দশকের পর দশক ধরে রাজত্ব করার পর নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর আসনটি এবার বোধহয় টলে গেল! স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সুভাষচন্দ্র বসুর অবদানে কোনও পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে আম বাঙালির চর্চায় নেতাজি প্রসঙ্গের যে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল, তা ইদানিং আর দেখা যাচ্ছে না। বরং জনপরিসরে এখন ওই সময়ের সবচেয়ে বেশি আলোচিত চরিত্র শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। প্রায় বিস্মৃতির অন্তরাল থেকে শ্যামাপ্রসাদের উত্থানের পিছনে রয়েছে অবশ্যই সমকালীন রাজনীতি। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে বঙ্গভূমিতে জমি পেতে হলে অবশ্যই শ্যামাপ্রসাদের প্রয়োজন রয়েছে।
অনেকেই এখন দাবি করেন, শ্যামাপ্রসাদের জন্যই নাকি আজকের পশ্চিমবঙ্গ পাকিস্তানে যায়নি। আর এক ধাপ এগিয়ে কেউ কেউ আবার বলেন, শ্যামাপ্রসাদই স্বাধীন বাংলার স্থপতি। এদের বিপক্ষে অবশ্য কেউ কেউ শ্যামাপ্রসাদকে সরাসরি ব্রিটিশের ‘দাস' এবং দেশের স্বাধীনতার ‘শত্রু' বলে অভিহিত করেন। কিন্তু সত্যিই কি শ্যামাপ্রসাদ পশ্চিম বাংলাকে এদেশের সঙ্গে জুড়েছিলেন? ইতিহাস কি সেই কথাই বলে? ভারতে শ্যামাপ্রসাদের রাজনৈতিক জীবনের দিকে যদি ফিরে তাকানো যায়, তবে দেখা যাবে, বিবিধ পরস্পর বিরোধী অবস্থান নিয়ে তিনি তাঁর সময়েই এক বিতর্কিত চরিত্র হয়ে উঠেছিলেন। 1929 খ্রিষ্টাব্দে কংগ্রেসের টিকিটে রাজ্য আইনসভায় গেলেন। 1937 সালে নির্দল প্রার্থী হিসাবে দাঁড়িয়ে জিতলেন এবং রাজ্য আইনসভার বিরোধী দলনেতার আসনে বসলেন। তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী (এখনকার মুখ্যমন্ত্রীর সমতুল্য) এ.কে. ফজলুল হক, শাসনক্ষমতায় তাঁর দল কৃষক প্রজা পার্টি (KPP)। 1939 সালে এই শ্যামাপ্রসাদই আবার সারা ভারত হিন্দু মহাসভায় যোগ দিলেন। সাভারকরের পর 1943 সালে তিনি এই দলেরই সর্বভারতীয় সভাপতি হলেন। তখন দেশজুড়ে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম উত্তুঙ্গ পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রাদেশিক মন্ত্রীসভাগুলো থেকে কংগ্রেসের মন্ত্রীরা পদত্যাগ করায় মহম্মদ আলি জিন্না মুসলিম লিগের সদস্যদের ‘নিষ্কৃতি দিবস’ পালনের ডাক দিচ্ছেন। 1946-এর ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’-এর আগেই কলকাতার রাস্তায় ইতিউতি দাঙ্গা, হিন্দু-মুসলিম চাপা অসন্তোষ, বিক্ষোভ। শ্যামাপ্রসাদ বুঝলেন, এই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। বাংলার হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে নিজের অনুকূলে আনতে তিনি পুঁজি করলেন সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকেই।
অবশ্য সম্প্রদায়ভিত্তিক রাজনীতিকে ব্রিটিশ প্রশাসনের তরফেও জল-হাওয়া দেওয়া হয়েছিল। যার শুরুটা হয়েছিল 1932 সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র্যামসে ম্যাকডোনাল্ডস-এর সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতির মাধ্যমে। এই নীতিতে হিন্দু এবং সংখ্যালঘু দলিত ও মুসলমানদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অবিভক্ত বাংলায় এতকাল হিন্দু জনপ্রতিনিধিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন, কিন্তু 1932-এর পর মুসলমান জনপ্রতিনিধিদের সংখ্যা বেড়ে গেল। অন্যদিকে গান্ধী অবিসংবাদী দলিত নেতা আম্বেদকরকে প্রস্তাব দিলেন, হিন্দুদের ভাগের কিছু আসন নিয়ে যৌথভাবে ভোটে লড়তে। আম্বেদকর গান্ধীর এই প্রস্তাবে সম্মত হয়েছিলেন। কিন্তু এই সিদ্ধান্তে গোঁসা হল শ্যামাপ্রসাদের। ঘনিষ্ঠমহলে বললেন, উচ্চবর্ণের হিন্দুদের স্বার্থের দিকটা মাথায় না রেখেই কংগ্রেস যেভাবে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সঙ্গে বোঝাপড়া করল, তাতে নাকি তিনি কংগ্রেসের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়েছেন। হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা পেতে চাওয়া শ্যামাপ্রসাদ এরপর মুসলিম লিগ-ফজলুল হক সরকারেরও শরিক হলেন। পেলেন অর্থমন্ত্রক। ইতিহাস বলে, অর্থমন্ত্রী হিসাবে তাঁর অমর দুই ‘কীর্তি' হল 1943-এর মন্বন্তরে ব্যাপক হারে ত্রাণের চাল চুরি এবং বিদ্রোহী তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারকে ভাতে মারার জন্য অবিভক্ত মেদিনীপুরের যাবতীয় রাস্তা কেটে দেওয়া— যাতে সেখানে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছতে না পারে। ‘হিন্দু’ সংবাদপত্রের তৎকালীন সাংবাদিক টিজি. নারায়ণ এবং প্রখ্যাত চিত্রকর, সাংবাদিক চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্যের লেখনী থেকে জানা যায়, কীভাবে শ্যামাপ্রসাদের ঘনিষ্ঠ মানুষরা, এমনকি তাঁর দল হিন্দু মহাসভার সদস্যরাও নির্বিচারে ত্রাণ সামগ্রী লুঠ করেছেন।
রাজনীতির মাঠে এরপরেও সফল হতে না পারা শ্যামাপ্রসাদ 1951 সালে একটু অন্যভাবে নিজের ভাগ্যান্বেষণ করার চেষ্টা করলেন। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রত্যক্ষ সমর্থনে তিনি তৈরি করলেন নতুন দল, ভারতীয় জনসংঘ। জনসংঘের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হল দিল্লিতে। মঞ্চে শ্যামাপ্রসাদ ও কিছু সাধুসন্ত, মঞ্চের পিছনের দেওয়ালে শিবাজী, রানাপ্রতাপ, কৃষ্ণ প্রমুখ ‘হিন্দুবীরেরা'। তলায় দেবনাগরী হরফে বড় বড় করে লেখা ‘কলিতে শক্ত সংঘ' (কলি যুগে সঙ্ঘই শক্তি)। এখন প্রশ্ন হল, শ্যামাপ্রসাদ রাজনৈতিক জীবনে এতবার বাঁক নিলেন কেন আর প্রতিটি বাঁকেই তিনি ব্যর্থ হলেন কেন? ঐতিহাসিক জয়া চ্যাটার্জি তাঁর "বেঙ্গল ডিভাইডেড: হিন্দু রিভাইভিলিজম অ্যান্ড পার্টিশন’ গ্রন্থে দেখাচ্ছেন, শ্যামাপ্রসাদের লক্ষ্য ছিল বাংলার উচ্চবর্ণের হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক, আর কিছু মাড়ওয়ারি পুঁজিপতির সমর্থন। তিনি জানতেন, বাংলার নব্য ‘ভদ্রলোক' শ্রেণী নিজেদের অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক আধিপত্য অক্ষুণ্ণ রাখতে সর্বান্তকরণে বাংলা ভাগ চায়। তাই শরৎ বসু, কিরণ শঙ্কর রায়ের মতো কংগ্রেস নেতারা স্বাধীন এবং অবিভক্ত বাংলার (পোশাকি নাম বেঙ্গল প্যাক্ট) জন্য সওয়াল করলেও, শ্যামাপ্রসাদ 1943 সাল থেকেই বাংলা ভাগের জন্য সওয়াল করতে থাকলেন। এই মেরুকরণের রাজনীতিতেও অবশ্য বিশেষ কল্কে মিলল না। বাংলার ভোটে পেলেন সাকুল্যে 4 শতাংশভোট।
1942 সালের 26 জুলাই বাংলার গভর্নর লুই মাউন্টব্যাটনকে চিঠি লিখলেন তিনি। বললেন, "ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যে কোনও ব্রিটিশ বিরোধী হিংসা, অনাচারের বিরুদ্ধে তিনি প্রশাসনের পাশে থাকবেন।’ পরে অবশ্য সাফাই দিলেন, ভারত ছাড়ো আন্দোলন সংগঠিত করার জন্য কংগ্রেসের অবস্থানের সঙ্গে তিনি একমত নন। কিন্তু 1942-এ গান্ধী সহ কংগ্রেসের সব শীর্ষস্থানীয় নেতা যখন জেলবন্দি, তখন তাঁদের নামেই আন্দোলন চলছে সারা দেশে। সমগ্র আন্দোলনকে পরিচালনা করছেন সাধারণ মানুষ, যারা কোনওদিন পথে নেমে কংগ্রেসের পতাকাটাও ধরেননি। বাংলায় যেমন এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন সতীশচন্দ্র সামন্ত, সুশীল ধাড়া, অজয় মুখার্জি-রা (পরবর্তীকালে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী)।
মুশকিল হল, এইরকম বর্ণময় চরিত্রের শ্যামাপ্রসাদ সম্পর্কে যেসব স্বঘোষিত ‘প্রগতিশীল' বলেন, ইতিহাস থেকে তাঁর নামটাই ভুলিয়ে দেওয়া উচিত, তারা বোধহয় একটু ভুল করে ফেলেন। ইতিহাসের কোনও অধ্যায়কে খেয়ালখুশি মতো ভুলিয়ে দেওয়া যায় না। স্মরণে রাখতে হবে, শ্যামাপ্রসাদের চরম রাজনৈতিক বিরোধী জহরলাল নেহরু শ্যামাপ্রসাদের যাবতীয় কার্যকলাপ সম্বন্ধে অবহিত হয়েও তাঁকে অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রীসভায় বাণিজ্য ও সরবরাহ মন্ত্রকের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কেননা, গান্ধী নেহরুকে একটা বিষয় স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, "স্বাধীনতা দেশ পেয়েছে, কংগ্রেস নয়।’
মনস্তত্ত্ব বলে, যে জিনিসকে যত বেশি আড়াল করে রাখা হয়, সহজাতভাবেই সেই জিনিসের প্রতি আকর্ষণ ততই তীব্র হয়। তাই কোনও কিছুকে রেখে ঢেকে নয়, খোলাখুলি আলোচনা এবং বস্তুনিষ্ঠ চর্চাতেই কোনও ব্যক্তি বা সময়ের প্রকৃত স্বরূপটা উঠে আসতে পারে। ‘শ্যামাপ্রসাদের জন্য বাংলা স্বাধীন হয়েছে' কিংবা ‘শ্যামাপ্রসাদই বাংলার জনক'-এর মতো যে মিথ্যা, অনৈতিহাসিক বক্তব্যগুলো একটা মহল থেকে ক্রমাগত ছড়ানো হচ্ছে এবং একশ্রেণীর মানুষ সেগুলো অন্ধভাবে বিশ্বাস করছেন, তা সবই ওই রাখা-ঢাকা আলোচনার কুফল। শ্যামাপ্রসাদকে আড়াল করলেও তিনি যে রাজনীতির জন্ম এদেশে শুরু করে গেছেন, সেই রাজনীতিই কিন্তু এখন এই দেশকে চালাচ্ছে। শ্যামাপ্রসাদ, তাঁর ভাবাদর্শ ও রাজনৈতিক উত্তরাধিকার এ দেশের বহুত্ববাদের পক্ষে বিপজ্জনক, সন্দেহ নেই। তাই বিশেষ কোনও ব্যক্তিকে গৌরবান্বিত করে বা মুছে ফেলে নয়— সামগ্রিকভাবে এই হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার উত্থানের ইতিবৃত্ত নিয়ে চর্চা হওয়া উচিত। সেই চর্চায় হয়তো শ্যামাপ্রসাদ আসবেন, তবে নির্দয় ইতিহাস তাঁরও সম্যক বিচার করবে। ইদানীং করোনাকালে আমরা একটি জনপ্রিয় কথা প্রায়ই শুনছি, ‘আমাদের রোগের সঙ্গে লড়তে হবে, রোগীর সঙ্গে নয়।' তেমনই শ্যামাপ্রসাদ যদি ‘সাম্প্রদায়িকতা' নামক রোগে আক্রান্ত হন, তবে সেই রোগটার উৎসকে আগে খুঁজে বার করতে হবে এবং নির্মূল করতে হবে। একজন শ্যামাপ্রসাদকে ভুলিয়ে দিয়ে যেটা করা সম্ভব নয়।
এ দেশে যারা এখনও হিন্দু-মুসলিম মিলনের কথা বলে তারাই সিকিউলার। এটা সেক্যুলারের অপভ্রংশ রূপ।
অহোম জাতীয়তাবাদে ভর করে আজ হিমন্তরা উচ্চপদে, আর কত মানুষ অসমের অ-সম রাজনীতির বলি হবে?
পাজি, কাঠিবাজ মিডল ক্লাসকে জব্দ করা মার্ক্সের কম্মো নয়, এই কাজটাও একমাত্র মোদীজিই পারেন!
দলের বাইরে বহু চালচোর ছিলই, ভোটের পর দেখা গেল দলের ভিতরেও বহু চালচোর আছে!
মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পরেও আফগানিস্তানের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রাখতেই হবে ভারতকে
শিল্পীর শিল্পে সমকাল ধরা পড়লে, শাসক সর্বদাই ভয়ে থাকে।