×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • অমৃতার ‘ন হন্যতে’ হয়ে ওঠা

    শুভস্মিতা কাঞ্জী | 23-06-2021

    অমৃতা তার সন্তানের সঙ্গে

    হারতে হারতে যখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখনই মানুষ ঘুরে দাঁড়ায়, কারণ তখন তো তার আর হারানোর কিছু থাকে না, বরং চেষ্টা করলে পাওয়ার অনেক কিছুই থাকে। এই ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই যিনি লড়তে পারেন, তিনিই তো সাধারণের মধ্যে থেকেও অ-সাধারণ। আর পাঁচ জনের কাছে অনুসরণযোগ্য দৃষ্টান্ত। তিনিই তো ভগবৎ গীতার অবিনশ্বর আত্মার ধারণার মতো এমন কৃতির অধিকারী, যা ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে– শরীর ধ্বংস হওয়ার পরেও ধ্বংস হয় না। তিনি নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে নামের পাশে ন হন্যতে লিখতেই পারেন। যেমন লিখেছেন অমৃতা মুখার্জি। 

     

    অমৃতা মুখার্জি একজন শিক্ষিকা, একজন সমাজসেবিকা, একজন স্পেশাল চাইল্ডের মা, একজন অভিনেত্রী।

     

    জাগরীর সদস্যরা

     

    মা, বাবা, কাকু, কাকিমা, বোন এবং সন্তানকে নিয়ে অমৃতা উত্তর চব্বিশ পরগণার গোবরডাঙায় থাকেন। বাংলায় এমএ, বিএড করে প্রথমে নিউটাউনের একটি নাম করা বেসরকারি স্কুল এবং বর্তমানে একটি সরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপ থেকে শিক্ষা নিয়ে এক এক পা করে এগিয়েই আজ অমৃতা এই জায়গায় পৌঁছেছেন 

     

    অমৃতার সন্তান স্পেশাল চাইল্ড বলে বাবা তার দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেছিলেন। মা হয়ে অমৃতা তো তা করতে পারেন না। কিন্তু মায়েরও যে পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই একজন স্পেশাল চাইল্ডকে কী করে মানুষ করতে হয় সেই বিষয়ে। কিন্তু হাল তো ছাড়লে চলবে না। তবে? অমৃতা জানান, “বুরুন হওয়ার পর বুঝতেই পারতাম না ওর কী হয়েছে? কী ব্যাপার? কী করব? এদিকে ওকে নিয়ে বাধ্য হয়ে বাবার কাছে ফিরে আসতে হল। কিন্তু গোবরডাঙায় স্পেশাল চাইল্ডদের জন্য তো কোনও ইনস্টিটিউট বা থেরাপির জায়গা নেই। তখন খানিকটা স্বার্থপর হয়েই বুরুনের জন্য 2015 সালে জাগরী শুরু করি, যাতে ওর সঙ্গে ওর মতো আরও কয়েকজন বাচ্চা পড়তে পারে।''

     

    অমৃতার সন্তান, বুরুন

     

    জাগরীতে আজ বুরুন সহ আরও একাধিক বাচ্চা আছে, যারা অমৃতার হাত ধরে শিক্ষার আলোয় শিক্ষিত হচ্ছে। অমৃতা যেহেতু স্পেশাল এডুকেটর নন, তাই এই বাচ্চাগুলোর পুঁথিগত শিক্ষাটা উনি দেখেন না, তার জন্য 7-8জন শিক্ষক শিক্ষিকা আছেন, যাঁরা জাগরীর অ্যাকাডেমিক হেড সুজাতা ঘোষের তত্ত্বাবধানে এই বিশেষভাবে সক্ষম পড়ুয়াদের পড়ান। অমৃতা ওদের নিয়ে খানিক গবেষণা করতেই ভালবাসেন। দেখেন যাদের সমাজ খাটো চোখে দেখে তাদের দিয়ে নাটক করানো যায় কিনা? গানটা হয় কিনা? আর এসব এক্সপেরিমেন্টের ফলেই গত দুবছর ধরে কলকাতা এবং উত্তর চব্বিশ পরগণার বহু মানুষ জাগরীর বাচ্চাদের বানানো প্রদীপ, মাস্ক ইত্যাদি পেয়ে চলেছেন। পড়াশোনা ছাড়া আর কী হয় জাগরীতে? অমৃতা মুখার্জি জানান, ‘সব বাচ্চা সব কিছু করতে পারে না। কিন্তু তাই বলে আমরা থেরাপি বন্ধ করি না। লকডাউনের জন্য আবৃত্তি থেরাপি হল না। তবে মিউজিক থেরাপি চলেই, এবং এতে দারুন ফল পাওয়া যায়। এছাড়া ওরা যেহেতু টাকার বিষয়টা খুব বেশি ভাল বুঝতে পারে না, তাই মক মার্কেট বানিয়ে ওদের টাকার হিসেবনিকেশ শেখানো হয়। মা বাবাদের জন্য মোটিভেশনাল থেরাপির ব্যবস্থা করা হয়। আসলে এটা একটা প্রচেষ্টা, যাতে সবাই মিলে একসঙ্গে ভাল থাকা যায়।'

     

    আরও পড়ুন: ভোটের হিসেব না কষে মানুষের পাশে রেড ভলেন্টিয়ার্স

     

    অমৃতা গর্বের সঙ্গে জানান, বুরুনের মা অমৃতা– এইভাবেই পরিচিত হতে চান তিনিকারণ, ওর জন্যই আমার এত বদল। ও স্পেশাল চাইল্ড না হলে হয়তো আমার জীবন অন্য রকম হতো। বাকি পাঁচজনের মতো সিনেমা, গল্পের বই, শপিং নিয়ে ভাবতাম। মানুষকে সাহায্য করতাম। কিন্তু এত ভেবে এভাবে জড়িয়ে পড়ে না। যদিও আমার মানুষের পাশে দাঁড়ানোর স্বভাবের জন্য আমি চরিত্রহীন, এই কথাও শুনতে হয়েছে! অবাক হলেন অমৃতার এই কথা শুনে? আসলে সমাজের ছবিটা আমাদের খানিক এরকমইঅমৃতা বাল্যবিবাহ আটকানোর জন্য ছুটে যান, তাঁর পরিচিত বা অপরিচিত কেউ অর্থাভাবে পড়লে, পাশে দাঁড়াতে চান বলে তার সহকর্মীরা তাঁকে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করত। কটূক্তি করত। অমৃতা তাই বলেন, “আজ সেসব তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণেই সব ছেড়ে নিজের সবটুকু জাগরীতে উজাড় করে দিচ্ছি। আজকাল আর আগের মতো কারও বিপদে আপদে ঝাঁপিয়ে পড়ি না। কিন্তু মুমূর্ষ রোগী দেখলে কি মুখ ঘুরিয়ে থাকতে পারব? তবে আমার পুরনো স্কুল আমায় ফর্মালিটি কাকে বলে শিখিয়েছে। স্পেশাল চাইল্ডের মা বলে সবসময় সহানুভূতির চোখে দেখেছে, অপমান করেছে। সব সময় ভয়ে থাকতাম কী বলব আর কী বলব না ভেবে। তখন খারাপ লাগলেও আজ অনুভব করি সেগুলোও আমার জন্য শিক্ষা ছিল। সেসব ঘটনা, অপমানগুলো আমাকে শক্ত করেছে। সহকর্মীদের অনেককে দেখে মনে হত, ওরা পারলে আমি নয় কেন? দুর্বল হলে হবে না। এগোতেই হবে।'' কিন্তু সবসময় কি নিজেকে বুঝিয়ে ওঠা যায়? মন খারাপ, বিষাদ কি কখনওই গ্রাস করে না? দৈনন্দিন জীবনে লড়াই করতে করতে কখনই কি ক্লান্তি আসে না? তখন? “গান আছে, কবিতা আছে। গান কবিতা আমায় ভাল রাখে। লোকজন ধরেই নিয়েছে অমৃতা খুব শক্ত, ওর দুঃখ কষ্ট থাকতে পারে না, কান্না থাকতে পারে না। তাই নিজের মতোই থাকি। আর লড়াইয়ে সবসময় পাশে পরিবার, জাগরীর সবাইকে, বন্ধু বান্ধবদের পাশে পাই বলে উতরে যাই।''

     

    আরও পড়ুন: সার্থকনামা পথিকৃৎ ডেলিভারি করেন স্বপ্ন

     

    আর সবের মাঝে অভিনয় কী করে এল? অমৃতা হেসে বলেন, “ছোট থেকেই নাচ নাটক শিখেছি। তবে টেলিভিশনে সুযোগটা হঠাৎই এল। সাহানা দত্তের হাত ধরেই গত বছর এক বিখ্যাত বাংলা সিরিয়ালে কাজ করার সুযোগ আসে।'' সবটা সামলানো যায় একা হাতে? অমৃতা সহাস্যে উত্তর দিলেন, “যায়। চেষ্টা করলে কী না পারা যায়। সবটাই ম্যানেজ হয়ে যায়।'' আর আগামীদিনের জন্য কী স্বপ্ন তাঁর? “সবটা ঘেঁটে গেছে। আমি যেখানে শুরু করেছিলাম আবার সেখানে এসে দাঁড়িয়েছি। অনলাইনে ওদের ক্লাস ঠিকঠাক হচ্ছে না। অনেক বাচ্চাই ক্লাস করছে না। অনেকে মাইনে অবধি দিচ্ছে না। ফলে আমায় খুব সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। লকডাউন না উঠলে, ক্লাস স্টার্ট না হলে জাগরী শেষ হয়ে যাবে। তবে অদূর ভবিষ্যতে ইচ্ছে আছে একটা বাড়ি বানানোর। এই বাচ্চাদের বাবা মা না থাকলে তাদের কী হবে? কে দেখবে ওদের? সেই জন্য ওদের একটা থাকার জায়গা বানাতে চাই। কিন্তু সবার আগে প্যান্ডেমিকটাকে যেতে হবে।''

     

    জাগরীর বাচ্চাদের বানানো জিনিস

     

    কী ভীষণ অদম্য জেদ মানুষটার মনে, তা তাঁর প্রতিটা কথায় ধরা পড়ছিল। যেন হার মানলে চলবে না। নিজের পরিকল্পনা, কী করতে হবে, না হবে সেই বিষয়ে অত্যন্ত স্বচ্ছ ধারণা পোষণ করেন, এবং একইসঙ্গে তিনি যে তাঁর কাজের প্রতি কতটা দায়বদ্ধ তাও বোঝা যায়। জীবনের মূল মন্ত্র কী জানতে চাইলে অমৃতা নিজ মুখেও শেষে বলেন তিনি একটি বাক্যে ভীষণ বিশ্বাসী, ‘ভাল মন্দ যাহাই আসুক সত্যরে লও সহজে।' আর তাই সাধারণ হয়েও অসাধারণ হয়ে ওঠা এই নারী নিজের ফেসবুকে নামের পাশে ন হন্যতে লিখে রাখেন। অর্থাৎ যেন বারবার নিজেকে মনে করিয়ে দেওয়াতোমায় থামলে চলবে না অমৃতা 


    শুভস্মিতা কাঞ্জী - এর অন্যান্য লেখা


    নগেন্দ্র প্রসাদের জীবনীর হাত ধরে দর্শক আবার হলমুখী।

    জয় শ্রীরাম বনাম জয় বাংলা ধর্মীয় সত্তার রাজনীতি বনাম ভাষা সত্তার রাজনীতি

    বছরের পর বছর বরফে জমে থাকা পর্বতারোহীদের মৃতদেহ বিশ্ব উষ্ণায়ন ফলে প্রকাশ্যে আসছে।

    দূরত্ব বিধি মানা উঠে গেলেও কলকাতার অটোরিকশায় ভাড়া আর কমল না।

    নতুন প্রকাশিত ছবি ‘অল্প হলেও সত্যি’ কতটা দাগ কাটল দর্শকদের মনে?

    বর্ষশেষের আগের রাতে রূপম ইসলাম তাঁর ভক্তদের উপহার দিয়ে গেলেন এক অনন্য সঙ্গীতময় সন্ধ্যা।

    অমৃতার ‘ন হন্যতে’ হয়ে ওঠা-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested