×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • সুন্দরবনের ‘ক্লাইমেট রিফিউজি’

    শুভস্মিতা কাঞ্জী | 11-06-2021

    প্রতীকী ছবি

    রিফিউজি, শব্দটা শুনলেই দেশভাগ, যন্ত্রণা, নিপীড়ন, বাস্তুহারা কিছু মানুষ, বোঁচকা বেঁধে এদেশ থেকে ওদেশে পাড়ি দিচ্ছে কাঁটাতার পেরিয়ে, এমনই কিছু ছবি মনে ভেসে ওঠে। কিন্তু বর্তমানে এই রিফিউজি শব্দের সঙ্গে আরও একটা শব্দ যুক্ত হয়ে মানুষের আলোচনার বিষয় হিসেবে উঠে আসছে। শব্দটা হল, ‘ক্লাইমেট রিফিউজি অর্থাৎ, প্রকৃতির জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যাঁদের বাস্তুহারা হতে হয় বা হচ্ছে। ইয়াসের পর নানা ধরনের বাঁধ বানিয়ে সুন্দরবনকে বাঁচানোর যে চেষ্টা হচ্ছে তার কি আদৌ কোনও দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যৎ আছে? নাকি তার থেকে সেখানকার মানুষগুলোকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত? এভাবে প্রাকৃতিক কারণে উৎখাত হওয়া মানুষরাই ক্লাইমেট রিফিউজি।

     

    আরও পড়ুন: সুন্দরবন ডুবু ডুবু, কলকাতা ভেসে যায়

     

    ব্যাপারটা নতুন কিছু নয়দেশে বিদেশে এমন বহু উদাহরণ দেওয়া যাবে। আফ্রিকার লেক চাদ আর নেই। মাত্র 60 বছরে অত বড় একটা লেক স্রেফ উধাও হয়ে গেল। আর এই লেকের সঙ্গে জড়িত ছিল 2.5 কোটি মানুষের জীবন জীবিকা। যাঁরা তাঁদের কাজ হারালেন বলা চলে, কাজ নেই বলে বাসস্থান ছেড়ে অন্যত্র যেতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর ফরেন রিলেশনের মতে, বর্তমানে এই জায়গার ক্লাইমেট রিফিউজির সংখ্যাটা প্রায় 40-45লাখ। অন্যদিকে আমাদের দেশে, উড়িষ্যা উপকূলের সাতভায়া গ্রাম এখন প্রায় সমুদ্রের গ্রাসে। সেখানকার মানুষদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে অন্যত্র। হারাতে হয়েছে বাসস্থান এবং জীবিকা। ফলে ক্লাইমেট রিফিউজি কোনও সহজ সমাধান নয় ঠিকই, তেমনই কিছু ক্ষেত্রে এটা ছাড়া আর অন্য উপায় থাকে না। তবে তার পরবর্তী ধাক্কাটা যে বেশ সুখকর হয় এমনটাও না। 

     

    লেক চাদের উপগ্রহ চিত্র

     

    1970 সালে লেস্টার ব্রাউন প্রথম এই ক্লাইমেট রিফিউজি-র ভাবনা প্রকাশ্যে আনেন। ইউনাইটেড নেশনের ইন্টারগভার্মেন্টাল প্ল্যানেট অন ক্লাইমেট চেঞ্জ-এর মতে এই শতকের শেষে সমুদ্রপৃষ্ঠ প্রায় 0.95-3.6 ফিট বেড়ে যাবে, ফলে সামান্য ঝড় হলেই বা জোয়ার এলেই উপকূল অঞ্চলে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। ফলে বহু মানুষ বাধ্য হবেন তাঁদের বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র সরে যেতে। আর ঠিক এই কথাটাই এখন সুন্দরবনের ঘোড়ামারা, মৌসুনি এবং সাগরদ্বীপের মানুষের ক্ষেত্রে সত্য হতে চলেছে। 

     

    প্রথমে 2009 সালে আয়লা, তারপর 2020-তে আমপান এবং 2021-এ ইয়াস, পরপর এই তিন ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ে সুন্দরবন অঞ্চলের বীভৎস ক্ষতি হয়েছে। বহু গ্রাম, চাষের জমি দিনের পর দিন জলের তলায় থেকে চাষের অনুপযোগী হয়ে উঠেছে, নদী বাঁধ ভেঙেছে। ঠেকনা দেওয়ার মতো শুধু ত্রাণ পৌঁছেছে, পাকাপাকি ভাবে কোনও সমাধান করা হয়নি। কিন্তু এবার ইয়াসের পর দেখা গিয়েছে ঘোড়ামারা দ্বীপ, যা নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছিল তার অনেকটাই এবার জলের তলায় গিয়েছে। বাকি আছে আর মাত্র 1.8 স্কোয়ার মাইল। বাদ যায়নি মৌসুনি এবং সাগর দ্বীপ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন এই দ্বীপগুলোর ক্ষেত্রেই এমন সমস্যা দেখা যাচ্ছে? কেন এই দ্বীপগুলো ডুবে যাচ্ছে? এবং এখানকার বর্তমান বাসিন্দাদের তাহলে ভবিষৎ কী? 

     

    মাত্র 30 বছরে ঘোড়ামারা দ্বীপ তার কতটা জায়গা হারিয়েছে তা এই ছবিতে স্পষ্ট

     

    গবেষক সুতীর্থ বেদজ্ঞর মতে, ‘সুন্দরবনের মানুষের বসতি গড়ে ওঠাটাই একটা ঐতিহাসিক ভুল। ব্রিটিশরা সুন্দরবনকে শুধুমাত্র রাজস্ব আদায়ের জন্য ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। 18 শতক থেকে যেভাবে নদীর স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে বাধা দিয়ে নদী বাঁধ গড়ে মানুষের বসতি এখানে গড়ে উঠেছে, তাতে এটা হওয়ারই ছিল। নদী বাঁধ আদতে একটি নেসেসারি ইভিল। প্রতিবার ঝড় হওয়ার পর বাঁধ মেরামত করতে এবং গ্রামকে রক্ষা করতে তাদের উচ্চতা বাড়ানো হচ্ছে, পলি জমে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নদীর উচ্চতাও। নিচে থেকে যাচ্ছে গ্রামগুলো। ফলে বন্যা হলে, ঝড়ে নদীবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হলেই সমুদ্রের নোনা জল ঢুকে গ্রামগুলোর অবস্থা ভয়াবহ হয়ে উঠছে। কিন্তু এটা আর কোনওদিনই ঠিক হওয়ার নয়। আদতে গোটা সুন্দরবনের কোনও ভবিষ্যৎ নেই। আর ঘোড়ামারা তো হাতের বাইরেই চলে গেছে।' একই সুর শোনা গেল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের অধ্যাপক এবং কলকাতার ইউজিসি-এইচআরডিসি-র ডিরেক্টর লক্ষ্মীনারায়ণ সৎপতি গলায়। তিনি জানান, ‘এই দ্বীপগুলো প্রিম্যাচিওর, ফলে এখানে তো মানুষের থাকারই কথা না। সুন্দরবনের সামনের দিকে দ্বীপগুলোতে এখনও ভাঙা গড়া চলছে। আর মৌসুনির মতো দ্বীপগুলো আদতে চর বা তার থেকে একটু বড়। ওগুলো এখনও দ্বীপ হয়ে ওঠেনি পুরোপুরি। ফলে সেখানে আমপান বা আয়লার মতো বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ এলে এমনটা হবেই। তাই মানুষের বসতি সেখানে না গড়ে তোলাই শ্রেয়।'

     

    কিন্তু বসতি তো ইতিমধ্যেই গড়ে উঠেছে, পাল্লা দিয়ে গড়ে উঠেছে ট্যুরিজম। কিন্তু ইয়াস এবং ভরা কোটাল দুইয়ের তাণ্ডবে এই দ্বীপগুলোর বর্তমান যা অবস্থা, তাতে সেখানকার স্থানীয়দের সরিয়ে নেওয়াই উচিত হবে আগামী দিনের বিপর্যয়ের হাত থেকে তাদের রক্ষা করার জন্য। কারণ বারবার তো ত্রাণ পৌঁছনো সম্ভব নয়। তাহলে এখন কি একমাত্র উপায় এদের ক্লাইমেট রিফিউজি হয়ে যাওয়া? এখানকার 18-45 বছরের মধ্যে পুরুষেরা ছমাসের জন্য বাইরে চলে যান পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে বিভিন্ন কাজের সন্ধানে। কারণ ঝড়ের পর যতক্ষণ না বাঁধ মেরামত করা হচ্ছে, ততক্ষণ জল নামে না। এবং নামলেও আগামী তিন বছর তা চাষের অনুপযোগী হয়ে থাকে মাটিতে মিশে যাওয়া নুনের জন্য। সমুদ্রের জল এখানে প্রবেশ করে মাটিকেও নোনা করে তোলে। ফলে এখানে যে চাষ হত তা আর সম্ভব হয় না। ফলে বিকল্প আয়ের সন্ধানে এঁরা তখন বাইরে যায়। ফলে টেম্পোরারি ক্লাইমেট রিফিউজি কিন্তু এখানে দেখাও যায়। আবার পার্মানেন্টও। অনেকেই টাকা জমিয়ে পাকাপাকি ভাবে ক্যানিং বা সোনারপুর অঞ্চলে চলে যান এই জীবন থেকে মুক্তি পেতে। সুতীর্থবাবুর মতে, এখানে এমন অনেক মানুষ আছেন যাঁরা তাঁদের জীবদশায় প্রায় 20-21 বার বাস্তুহারা হয়েছেন। ফলে ক্লাইমেট রিফিউজি ব্যাপারটা এখানে নতুন নাআলোচনায় এখন উঠে আসছে, এটাই তফাৎ। এর আগেও সাগরে পুনর্বাসন তৈরি করা হয়েছে।'

     

    সুন্দরবন বদ্বীপের মধ্যে ঘোড়ামারা দ্বীপের অবস্থান

     

    কিন্তু পুনর্বাসন দেওয়া হবে, ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল থেকে মানুষদের সরিয়ে নেওয়া হবে বললেই তো সরানো যায় না। সেক্ষেত্রে উপায় কী? ভবিষ্যতই বা কী? অধ্যাপক সৎপতি জানান, ‘ইনসিটু রিহ্যাবিলিটেশন করতে হবে, অর্থাৎ যাঁরা যে দ্বীপের বাসিন্দা তাঁদের সেখানেই কোথাও পুনর্বাসন দিতে হবে। কারণ পুনর্বাসন বললেই তো আর হল না, জমি কই তার জন্য? আর পুনর্বাসন মানেই সেই হয় কোয়ার্টার তৈরি করা বা বস্তি। তাদের কাজের কী হবে সেটাও মাথায় রাখা প্রয়োজন। আর সবসময় সরকারের মুখাপেক্ষী না হয়ে থেকে নিজেদের নিজের ব্যবস্থা করতে হবে। সবসময় বিকল্প একটা জীবিকা রাখা দরকার। এছাড়াও সেটলমেন্ট প্ল্যানিং প্রয়োজন ভীষণ ভাবে। শুধু রাস্তা আর বাঁধ নির্মাণ করলেই চলবে না। কোথায় কেমন বাড়ি হবে সেটাও পরিকল্পনা করতে হবে। দরকারে পিলার দিয়ে নিচে এক দেড় তলার মতো জায়গা ছেড়ে তার উপর বাড়ি বানাতে হবে, যাতে জল এলে বাড়ির ক্ষতি না হয়, বা সম্ভব হলে মাটি উঁচু করে তার উপর বাড়ি বানাতে হবে। আর মৌসুনি দ্বীপের মতো দ্বীপগুলোয় বসতি আর না গড়তে দিলেই ভাল হবে আগামী দিনে।' গবেষক বেদজ্ঞ একটু ভিন্ন মত পোষণ করেন এই ব্যাপারে। তিনি বলেন, ‘নদী বাঁধ নিয়ে আরও বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রয়োজন, কারণ কংক্রিটের বাঁধ যে সব জায়গায় কাজ করবে না তা ইতিমধ্যেই বোঝা গেছে। সুন্দরবনের ক্ষতিগ্রস্ত দ্বীপগুলোর বাসিন্দাদের মেনল্যান্ডে পুনর্বাসন দেওয়া সম্ভব না, ফলে এখানেই তাঁদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে পরিকল্পনামাফিক, যেখানে কেন্দ্রীয় স্তর থেকে তৃণমূলী স্তরে আলোচনা, পরিকল্পনা চাইপাশাপাশি এও দেখতে হবে যদি নতুন দ্বীপগুলোতে কোনও ভাবে বসতি স্থাপন করা যায়।'

     

    আরও পড়ুন:গঙ্গার ভাঙনে রাতারাতি ভিটেহারা বহু মানুষ

     

    ফলে নানান পরামর্শ, কৌশল এঁদের কথায় উঠে এল। এবং সেখান থেকে এটা অনেক বেশি স্পষ্ট হল ক্লাইমেট রিফিউজি এবং পুনর্বাসন এই দুটি কথা এখন চর্চায় থাকলেও সেটা পরিকল্পনা ছাড়া সম্ভব নয় এবং একইসঙ্গে সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। প্রায় দুশো বছর আগে যে ভুলটা শুরু হয়েছে তাকে বর্তমানে অত্যন্ত সুকৌশলে মোকাবিলা করতে হবে, সুন্দরবনের অধিবাসীদের অভিবাসী হতে হলে সেখানেই নিজেদের মাটিতেই হতে হবে, অন্যত্র সরে গিয়ে নয়, আর সেটা সম্ভবও নয়। ফলে গোটা বিষয়টার জন্য দরকার এক দারুন মাস্টার প্ল্যানের। নইলে ত্রাণ এবং বছর বছর ঠেকনা দেওয়ার মতো নদীবাঁধ মেরামত করলে পাকাপাকি কোনও সমাধান সম্ভব হবে না


    শুভস্মিতা কাঞ্জী - এর অন্যান্য লেখা


    জীবনের প্রতিপদে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েও সব বাধা জয় করে এগিয়ে চলেছেন অমৃতা ‘ন হন্যতে’ মুখার্জি।

    ডেভিড এবং তাঁর স্ত্রী মানুষ করে চলেছেন ২২০জন সন্তানকে, আগলে রেখেছেন ওদের সস্নেহে।

    কলোরাডো নদীর জল প্রতি 1 ডিগ্রি তাপমাত্রা বাড়লে 9.3 শতাংশ কমে যাচ্ছে।

    ব্যবসা বাদ দিয়ে সিনেমা হয় না বলেই উত্তম সূচিত্রার স্মৃতিবিজড়িত সিঙ্গেল স্ক্রিন সিনেমা হলগুলো

    বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে গলে যাচ্ছে কুমেরুর বরফ, বাড়ছে জলস্তর। তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর

    সবাই গঙ্গার এই ভাঙন খেলা থামার আশায় পথ চেয়ে আছে।

    সুন্দরবনের ‘ক্লাইমেট রিফিউজি’ -4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested