‘পাকিস্তানের সমর্থক সন্দেহে প্রহৃত কাশ্মীরি যুবক’। এটি একটি সংবাদের শিরোনাম।
‘পাকিস্তানের জয়ে উল্লসিত হয়ে বাংলা এবং ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বোমা ফাটালেন দেশদ্রোহী মানুষেরা।' এটি একটি বহুল প্রচারিত হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজের প্রথম দু'টি লাইন।
নিছকই একটি 22 গজের খেলা। ক্রিকেট। মুখোমুখি দু'টি দল। ভারত ও পাকিস্তান। দু'টি স্বতন্ত্র ডোমিনিয়ন হিসাবে আত্মপ্রকাশ করার পর থেকে, এই দু'টি দেশের মধ্যে রাজনৈতিক বৈরিতা বারবার প্রকাশ্যে এসেছে। খান চারেক সরকারি যুদ্ধ এবং অসংখ্য বকলমে যুদ্ধ হয়েছে। মাঠের খেলা হোক বা সমরাঙ্গন, ভারত-পাকিস্তান মুখোমুখি হলেই সীমান্তের দুই পারে উত্তেজনার পারদ ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। কিন্তু ইদানীং যেটা হচ্ছে, তাকে নিছক তাৎক্ষণিক উত্তেজনার আতিশয্য কিংবা বিশুদ্ধ দেশপ্রেমের সরব উপস্থিতি বলা চলে না। সীমান্তের ওপারের কথা বলতে পারব না, কিন্তু এই পারে যা ঘটছে, তা হল এই সমস্ত ঘটনাগুলোকে খাড়া করে, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বধ্যভূমি করে তোলা হচ্ছে এই দেশকে।
দ্বিজাতি তত্ত্বের হাত ধরে দু'টি দেশ আলাদা হয়েছিল। তারপর তারা আগাগোড়া আলাদা দু'টি পথ ধরে এগিয়েছে। পাকিস্তান গোড়ার দিন থেকেই একটি ইসলামিক রাষ্ট্র, আর ভারত ধর্মনিরপেক্ষ; ক্লাসিক ধর্মনিরপেক্ষতার শর্ত মেনে ধর্মবিচ্যুত বা ধর্মবিহীন রাষ্ট্র কিন্তু নয়। এ দেশের অন্তরে ভাব ভক্তির, অথচ সেখানে একটা গ্রহিষ্ণু সত্তাও বিদ্যমান— কেউ কেউ তাকে বিশুদ্ধ inclusivity বলতে পারেন। বহু তাপ ও তপে সিদ্ধ হয়ে আজকের এই ভারতীয় উপমহাদেশ দাঁড়িয়ে আছে— ভারত সেই উপমহাদেশের ক্ষুদ্র একটি সংস্করণ। বাকিদের অনেকেই উগ্র ধর্মীয় রাজনীতিকে উপজীব্য করে এগিয়েছে। পশ্চিমি গণতন্ত্র নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছে, কিন্তু ফিরে গেছে সেই একনায়কতন্ত্র কিংবা সেনা শাসনে।
ওয়াঘা সীমান্তের এই প্রান্তের তোড়নের মাথায় গান্ধী। অপর প্রান্তের তোড়নের মাথায় জিন্না। ইসলামের বিশুদ্ধতা নিয়ে ভারী স্পর্শকাতর ওয়াঘার অপর প্রান্ত। পাকিস্তানের প্রাক্তন ক্রিকেটার থেকে ইমরান সরকারের মন্ত্রী, সকলেই ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের জয়কে ইসলামের জয় হিসাবে দেখাতে চাইছেন। কিন্তু পাকিস্তানের স্থপতি জিন্না স্বয়ং ব্যক্তিজীবনে, ব্যবহারিক জীবনে ইসলামকে কতটা মানতেন?
এ পারের ঘটনাক্রমগুলি মনকে আরও পীড়া দেয়। ভারতের পথ মস্কোরও না, হয়তো পণ্ডিচেরিরও না। ভারতের পথ বেঁকে গেছে সবরমতীর আশ্রমে, কোনওটা আবার শান্তিনিকেতনে। এই পথ ধরে এগিয়ে আমরা জাতীয়তাবাদের অর্থ শিখেছি, ঔদার্যের পাঠ নিয়েছি। সেখান থেকে আজ স্খলিত হয়ে কোন রসাতলে পতিত হলাম আমরা? কোনও বিশেষ লক্ষ্য বা উপলক্ষ্যে কিংবা কোনও লক্ষ্য ছাড়াই দেশের সংখ্যালঘু সমাজকে কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে, তারপর উপর্যুপরি পীড়ন, সঙ্গে দেশদ্রোহের অভিযোগ। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের নিদান, ভারতে থেকে কেউ পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে সমর্থন করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা রুজু করা হবে। সেই রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসনও শাসকের আজ্ঞাবহ হিসাবে দেশদ্রোহী সন্ধানে ব্যস্ত। তার মানে ডুরান্ড কাপ বা রঞ্জি ট্রফির খেলা না দেখে রাত জেগে বিদেশি লিগ কিংবা ফুটবল বিশ্বকাপে ব্রাজিল-আর্জেন্তিনার জন্য গলা ফাটানোর আগে প্রত্যেকের এবার সাবধান হয়ে যাওয়া জরুরি। গুলাম আলির গজল কিংবা ওয়াসিম আক্রমের বোলিং-এ মন্ত্রমুগ্ধ হওয়াও নৈব নৈব চ!
আরও পড়ুন: মন্ত্রমুগ্ধ মধ্যবিত্ত: মার্ক্স নয়, মোদীর কীর্তি
দ্রোহ কী, তা কি একে ওকে দেশদ্রোহী বলে দেওয়া মানুষেরা জানেন? জানি না, সেদিন ভারতে কতটা বাজি ফুটেছিল বা আদৌ ফুটেছিল কিনা। এটাও জানি না যে, বাজিটা ঠিক পাকিস্তানের জয়ে উল্লসিত হয়েই কেউ ফাটিয়েছিলেন কিনা। কিন্তু যদি কেউ সত্যিই পাকিস্তানের জয়ে আনন্দিত হয়ে বাজি ফাটান, তাতে কতটা দ্রোহ হয়? সত্যিই কি সেই ব্যক্তি দ্রোহী হন? জগতের বিবিধ খেলায় আমরা স্বদেশ ভিন্ন অন্যান্য দেশগুলিকেও সমর্থন করি। তখন কি দ্রোহের প্রশ্ন ওঠে না? মানছি নানা রাজনৈতিক কারণে পাকিস্তান আগাগোড়া আমাদের বৈরী দেশ। কিন্তু এটাও স্মরণে রাখতে হবে, জটিল রাজনীতির আবর্তে পড়ে আমাদের অনেককেই অনেকবার ঠাঁইনাড়া হয়ে হেথাহোথা যেতে হয়েছে। উপমহাদেশ জুড়ে উভমুখী শরণার্থী স্রোত বহমান থেকেছে দীর্ঘকাল। সব দেখেশুনে তথাকথিত এই জাতীয়তাবাদের ওপর প্রবল বিতৃষ্ণা তৈরি হয়েছে মনে। তাছাড়া সবরমতী আশ্রম আর শান্তিনিকেতনের যে মরমী ও স্বয়ংসম্পূর্ণ পথ ধরে এই ভারতবর্ষের চলন, তাতে কোনও ক্ষুদ্রতা কখনও গ্রাস করেনি। ভাবনার দৈন্যও এতটা প্রকট হয়নি যে, কেউ আমার জাতীয়তাবাদী হুল্লোড়ে আমার মতো করেই হুল্লোড় না করলে তাকে শত্রু ঠাওড়াব। যুদ্ধাস্ত্র, সৈন্যবলে ভারত কতটা বলীয়ান জানা নেই, কিন্তু ভারত নামক ধারণাটিই এতটা শক্তপোক্ত ভিতের ওপর তৈরি যে, কেউ বাজি ফাটিয়ে বা সংখ্যাগরিষ্ঠের সুরে সুর না মিলিয়ে তাকে ভাঙতে পারবে না।
যারা ধর্মলালিত বিদ্বেষের পথ ধরে এগিয়েছে, যারা দীর্ঘকাল গণতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে সেনাশাসনে দেশ পরিচালনা করেছে, যারা বিশেষ কোনও ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্মের খেতাব দিয়েছে, তারা কী করবে জানি না, সে আমার আপনার হাতেও নেই, কিন্তু ভারতের পথে এত বিদ্বেষ এত বৈরিতা কে জোগাল? এত ঘটনা দুর্ঘটনাতেও যখন এই দেশটা টলেনি, বিদেশি পণ্ডিতদের শত পূর্বানুমান সত্ত্বেও যখন এই দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র কিছু স্খলন নিয়েও এগিয়ে যাচ্ছে, তখন নিশ্চিন্ত থাকুন; দু-পাঁচজন ‘দেশদ্রোহী’ বোমা পটকা ফাটিয়ে বা আপনার সুরে সুর মিলিয়ে ‘জিতেগা ভাই জিতেগা, ইন্ডিয়া জিতেগা’ না বলে এই দেশটার কণামাত্র ক্ষতি করতে পারবে না।
আমেরিকা আবারও দেখিয়ে দিল এই দেশটা যেমন জর্জ ওয়াশিংটনের, তেমনই জর্জ ফ্লয়েডেরও
তামাদি হয়ে যাওয়া দেড়শো বছরের দেশদ্রোহিতা আইনকে কি এই দেশে নিষিদ্ধ করা হবে?
অমুকের ‘দ্যাশ’, তমুকের ‘ভিটে’ নিয়ে এই ‘দেশ’, তাকে অস্বীকার করাই শাসকের মূর্খামি।
নিজেদের দুর্বলতা কাটানোর দাওয়াই খুঁজে না পেলে অন্যরা দল ভাঙাবেই।
বুলডোজার ব্যবহার করা হচ্ছে সহনশীলতা, বহুত্ববাদের মতো প্রকৃত ভারতীয় সত্তাগুলিকে ধ্বংস করতে।
কুমিল্লার দেবীমূর্তি কিংবা অযোধ্যার মসজিদ- ধর্মে নয়, ঘা পড়ছে উপমহাদেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনায়।