করোনাকালের আগে কলকাতার এক জনপ্রিয় নাট্য নির্দেশক তথা অভিনেতার সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, সমসাময়িক রাজনৈতিক সামাজিক বিষয়গুলি কি নাটকের মঞ্চেও উঠে আসতে পারে? সেই নির্দেশক-অভিনেতা জানিয়েছিলেন, "সাম্প্রতিক বিষয় নাটকের মঞ্চে স্থান পেলে নাটকের সৃজনশীলতার সঙ্গে আপস করতে হয়।' তাঁর এই বক্তব্যে খুশি হতে পারিনি। শিল্পীর শিল্পে সমকাল ধরা না দিলে, সেই শিল্প কালোত্তীর্ণ হয় না— ব্যক্তিগত বিশ্বাসের এই জায়গা থেকে কখনও সরিনি। উৎপল দত্ত "টিনের তলোয়ার' করে কিংবা বিজন ভট্টাচার্য "নবান্ন' করে সৃজনশীলতাকে জলাঞ্জলি দিয়েছেন বলেও তো মনে হয় না। যদিও আমি এই বিষয়ে বড় সমঝদার কেউ নই। কিন্তু, আমার বক্তব্যের প্রতিপাদ্য বিষয় হল, বাংলার শিল্পীরা সর্বদা শিল্প সৃজনের সঙ্গে নানাবিধ অন্যায়ের বিরুদ্ধেও সরব হয়েছেন। তাঁদের শিল্পে ধ্বনিত হয়েছে সেইসব প্রতিবাদ-ধ্বনি।
এত কথা বলছি, কারণ বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছেন, শিল্পীদের কাজ শুধু গান করা, নাচ করা। তাই তাঁরা যেন এই সবকিছুর বাইরে রাজনীতি নিয়ে মাথা না ঘামান। দিলীপ বাবুর পরামর্শ না মেনে তাঁরা যদি কালেভদ্রে রাজনীতিতে মাথা গলিয়েও ফেলেন, তাহলে তিনি তাঁদের "রগড়ে' দেবেন বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। দিলীপ বাবু শিল্প এবং শিল্পী বলতে কী বোঝেন জানি না। তবে তাঁর কথায় স্পষ্ট যে, তিনি মনে করেন শিল্পীদের কাজ কেবল নাচ-গান করা। আর একটু স্পষ্ট করে বললে মানুষের মনোরঞ্জন করা, এর বাইরে তাঁদের কোনও সামাজিক, রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা নেই। দিলীপ বাবু অন্তত তেমনটাই মনে করেন।
দিলীপ বাবু নিশ্চয়ই ঋত্বিক ঘটকের নাম শোনেননি। তিনি তো দিলীপবাবুর দলের কোনও মহান কারিয়াকর্তা ছিলেন না, নাম না জানাই স্বাভাবিক। তবে দিলীপবাবুর জেনে রাখা উচিত, স্পষ্টবক্তা হিসাবে তিনি যে আত্মশ্লাঘা বোধ করেন, সেই স্পষ্ট বক্তব্যের নিরিখে ঋত্বিক ঘটকও কম কিছু ছিলেন না। তিনি তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য রাখার জন্য বেছে নিয়েছিলেন সেলুলয়েডকে। শেষ জীবনে প্রায় কর্পদকশূন্য হয়ে স্ত্রীকে বলেছিলেন, "টাকাগুলো থাকবে না, কিন্তু কাজগুলো থেকে যাবে।' দিলীপবাবু নিশ্চয়ই জানেন না, বাংলার কবি কাজী নজরুল ইসলাম ব্রিটিশ বিরোধী কাব্য রচনা করে জেল খেটেছেন, সক্রিয়ভাবে রাজনীতিও করেছেন। ইনকিলাব জিন্দাবাদের মতো বিপ্লবমন্ত্র তাঁর কন্ঠেই নতুন প্রাণ পেয়েছে। গলায় গামছা বেঁধে হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে, পান চিবিয়ে তিনি যখন কলকাতার রাজপথে "সাম্যের গান' গাইতেন, তখন তাঁর কবিসত্তা পূর্ণতা পেত। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের "পথের দাবি' উপন্যাস ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিল। ব্রিটিশ বিরোধী নাটক "নীলদর্পণ' লিখে দীনবন্ধু মিত্র রাজরোষে পড়েছিলেন। শিল্পীর সংবেদী মনে, সুতীক্ষ্ম বিশ্লেষণে সমকাল ধরা দিলে, স্থূলরুচির মানুষ তাকে "রাজনীতি' করাই বলবেন। কারণ, এইসব মানুষরা চান শিল্পীরা পেশাদারি ভঙ্গিতে পয়সাকড়ি নিয়ে শাসকের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করুন।
দিলীপবাবু আরও বলেছেন, বুদ্ধিজীবীরা সমাজের বোঝা। এখন জনমানসে প্রশ্ন উঠছে, বুদ্ধিজীবী ঠিক কারা? এ কথা সত্য যে, সাম্প্রতিক সময়ে রাজ্য রাজনীতিতে "বুদ্ধিজীবী' শব্দটিকে নানা মহল নানা উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছে। এতে বুদ্ধিজীবী শব্দটাই ধারে ও ভারে অনেকটা লঘু হয়ে গেছে। তবে, বুদ্ধিজীবী কারা তা একটা সহজ উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যেতে পারে। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে গোটা দেশের পাশাপাশি যখন বাংলাতেও স্বদেশি এবং বয়কট আন্দোলন চলছে, তখন এই আন্দোলনের অন্যতম একটি কৌশল ছিল, জনসমক্ষে বিদেশি বস্ত্রকে পুড়িয়ে ফেলা। অনেকেই এই কৌশলকে সাধুবাদ জানালেও, রবীন্দ্রনাথ এর বিরুদ্ধে কলম ধরলেন। তিনি লিখলেন, "এই অস্থির সময়ে দেশের মানুষ যখন অর্ধাহারে, অনাহারে অর্ধনগ্ন হয়ে ঘুরছে, তখন এমন ধ্বংসাত্মক কৌশল দেশের কোনও হিতে আসবে না।' বিহারের ভূমিকম্পকে "বর্ণপ্রথার অভিশাপ' বলে উল্লেখ করায় স্বয়ং গান্ধীর কড়া সমালোচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বুদ্ধিজীবী তো তিনিই, যিনি চলতি স্রোতের বিরুদ্ধে গিয়েও নিজের স্বতন্ত্র মতকে যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠা করবেন। তাসের দেশের রাজপুত্র হবেন বুদ্ধিজীবী, যিনি তাসের দেশের নিয়মকে ভাঙবেন। অচলায়তেন মহাপঞ্চকদের দিলীপবাবুরা ভয় পান, কারণ তাঁদের কেনা যায় না, ভয় পাওয়ানো যায় না, হাতে পতাকা তুলে দিয়ে ভোটে প্রার্থী করে দেওয়াও যায় না।
বাংলায় ক্ষমতায় এলে বাংলা ও বাঙালির এই স্বতন্ত্র অবস্থানকে সম্মান জানাতে হবে দিলীপ বাবুদের। জানতে হবে গণনাট্য সংঘের ইতিহাসের কথা, সলিল চৌধুরী, দেবব্রত বিশ্বাসদের কথা। শুধু রবীন্দ্র পুরস্কারের খোয়াব দেখিয়ে আর বাতানুকূল রথে রবীন্দ্র-নজরুলের ছবি আটকে দিলেই বঙ্গ সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া যাবে না। চিত্তপ্রসাদের আঁকায়, রবীন্দ্রনাথের গানে, লালনের লোকায়ত দর্শনে "রাজনীতি' থাকবেই। চোখ "রগড়ে' বিস্ফারিত নয়নে তা দেখে যেতে হবে দিলীপবাবুদের। কতই বা রগড়াবেন দিলীপ বাবুরা, বেশি রগড়ালে চোখ লাল হয়ে যাবে যে!
বন্ধ হরতালময় শহরে এমন দিনগুলোয় সচরাচর ছেলেরা পথে ক্রিকেট খেলে, স্থানীয় চায়ের ঠেকে আড্ডা জমে।
দুর্গাপুজোয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রচারে মত্ত উচ্চবর্ণের হিন্দু বাঙালির ঈদ নিয়ে আপত্তি ঠিক কোথায়?
তালিবানি মৌলবাদের রোগ পালটা মৌলবাদী দাওয়াইতে সারবে না, এটা দেশের রাজনৈতিক তালেবরদের বুঝতে হবে।
এতগুলো অবোধ প্রাণকে সহায় সম্বলহীন করে ঘরের মেয়ে কি শ্বশুরঘরে ফিরতে পারে?
স্বাধীনতা সংগ্রামের লজ্জাকর অতীত থেকে নজর ঘুরিয়ে অলীক অমৃতের সন্ধান করছে বিজেপি।
শাসক গ্যাস চেম্বারে সময়কে মারতে পারেনি, আমরা তাকে সবসময় আগলে রেখেছি।