×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সংবিধান

    বিতান ঘোষ | 26-11-2020

    সংবিধানের প্রস্তাবনা।

    দেশে সাংবিধানিক ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর কেটে গেছে 70টা বছর। গোড়ার দিকে দেশ-বিদেশের পণ্ডিতরা বলেছিলেন, তৃতীয় বিশ্বের দেশ ভারতবর্ষে গণতন্ত্র জিনিসটি বেশিদিন টিকবে না। স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর দেশে যখন নয়া সংবিধান প্রণয়ন করার কাজ চলছে, তখন ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল পর্যন্ত বিদ্রুপ করে বললেন, ‘সংখ্যাগুরুর স্বার্থ পূরণ করতেই সংবিধানের মুসাবিদা করা হচ্ছে।তবু থামেনি সেদিনের ভাগ্যের অভিসারেধাবমান ভারতবর্ষ। সেদিনের নেতৃবৃন্দের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা যে আইনি রক্ষাকবচ প্রত্যেক ভারতবাসীর হাতে তুলে দিয়েছিল, সেই রক্ষাকবচই বলীয়ান শাসকের অস্ত্রের সামনে রক্ষা করে চলেছে আজকের অসহিষ্ণু, সংখ্যাগুরুর ভারতের সংখ্যালঘু ভারতবাসীকে


    সংবিধান প্রণয়নের জন্য 1946 সালে যে গণপরিষদ গঠন করা হল, সেখানকার সিংহভাগ সদস্যই ছিলেন কংগ্রেসের। কিন্তু ভুললে চলবে না, কংগ্রেস ছিল এমন একটি মঞ্চ যেখানে বিভিন্ন মত, পথের মানুষ সমবেত হতেন। তাই তাঁদের ভিন্ন ভিন্ন ভাবনাচিন্তার প্রতিফলন গণপরিষদের বিভিন্ন আলোচনায় উঠে এল। আলোচনা কখনও বিবাদের পর্যায়েও পৌঁছল। কঠিন হাতে এই সমস্যাগুলির মীমাংসা করে সভার কার্য এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন রাজেন্দ্র প্রসাদ— গণপরিষদের সভাপতি, পরবর্তী সময়ে যিনি ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি হবেন। নেহরু তাঁর পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তব্যে গণপরিষদে গৃহীত প্রতিটি সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন। অন্যদিকে বল্লভভাই প্যাটেলের মুন্সিয়ানাতে গণপরিষদের বিভিন্ন বিষয়ে সদস্যদের মধ্যে ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠা করা গেছে। তবে, গণপরিষদের কার্যক্রমে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন বি আর আম্বেদকর। পেশায় আইনজীবী এই দলিত রাজনীতিক বিশ্বের বৃহত্তম লিখিত এই সংবিধানের মুসাবিদা করেন। সংবিধান প্রণয়নের সময় এই আম্বেদকর কিন্তু কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন না। শুধু তাই নয়, নেহরুর মত ও পথের আগাগোড়া বিরোধী ছিলেন তিনি। এতদসত্ত্বেও সদ্য স্বাধীন দেশের সংবিধান রচনার গুরুভার আম্বেদকরের হাতেই তুলে দিতে চেয়েছিলেন নেহরু। হে ভারত ভুলিও না, রাজনৈতিক মতপার্থক্য এই দেশে কখনওই বৃহত্তর স্বার্থের প্রতিবন্ধকতা স্বরূপ ছিল না


    বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ উপন্যাসে স্বদেশকে মাতৃজ্ঞানে দেখা হল। অবন ঠাকুরের ভারতমাতাতেলরঙে ফুটে উঠলেন তারও বেশ কিছু সময় পরে। এখন তো ভারতমাতার নামে তার সন্তানরা সংখ্যালঘুকে কোপাচ্ছেন, সংখ্যাগুরুর ধর্মবিশ্বাস দ্বারা নির্মিত মন্দিরের ভূমিপুজোয় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত থাকছেন। দেশের রাজধানী দিল্লিতে সংখ্যালঘু মহল্লা জ্বলছে। গণপরিষদে দেশের সংবিধান গৃহীত হওয়ার 72 তম বর্ষে কেমন আছেন ভারতমাতা? তাঁকে এখন দেখতে হয়েছে কেমন? ওই শাহিন বাগের বিলকিস বানোর মতোই কি দেখতে লাগে তাঁকে? নাকি সিএএ-এনআরসির বিরুদ্ধে নাগরিক মিছিলে মিশে থাকেন বয়সের ভারে ন্যুব্জ ভারতমাতা? গীতা-কোরানের রাজনৈতিক লড়াইয়ে কতটা সুরক্ষিত আছে দেশের সংবিধান?


    রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও দেশের সংবিধানের শক্তি ও ক্ষমতার ওপর আস্থা রেখেছেন। তাঁর মতে, “কুসুমাস্তীর্ণ পথে না হেঁটেও, অন্যান্য দেশের সাপেক্ষে আমাদের সংবিধান অনেক বেশি সাফল্যের মুখ দেখেছে। একইসঙ্গে তাঁর কথায় উঠে এসেছে এক আশঙ্কার দিকও। এই দেশ জরুরি অবস্থা দেখেছে, দেখেছে নানা জোট সরকারও। কিন্তু একক সংখ্যাগরিষ্ঠ কোনও দল ক্ষমতায় থাকলে সাংবিধানিক মূল্যবোধগুলি নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, বহুত্ববাদ এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এটা একটা ভয়ের দিক”, বলছিলেন অধ্যাপক রায়চৌধুরী। তবে আকালেও কি দেশবাসী স্বপ্ন দেখবে না? সব্যসাচীবাবুর মতে, “প্রত্যেক ভারতবাসী আমাদের সংবিধানের পাহারাদার। তাই সময় যতই কঠিন হোক, আমাদের সবাইকে সজাগ থাকতে হবে, যাতে সাংবিধানিক মূল্যবোধগুলিকে আমরা রক্ষা করতে পারি।সংবিধান প্রণেতারা সকল সম্ভাব্য পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে দেশের সংবিধানকে রূপ দিয়েছিলেন। অজস্র ধারা-উপধারার মিশেলেও সামাজিক ন্যায়বিচার, সাম্য এবং নাগরিকের মৌলিক অধ্কারের ধারণাকে জনগণ তথা সমাজের নৈতিক বোধের কাছে সমর্পণ করেছিলেন আম্বেদকর। সবসময় কি সেই নৈতিকতা যথাযথ মাত্রায় রক্ষা করা হয়তো সম্ভব হয়নি। তবে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী এই বিষয়ের উপর জোর দেন যে, ভারতীয় সংবিধান আন্তর্জাতিক নিরিখে যথেষ্টই স্থিতিশীল। তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে স্বাধীনতা পাওয়া বহু দেশই 70 বছর ধরে একটা সংবিধানকে টিকিয়ে রাখতে পারেনি। সেই অর্থে বলতে হয় আমাদের সংবিধান কালোত্তীর্ণ।




    1947-এ নিদ্রামগ্ন পৃথিবীর বুকে হর্ষধ্বনিতে স্বাধীনতার ঘোষণা করা এই দেশ সাতের দশকের শেষে জরুরি অবস্থা দেখেছে। দেখেছে রাষ্ট্রের কোপে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে বলিপ্রদত্ত হতে। এই সংবিধানের চালিকাশক্তি যারা, তারা সেদিনের সেই কুশীলবদের ক্ষমা করেনি। সাংবিধানিক পদ্ধতিতে গৃহীত জনাদেশেই তারা জনগণের থেকে বিচ্ছিন্নহয়ে গিয়েছিলেন। বিলম্বিত বোধোদয়ে পরে শরণ নিয়েছিলেন সেই সংবিধানেরই। রোমাঞ্চপ্রিয় শাসক অবশ্য এখনও এই সংবিধান নিয়ে খেলতে চান। যাবতীয় সাংবিধানিক শিষ্টাচারকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে ক্ষমতা প্রদর্শন করতে চান। তারা ভুলে যান, শত আঘাতের পরেও, শত নৈরাশ্যবাদীর আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণিত করেও এতকাল টিকে রয়েছে সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, প্রজাতন্ত্র ভারতের সংবিধান। এখনও দেশের কোনও প্রান্তে কোনও সংখ্যালঘু কন্ঠে উঠে আসছে সেই আদি অকৃত্রিম ভারতমাতার কথা। শাসক কি তা শুনতে পান? ওই দেখুন, দূরের পাঠশালায় কোনও উদয়ন পণ্ডিতের সুরে সুর মিলিয়ে পড়ুয়ারা বলছে, ‘আমরা ভারতের জনগণ...।' প্রিয় শাসক, এই নিরস্ত্র নিরীহ নাগরিকদের এই নির্ভীক উচ্চারণে একটু থমকে গেলেন নাকি?

     


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    আমেরিকা আবারও দেখিয়ে দিল এই দেশটা যেমন জর্জ ওয়াশিংটনের, তেমনই জর্জ ফ্লয়েডেরও

    শুধু আনমনেই বলে উঠেছি, ‘স্বপনদুয়ার খুলে এসো, অরুণ-আলোকে এসো স্তব্ধ এ চোখে...।'

    তথাকথিত উন্নয়নের পক্ষে সুবিধাজনক হাতিদের সন্দেহজনক মৃত্যুতে তদন্ত কমিটি।

    হঠকারিতায় বিচ্ছিনতাবাদের প্যান্ডোরার বাক্স খুলে ফেললে তাকে বন্ধ করা মুশকিল।

    দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সঙ্ঘ এবং মহাসভা আগাগোড়া অনুপস্থিত থেকেছে

    কুচক্রীরা সারাক্ষণ গুজরাত মডেলকে গাল পাড়লেই বা, উন্নয়ন বলতে দেশবাসী তো গুজরাতকেই বোঝে!

    কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সংবিধান-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested