×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • তালিবানও আজ অচ্ছুৎ নয় আফগানিস্তানে

    বিতান ঘোষ | 09-07-2021

    তালিবানদের হাত ধরে কি আবার হিংসার রাজনীতি ফিরতে চলেছে আফগানিস্তানে?

    দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে আফগানিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ার রণে ভঙ্গ দিয়ে ফিরে যাচ্ছে মার্কিন সেনাবাহিনী। সরকারিভাবে এই প্রত্যাগমনের প্রক্রিয়া চলতি বছরের 11 সেপ্টেম্বর অবধি চলবে। বস্তুত উপসাগরীয় যুদ্ধের আগে কিংবা পরে— ভিয়েতনাম যুদ্ধকে স্মরণে রেখেও বলতে হয়, এত দীর্ঘকালীন যুদ্ধ আমেরিকাকে আর কোথাও লড়তে হয়নি। স্বভাবতই অন্য দেশে গণতন্ত্রের ধ্বজা ওড়াতে গিয়ে আঙ্কেল টমের দেশকে বহু অর্থ ও মানবসম্পদ ব্যয় করতে হচ্ছিল

     

     

    প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি মিশেল ওবামার দ্বিতীয় দফার শাসনেই একপ্রকার স্থির হয়ে গিয়েছিল যে, দ্রুত আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করবে আমেরিকা। কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে ওবামা এই বিষয়ে ধীরে চলো নীতি নিয়ে এগোতে চেয়েছিলেন। রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রিপাবলিকান বিদেশনীতির ধারা অনুসরণ করেই এই বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন চলতি বছরের 1 মে-র মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে। সেইদিক থেকে দেখতে গেলে বারবার ডেডলাইন বদলে গেলেও, এটা একপ্রকার জানাই ছিল আফগানিস্তান অচিরেই মার্কিন সৈন্যমুক্ত হতে চলেছে। কিন্তু যেটা জানা ছিল না, তা হল ভারত এতদিনের আফগান কূটনীতিতে বদল এনে তালিবানদের সঙ্গে আলোচনায় বসবে। যে ভারত এতকাল "আফগান নিয়ন্ত্রিত', "আফগান শাসিত' স্বাধীন, গণতান্ত্রিক আফগানিস্তানের পক্ষে সওয়াল করেছে, সেই ভারত এখন "বহিরাগত' তালিবানদের সঙ্গে আলোচনায় বসছে। কূটনৈতিক স্তরে এত বড় পরিবর্তনের নেপথ্যে কোন কারণ কাজ করছে, তাই নিয়ে বিশেষজ্ঞমহলে বিভিন্ন মত আছে। বিগত কয়েকদি ধরেই বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এবং বিদেশসচিব হর্ষবর্ধন শ্রীংলার ঘন ঘন কাতার সফরে মনে করা হচ্ছে, সেই দেশেই তালিবান নেতৃত্বের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনায় বসে বিভিন্ন বিষয়ে ঐক্যমত্যে পৌঁছতে চাইছে ভারত। যদিও বিদেশ মন্ত্রকের তরফে এমন কোনও আলোচনার কথা বারবার অস্বীকার করা হয়েছে

     

     

    কয়েকদিন আগে একটি সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আফগানিস্তানে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত ফরিদ মামুনজডে জানিয়েছেন, "তালিবান নেতৃত্বের একটি বড় অংশ আফগানিস্তানে শান্তি সুস্থিতি ফিরিয়ে আনার পক্ষে। ভারত একে স্বাগত জানায়।' প্রসঙ্গত ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর পর তালিবানরা বহু শিবিরে বিভক্ত। এদের একটা অংশ অস্ত্র ফেলে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আফগানিস্তানের শাসনক্ষমতা দখল করার পক্ষপাতী। আবার হাক্কানি নেটওয়ার্কের মতো কিছু অংশ পুরনো চরমপন্থা অনুসরণ করারই পক্ষপাতী। এই অংশের আশঙ্কা তালিবানরা তাদের পুরনো "জেহাদ'-এর অবস্থান থেকে সরে এসে নরমপন্থী অবস্থান নিলে, আইসিস-এর মতো উগ্র সন্ত্রাসবাদী শক্তি সেই জায়গা দখল করে নেবে। ভারত সহ পশ্চিমি দেশগুলির বরাবরের আশঙ্কা এই যে, পাকিস্তানের তরফে তালিবানদের এই চরমপন্থী অংশটাকে মদত জোগানো হয়। এবং পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই সেই কাজে পাক সরকারকে সঙ্গত করে

     

    আরও পড়ুন: ফতোয়া নয়, প্রেমই মেলাবে

     

    আফগানিস্তান নিয়ে ভারতের মাথাব্যথাও বিস্তর। দেশের উত্তর-পশ্চিমে শান্তি ও সুস্থিতি বজায় রাখতে আফগানিস্তানে শান্তি বজায় রাখা ভারতের পক্ষে একান্ত প্রয়োজন। পাক মদতে আফগানিস্তান যাতে ভারত বিরোধী জঙ্গিগোষ্ঠীগুলির মুক্তাঞ্চল হয়ে না ওঠে, সেই বিষয়ে সাউথ ব্লক সদা তৎপর। এতকাল আফগানিস্তানে যে মার্কিন প্রভাবাধীন গণতান্ত্রিক অন্তর্বর্তী সরকার ছিল, ভারতের সঙ্গে তাদের গভীর কূটনৈতিক সখ্য ছিল। বিগত কয়েক বছর ভারত সেই দেশে পরিকাঠামো নির্মাণে প্রায় 80 কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এই সাহায্যের পিছনে অবশ্যই আফগান মুলুককে পাক প্রভাব থেকে মুক্ত করা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চিনের পাল্টা অক্ষ গড়ে তোলার একটা দায় তাদের ছিল। পাকিস্তানও এই নিয়ে বিশেষ স্বস্তিতে নেই। তালিবানদের সঙ্গে ভারতের আলোচনায় বসার খবর ভেসে আসতেই পাক বিদেশসচিব কুরেশি জানিয়েছেন, "ভারত আফগানিস্তানে সন্ত্রাসবাদ আমদানি করছে।'

     

     

    বহুদিন দেশের কূটনৈতিক ওঠাপড়া নিয়ে চর্চা করা প্রবীণ সাংবাদিক প্রণয় শর্মা তালিবানের সঙ্গে ভারতের আলোচনায় বসাকে একটি "স্বাভাবিক' কূটনৈতিক অগ্রগতি হিসাবেই দেখছেন। তাঁর কথায়,  আফগানিস্তানে তালিবানরা ক্ষমতায় এলে আর ভারত তাদের সঙ্গে সমঝোতায় না এলে, ভারতকে একদিকে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, অন্যদিকে চিন — এই দু'টি ফ্রন্টে কূটনৈতিক, সামরিক লড়াই চালাতে হতে পারে। কোনও রাষ্ট্রই তেমন চাইবে না। তাই আফগানিস্তান নিয়ে নিষ্ক্রিয় না থেকে তালিবানদের সঙ্গে ভারতের আলোচনায় বসা একপ্রকার অবশ্যম্ভাবী ছিল। তিনি স্মরণ করিয়ে দিলেন, 1999-এ কান্দাহারে বিমান অপহরণ বাদ দিলে সেই অর্থে তালিবান আর ভারত কখনও একে অপরের বিপ্রতীপে দাঁড়ায়নি। তাছাড়া সেখানকার পশতুভাষী আফগানরা আর্থ-সাংস্কৃতিক কারণে ভারতের সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিচারে একাত্মবোধ করে এবং ভাল সম্পর্ক রাখতে চায়। ভারত সেটাকেও নিজেদের অনুকূলে কাজে লাগাতে চাইছে। এই বাস্তবতার পাশাপাশিই আর এক প্রবীণ সাংবাদিক গৌতম লাহিড়ী অবশ্য এই প্রসঙ্গে, ভারতের "কূটনৈতিক বাধ্যবাধকতা' দেখছেন৷ তাঁর মতে, "আফগানিস্তানে এখন যা পরিস্থিতি, তাতে তালিবানরাই যে সেই দেশে পুনরায় কর্তৃত্ব স্থাপন করতে চলেছে, এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তাই কার্যত বাধ্য হয়েই ভারতকে পুরনো অবস্থান বদলে তালিবানদের প্রতি নমনীয় হয়ে আলোচনায় বসতে হচ্ছে। আফগানিস্তানের মাটি পাক মদতে ভারত-বিরোধী শক্তির আখড়ায় পরিণত হোক তা ভারত চাইবে না।' তবে একই সঙ্গে তিনি বর্তমান ভারত সরকারের গৃহীত বিদেশনীতির ধারাবাহিকতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর কথায়, "ভারত পাকিস্তান, আফগানিস্তানের সঙ্গে ট্র্যাক টু লেভেলে নিয়মিত আলোচনা চালিয়ে গেলেও, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বাধ্যবাধকতার জন্যই বোধহয়, তা কখনও স্বীকার করে নাপ্রকাশ্যে এইসব দেশগুলির বিরুদ্ধে আস্ফালন দেখায়। সরকারের কাজে ও কথায় ফারাকটা স্পষ্ট।'

     

     

    কূটনীতি রাজনীতির জটিল আবর্তে এখন পাক খাচ্ছে ইন্দো-আফগান সম্পর্ক। অনেকেই মনে করছেন, আফগানিস্তানে পশ্চিমি গণতন্ত্রের মডেল স্থাপন করতে ব্যর্থ হল আমেরিকা। প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিল সে দেশে তালিবানি প্রভাব। প্রায় দু'দশক ব্যাপী যে রাজনৈতিক গতিপথে আফগানিস্তান চলেছে, তাতে আমূল পরিবর্তন আসন্ন। প্রত্যেকটি দেশ নিজেদের মতো হিসেব করে পা ফেলতে চাইছে। ভারতও নজিরবিহীন ভাবে তালিবানদের সঙ্গে আলোচনায় বসছে। অর্থনৈতিক ভাবে পশ্চাৎপদ আফগানিস্তানে ভারতের বিপুল বিনিয়োগের কারণে তালিবানের পক্ষেও হয়তো ভারতকে উপেক্ষা করা সম্ভব হবে না— বিশেষত তাদের একটা অংশ যখন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সামিল হতে চাইছে। অদূর ভবিষ্যতে আমুদরিয়ার জল কতটা ঘোলা হয় এবং বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীগুলি সেই জলে কীভাবে কতটা মাছ ধরে সেটাই এখন দেখার। তালিবান-ভারত সম্পর্কের সমীকরণ কেমন দাঁড়ায়, সেদিকেও নজর থাকবে সবার


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    করোনা মহামারীর বিরুদ্ধে লড়তে নেমে আসলে দু'টো মহামারীর বিরুদ্ধে আমাদের লড়তে হচ্ছে।

    উগ্র জাতীয়তাবাদের ভয়ঙ্কর স্বরূপ অনেক আগেই বুঝেছিলেন দুই সত্যদ্রষ্টা মহাপুরুষ

    রাজনীতির হরিদাসদের অনৃতভাষণ আর চমকদারিতে ঢাকা পড়ে যায় হরিচাঁদ ঠাকুর এবং তাঁর সমাজ সংস্কার আন্দোলন।

    রাজ্যের নির্বাচনী সাফল্যের সূত্র ধরে দলের প্রসারের চেষ্টা করছে তৃণমূল কংগ্রেস

    এই দ্বীপভূমি ডুবলে ক্ষমতা ও আভিজাত্যের সাতমহলাও সুরক্ষিত থাকবে না।

    শিল্পীর শিল্প কালোত্তীর্ণ হয় মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় সরকারের দেওয়া রাষ্ট্রীয় খেতাবে নয়।

    তালিবানও আজ অচ্ছুৎ নয় আফগানিস্তানে-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested