পাশে বসা সহপাঠীকে দেখিয়ে জনৈক ছাত্র বলে উঠল, "দেখুন স্যার, ও আমায় কী বাজে একটা গাল দিল। প্রবীণ পশুপতিবাবু লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে এসে বললেন, ‘অ্যাই ওকে তুই কী বলেছিস বলে ফেল শিগগির।' ছেলেটি অনেক কষ্টে, আমতা আমতা করে বলল, ‘আজ্ঞে আমি তো ওকে সেক্যুলার বলে ডেকেছি।' পশুপতিবাবু আধ হাত জিভ বার করে, চোখ বুঝে মুখে দু'বার রাম রাম উচ্চারণ করলেন। তারপর বললেন, ‘এসব অশ্লীল কথা কোথায় শিখলে খোকা?’ ছেলেটি শান্ত এবং স্বাভাবিক স্বরে জবাব দিল, ‘কেন আমাদের পাঠ্যবইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায়, যেখানে সংবিধানের প্রস্তাবনা লেখা আছে সেখানেই তো দেখলুম! সেখানে লেখা আছে, আমরা ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম...।' তিষ্ঠ তিষ্ঠ বলে তাকে থামালেন পশুপতিনাথ। একটু স্বাভাবিক হয়ে বললেন, ‘ওসব লেখা কেউ পড়ে খোকা?’ তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে গোটা ক্লাসের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘অ্যাই, সবাই শোনো ওই পাতাটা সবাই ছিঁড়ে ফেল, যতসব ইউজলেজ জিনিসপত্তর ঢুকিয়ে বাচ্চাদের মাথা খাওয়া হয়েছে এতকাল।' উল্টোদিকের ছেলেটি তবু নাচার। "...কিন্তু বাবা যে বললেন, ওই পাতাতেই আমাদের সংবিধানের সারকথা গুলো বলা আছে?'
পশুপতিবাবুর তিনকুড়ির কাছাকাছি বয়স। এতকাল তিনিও জানতেন ওই প্রস্তাবনার অংশটুকুই দেশের সংবিধানের আত্মা। কিন্তু সেদিন স্কুলের কিছু ছেলেমেয়েকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে গিয়ে তার যা অভিজ্ঞতা হল! কৌতূহলী ছাত্র চিড়িয়াখানার বাঘ বাবাজিকে দেখে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘স্যার এদের গায়ে এত জোর, এরা কী খায়?’ পশুপতিবাবু সস্নেহে তার মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, ‘নানারকম মাংস খায়...গোরু, ছাগল...।' ব্যাস, কোথা থেকে কিছু ছেলে এসে পশুপতিবাবুর কলার চেপে ধরে বলে, ‘কীসব ভুলভাল শেখাচ্ছেন এদের?’ পশুপতি বাবু বলেন, ‘কেন বাবা, কী ভুলটা বললাম?’ প্রত্যুত্তর আসে, ‘এসব 70 বছরের পুরনো ইতিহাস। বাঘ নাকি আবার মাংস খায়! নেহরু নিজে এসব মাছ-মাংস খেতেন বলে বাঘগুলোর মধ্যেও এসব কু-অভ্যাস ঢুকিয়ে গেছেন। তাই, মাশরুম, ধোকলা খাওয়ার সু-অভ্যাস বাঘগুলোর মধ্যে গড়ে ওঠেনি। আর আপনাদের মতো মানুষরা এই অনাচার দেখেও মুখ খোলেনি। আমরা এসেছি এই ইতিহাসটাকেই বদলে দিতে। এই বাঘটা সম্পূর্ণ ভেজান।' পাশ থেকে চ্যালা গোছের একজন ভুল শুধরে দেয়। ‘দাদা, ওটা ভেগান। তুমি আবার 'জ' গুলোকে 'গ' উচ্চারণ করছ।' ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই হল। ভেগান মানে নিরামিষাশী। বাঘের মেনু বলতে সকালে একবাটি দুধ, দুপুরে ধোকলা, রাতে পালং পনির...এই তো জীবন কালিদা।'
ভ্যাবাচাকা খেয়ে যাওয়া পশুপতিবাবু ছেলেগুলোর কথায় কার্যত বাধ্য হয়েই ঘাড় নেড়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন। ছেলেগুলি সেই ফাঁকে পশুপতিবাবুর হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারটা নিয়ে নিয়েছিল। ইদানিং অনলাইনে ক্লাস করতে হয় বলে পশুপতিবাবু সদ্য হোয়াটসঅ্যাপে এন্ট্রি নিয়েছেন। হোয়াটসঅ্যাপ খুলেই পশুপতিবাবু দেখলেন, তাকে ‘হিন্দুযোদ্ধা’ বলে একটা গ্রুপে অ্যাড করা হয়েছে। সেখানে একজন লিখেছে, ‘আজ থেকে আমাদের গ্রুপে সংযুক্ত হলেন প্রকৃত হিন্দু পশুপতিবাবু।' পশুপতিবাবু অনভ্যস্ত হাতে লিখলেন, ‘কেন বাবা আমি কি এতকাল হিন্দু ছিলাম না?’ সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাই এল, ‘ছিলেন, বাট সিকিউলাররা আপনাদের চোখ অন্ধ রেখেছিল। এবার হিন্দুদের চোখ খুলব আমরা।'
পশুপতিবাবু:- সিকিউলার মানে কী বাবা?
রিপ্লাই:- এ দেশে যারা এখনও হিন্দু-মুসলিম মিলনের কথা বলে তারাই সিকিউলার। এটা সেক্যুলারের অপভ্রংশ রূপ।
পশুপতিবাবু:- সেক্যুলারিজম তো দেশের সংবিধানের অন্যতম একটা আদর্শ?
রিপ্লাই:- দাদু, আপনি কিস্যু জানেন না। দেশের নতুন সংবিধান তো আমরা লিখছি নাকি। মনুস্মৃতি, উপনিষদ মকটেল করে হেব্বি লেখা চলছে। তবে মুশকিল হচ্ছে, আমাদের বড় বানান ভুল হয়। আপনি প্রুফটা একটু চেক করে দেবেন, প্লিজ?
পশুপতিবাবু:- কীসব বলছ তোমরা, কিছুই তো বুঝছি না?
রিপ্লাই:- সব বুঝে যাবেন। ক'দিন আমাদের সঙ্গে অনলাইন ক্লাস করুন, সব ক্লেয়ার হয়ে যাবে। সোমবার যেমন এখানে পড়বেন, গডসের লেখা ‘কেন আমি গান্ধীকে মেরেছি’। মঙ্গলবারের রুটিনে, ‘সাভারকরের মুচলেকা আসলে ব্রিটিশ তাড়ানোর একটা কৌশল’। পরেরদিনের গুলো আবার বলে দেব। চিন্তা করবেন না, আমরাই মেটেরিয়াল সাপ্লাই করব। বানান একটু ভুল থাকতে পারে, এই যা!
দিন চলতে থাকে। পশুপতিবাবু এখন হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। সেখানে যা কিছু শিখেছেন, তা ছাত্র, পরিচিতদের মধ্যে অকৃপণ হস্তে বিলিয়ে যান। শিক্ষার এটাও একটা অঙ্গ। তার নবলব্ধ শিক্ষায় প্রগাঢ় শ্রদ্ধাভক্তি। তাও নানা বিষয়ে মন যে খচখচ করে না, তাও নয়। যতই হোক 70 বছরের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে এসেছেন—তা হোক না সিকিউলারদের শিক্ষা— তবু অভ্যাস যাবে কোথায়? একবার ভুল করে প্রশ্ন করে ফেলেছিলেন, ‘বাঘগুলো নিরামিষাশী হলে ওরা দুর্বল হয়ে পড়বে না?’ সপাটে জবাব এসেছিল, ‘মায়ের তুলনায় মামা বেশি শক্তিশালী হলে আপনার কি ভাল লাগবে দাদু? আমাদের অ্যাজেন্ডা হল বাঘগুলোকে শক্তির নিরিখে আমাদের মা গোরুর পর্যায়ে নামিয়ে আনা।' আর একজন সায় দিয়ে রিপ্লাই করল, ‘একদম ঠিক বলেছ দাদা, আমরা আমাদের মামা বাঘকে একদম বিশ্বাস করি না। মহারাষ্ট্রে তো দেখলাম, বাঘমামা নতুন রিস্ট ওয়াচ পরে আমাদের মা গোরুকে একেবারে ভুলেই গেছে। তাই এই দেশকে গো-ময় করতে বাঘের শক্তি হ্রাস করতেই হবে।'
কিছুদিন পর পশুপতিবাবুর ক্লাসঘরের বাইরে শোনা গেল, পশুপতিবাবু বলছেন—
এই দেশে বাঘমামা খায় নাকো মাংস,
এত দিনের ইতিহাস করা গেছে ধ্বংস।
শুক্তো খায়, দুধ খায়, খায় সে পান,
সেক্যুলার গাল দিলে, ছিঁড়ব আমি কান।
ছাত্ররা সমস্বরে এগুলো আওড়াচ্ছে!
এই কঠিন সময়ে বিরোধীরাও দেশকে সঠিক দিশা দেখাতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে সঙ্কটে পড়বে ভারতই!
ইতিহাস শুধু অতীতের স্মৃতিচারণ নয়, সেটা বর্তমানের পটভূমিতে অতীতকে জরিপ করে নেওয়াও বটে।
বালিগঞ্জ উপনির্বাচনে বাবুল সুপ্রিয়র জয়ে প্রমাণ হল শাসক দলে ভিড়লে সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত হওয়া যায়!
পুরুষ সদস্যের মুখাপেক্ষী না থেকে, আর্থসামাজিক স্বাবলম্বনকে বুঝি 'ভিক্ষাবৃত্তি' বলে?
নারী সুরক্ষায় বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত মোটেই মডেল নয়।
দলের বাইরে বহু চালচোর ছিলই, ভোটের পর দেখা গেল দলের ভিতরেও বহু চালচোর আছে!