধ্যমেই জানা গেল, মীরাবাই ঋতুস্রাবের যন্ত্রণা নিয়ে ভার উত্তোলন করেছেন। মীরাবাই দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন, তাই বাকি ভারত সমব্যথী তার এই যন্ত্রণায়। কিন্তু মীরাবাঈদের যন্ত্রণা তো প্রাত্যহিক। তারা বাকি ভারতকে গৌরবান্বিত না করলে তাদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে কাঠ কেটে আনার গল্পগুলো কি আমরা আদৌ শুনতাম? তাঁদের জীবন সংগ্রাম নিয়ে বলিউডের বক্স অফিস সফল অভিনেত্রীকে দিয়ে বায়োপিক বানাতাম? না, এতটা ঔদার্য আমরা কখনওই উত্তর-পূর্বের প্রতি দেখায়নি। তাই, লাভলিনা, মীরাবাইরা তাঁদের পদকগুলি যতই সারা দেশের জন্য উৎসর্গ করুন, তাতে বোধহয় বাকি আমাদের, বাকি ভারতের খুব বেশি অধিকার থাকে না। জাতীয়তাবোধের তুফানস্রোতে সব বঞ্চনার গল্পগুলোকে ঢাকা দেওয়া যায় না। স্বার্থপরের মতো ‘সাত বোন’-এর গর্বের ভাগীদার হতে চেয়েছি আমরা, দুঃখ যন্ত্রনার ভাগ নিতে চাইনি।


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    শহরের বৈচিত্র্যময় মিছিলে বিভাজন রোখার ডাক।

    হে রাম! গান্ধী-সুভাষ ভিক্ষা করেও স্বাধীনতা আনতে পারলেন না, আনলেন সেই মোদীজি।

    বোম্বে বন্দর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে স্প্যানিশ ফ্লু যা পরে বোম্বে ফ্লু নামে পরিচিত হয়।

    মুসলমানরা মিমকে এককাট্টা ভোট দিলে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির কোনও গুরুত্ব থাকবে না।

    নাবালিকা 'ধর্ষণ' নিয়ে মমতার এমন অসংবেদনশীল মন্তব্য ও ভাবনার শরিক বহু সাধারণ মানুষ, সে আমরা প্রকাশ্যে

    স্বাধীনতার রক্তাক্ত ইতিহাস পদ্মফুল আর লেজার শো দিয়ে তারাই ঢাকতে পারে, যারা সেই সংগ্রামের শরিক নয়।

    সাত বোনের গৌরবে আছে, যন্ত্রণায় নেই বড় দাদা-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested