ধরুন আজ আপনার বাড়ি, দু’ ফসলা ক্ষেতের জমি সমস্ত আছে। আর কাল হঠাৎ নেই হয়ে গেল, তখন? না, মানুষ কেড়ে নেয়নি। নিয়েছে প্রকৃতি। যদিও নেপথ্যে মানুষেরই হাত রয়েছে কোথাও। তবে? শিউরে উঠলেন তো! হ্যাঁ এমনই অবস্থা এখন মুর্শিদাবাদের সামসেরগঞ্জের তিনটি গ্রামের। সেখানকার অধিকাংশ জমিই এখন গঙ্গার গর্ভে তলিয়ে গিয়েছে, চিহ্নটুকুমাত্রও নেই আর।
এমনিই বর্ষাকালে গঙ্গা তার পূর্ণ যৌবন ফিরে পায়, দু’কূল ছাপিয়ে যায় জলরাশি। শক্তি তখন প্রায় অদমনীয় থাকে। আর সেই শক্তি দিয়েই সে একের পর এক পাড় ভেঙে চলে, বাড়িয়ে চলে তার দৈর্ঘ্য। তার সঙ্গে যদি যোগ হয় অতিরিক্ত জলরাশি তবে তার ফলটা বোধহয় খানিকটা হলেও অনুমেয়। ফারাক্কা থেকে বর্ষাকালে জল ছাড়া হয় বাঁধ বাঁচানোর উদ্দেশ্যে, আর নদী তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শক্তি বাড়ায়। বেড়ে যায় ক্ষয় ক্ষমতা। তার ফল আমরা দেখতে পাচ্ছি মুর্শিদাবাদের সামসেরগঞ্জে। ধুসরি, ধানগড়া সহ আরও একটি গ্রামের অধিকাংশই তলিয়ে গিয়েছে নদী বক্ষে। বহু মানুষ ঘর ছাড়া।বর্তমানে সম্বল বলতে হয়তো সামান্য ঘটি বাটি, বা জরুরি কাগজ সহ অল্প কিছু অর্থ। তারা সবাই আশ্রয় নিয়েছে কাছের স্কুলবাড়িগুলোয়। কিন্তু নিজের জায়গা, নিজের বাড়ি বলতে আর কিছুই রইল না তাদের। শুধুই কি বাড়ি ঘর? পাকা প্রধান সড়কও আজ জলের তলায়। পার্থ সারথি দত্ত, মুর্শিদাবাদের স্থানীয় বাসিন্দা, যিনি তাঁর সংস্থার সঙ্গে এই সমস্ত অঞ্চলে ত্রাণ নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি 4thPillars-কে জানান, "তিনটি গ্রামের বেশিভাগটাই এখন নদীর তলায়। স্থানীয়রা নিকটবর্তী তিনটি স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন, কেউ কেউ তাঁদের আত্মীয়ের বাড়ি চলে গেছেন, কেউ বা পাড়েই ত্রিপল টাঙিয়ে দিনযাপন করছেন কোনও মতে। নদীর ধারে তিন চার তলা বাড়ি, ফলে ভাঙন তো হবেই। কী করে অনুমতি পায় জানি না। খুব একটা সাহায্য পাচ্ছে না ওঁরা প্রশাসনের তরফ থেকে।তবে ক্লাব এবং বিভিন্ন সেচ্ছাসেবক সংস্থা নিজেদের মতো করে সাহায্য করার চেষ্টা করছে।’
কিন্তু এই ভাঙন এমন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে কেন? গঙ্গা তো প্রায় তার জন্ম লগ্ন থেকেই কোথাও না কোথাও পাড় ভেঙেছে, আবার কোথাও গড়েছে। তাহলে এখন কেন এটা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে? ফারাক্কা ব্যারেজ তৈরি হওয়ার পর গঙ্গা তার স্বাভাবিক গতি হারায়, এবং বর্ষায় ব্যারেজ থেকে অতিরিক্ত জল ছাড়লে নদীর ক্ষমতা আরও বেড়ে যায়, তখন দ্রুততার সঙ্গে সে পাড় ভাঙতে থাকে। প্লাবিত হতে থাকে গ্রামের পর গ্রাম। ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন সর্বত্র দেখতে পাওয়া যায়, বাস্তুহারা হয় বহু মানুষ। বিশ্বভারতীর ভূগোল বিভাগের প্রাক্তন প্রধান অধ্যাপক গুরুপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় সদ্য সেই সমস্ত জায়গা ঘুরে এসে জানান, "নদী তো নড়া চড়া করে, সে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় সরে যায়, এবং তার ফলে এক পাড় ভাঙে, এক পাড় গড়ে। এখন এদিকটা ভাঙছে। অবস্থা ভয়াবহ হয়ে আছে। নদী পাড় ভাঙতে ভাঙতে কাঁটাতারের কাছে চলে এসেছে। কিন্তু হ্যাঁ একটা কোথাও আশার আলো রয়েছে, কারণ নদীর যে পাড় ভাঙে সেই পাড় ক্রমশ অগভীর হয়ে আসে। চড়া পড়ে যায়। তখন নদী আর কয়েক বছর পর সেখানে আর পাড় ভাঙতে পারে না। অন্য জায়গায় সে তার ভাঙন প্রক্রিয়া শুরু করে তখন।‘
গবেষক নীলাঞ্জনা ঘোষাল জানান, "নদীর ভাঙন সেই অর্থে এখানে রোখা যাবে না, হয় এই জায়গায় বা তার আগে অথবা পরে কোথাও, নিকটবর্তী অঞ্চলে ভাঙন কাজ চলবেই। তার কারণ জায়গাটি গঙ্গার মিয়েন্ডারিং কোর্সে রয়েছে। ফলে ভাঙন হবেই। কিন্তু তার হার বেড়েছে ফারাক্কার জন্য। তাছাড়া এই জায়গার উল্টো পাড় গঙ্গা ভাঙতে পারবে না কারণ সেখানে রাজমহল পাহাড় আছে, অর্থাৎ শক্ত শীলা যা সহজে ক্ষয় হয় না, আর এ পাড়ে নরম শীলা যা সহজেই ক্ষয়ে যায়। নদীকে তো আটকানো সম্ভব নয়, কিন্তু যেটা করা যেতে পারে, যে জায়গায় নদী খেলা করে, অর্থাৎ তার ‘প্লে ফিল্ড' সেখানে জনবসতি না গড়ে তোলাই শ্রেয়। অথচ যেহেতু জায়গাটা উর্বর তাই ওখানেই বেশি সংখ্যক মানুষ বাস করেন, চাষাবাদ ভাল হয় বলে। কিন্তু এটা আখেরে তাদের ক্ষতিই করছে।’
কিন্তু এর থেকে কি মুক্তির উপায় নেই? ওই অঞ্চলে বাস করা উচিত নয় বটে, কিন্তু হঠাৎ করেই তো সব ছেড়ে আসা সম্ভব নয়। তাহলে উপায় কী? গুরুপ্রসাদবাবু জানান, "এক্ষেত্রে একমাত্র প্রশাসনই সাহায্য করতে পারবে। আমি ক’দিন আগে দেখে এলাম নদীর পাড়ে বালির বস্তা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তাতেও লাভ হচ্ছে না, নদী সেটাও ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। একমাত্র পাথর দিয়ে বাঁধাই করলেই খানিকটা সুরাহা হবে বলে মনে হয়।’ প্রায় একই কথা জানান নীলাঞ্জনা ঘোষালও। তিনি জানান, "নদীর পাড় ভাঙা খানিকটা আটকানো যেতে পারে নদীর পাড় বাঁধিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। তার সঙ্গে যে জায়গায় নদীর পাড় ভাঙছে সেখানে বেশি করে গাছ লাগাতে হবে, কারণ গাছের শিকড় মাটিকে ধরে রাখে। এছাড়া নদী গর্ভ থেকে মাটি, বালি, পাথর, প্রভৃতি তোলা বন্ধ করতে হবে। নজর রাখতে হবে যেন নদীর পাড়েই কোনওরকম বেআইনি নির্মাণ না হয়, তাতে মাটি তার ভার রাখতে পারে না।’
সমস্যা থেকে উদ্ধার কীভাবে, কোন পথে মিলবে জানা নেই। কিন্তু সামসেরগঞ্জের তিনটি গ্রামের মানুষ যে অসহায়তা, দুশ্চিন্তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আগামী দিনে তাদের জন্য কী অপেক্ষারত তাই বা কে জানে! আপাতত তারা সবাই গুরুপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের কথা মতো গঙ্গার এই ভাঙন খেলা থামার আশায় পথ চেয়ে আছে।
(ছবিগুলো পার্থ সারথি দত্তের তোলা)
জীবনের প্রতিপদে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েও সব বাধা জয় করে এগিয়ে চলেছেন অমৃতা ‘ন হন্যতে’ মুখার্জি।
নাছোড় বৃষ্টিতে নাজেহাল ভারতবাসী।
কেন ওর বাবার মৃত্যুর পরও মিথ্যা খবর দিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ? কেন এতদিন দেরি করল ওরা বাবার শেষকৃত্য কর
মহাকাশ গবেষণায় যেন এক নতুন দিগন্ত খুলে দিল নাসার এই নতুন আবিষ্কার।
শ্রীলঙ্কার অশান্তি খারাপ শাসনের একটি পাঠ এবং একটি বিপজ্জনক নজির
আমাদের বদলের নেপথ্যে থাকে আমাদের চারপাশের মানুষ এবং পরিস্থিতি সেই কথাই মনে করাল এই ছবি।