লাল পতাকা শোভিত মঞ্চ থেকে প্রৌঢ় কমরেড সুভাষ মুখোপাধ্যায় আওড়াচ্ছেন— ‘একটু পা চালিয়ে ভাই, শতাব্দী শেষ হয়ে আসছে।' হন্তদন্ত হয়ে মিটিং অ্যাটেন্ড করতে যাওয়া অনিল কাকার চলন গাভাসকরের স্ট্রাইক রেটের চেয়েও শ্লথ। অনিল কাকার দোষ নেই। তাঁর মধ্যপ্রদেশের আয়তনটি এতই বিপুল যে দ্রুত চলাফেরা করতে তার অসুবিধা হয়। মঞ্চে তখন বুর্জোয়া ও কর্পোরেট আধিপত্য শেষ করার শপথ। তারপর শ্রোতামন্ডলীর কাছে উড়ে আসা প্রশ্ন, ‘কমরেড, নবযুগ আনবে না?’ নিজের মধ্যপ্রদেশ সামলে ফাঁকা চেয়ারে কোনওক্রমে বসে অনিল কাকা স্বগতোক্তির ঢং-এ বিড়বিড় করে, ‘আর বুর্জোয়াতন্ত্রের অবসান! এই মিডলক্লাসটা ছিল বলে আমরা উতড়ে গেলাম৷ এখন এদের খতম করার কথা বললে আমাদের ভোটটা কে দেবে শুনি!’
এটা সত্য যে, জগতের যাবতীয় মহান বিপ্লব, দ্রোহ, চেতনায় কাঠি করার ক্ষেত্রে এই বুর্জোয়া তথা মধ্যবিত্ত শ্রেণী বরাবর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে এসেছে। সেই ফরাসী বিপ্লব থেকে শুরু, এখনও পাড়ায়, বাংলা মেগা ধারাবাহিকে এই নিম্নমানের কাঠিবাজির ধারা অক্ষুণ্ণ রয়েছে। মার্ক্স লন্ডনের লাইব্রেরিতে বসেই বুঝে গেছিলেন এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীটা কী জিনিস। তাই বুর্জোয়াদের ‘সুবিধাবাদী’ থার্ড ফ্রন্টকে সরিয়ে, উনি শাসক আর শোষিতের দ্বিমুখী লড়াইকে গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন।
বুর্জোয়া থুড়ি মধ্যবিত্ত অনেক প্রকার। উচ্চ, মধ্য, নিম্ন, পাতি ইত্যাদি অনেক স্তরে বিন্যস্ত তাদের শৃঙ্খল। অনিল কাকারা অত বোঝে না৷ সুখী মধ্যবিত্তের মধ্যপ্রদেশ বাড়ে, মাঝেসাজে উপরি পাওনার মতো ডিএ-টিএ, কিন্তু বিপ্লব আর হয় না। অনিল কাকার মেয়ে নামজাদা আইটি কোম্পানিতে আছে। অনিল কাকা চেয়েছিল মেয়ে সেখানেও ট্রেড ইউনিয়ন ফিউনিয়ন করুক। কিন্তু বিপ্লবের ক্ষেত্র এখনও প্রস্তুত নয় বলে মেয়ে ব্যাঙ্গালোরে শিফট করেছে। টোটালটাই বিচ্যুতি...বিলাপ করে অনিল কাকা।
নিও লিবেরাল ইকোনমির মৃদুমন্দ হাওয়া গায়ে লাগানোর আগে থেকেই তো দেশি বুর্জোয়াগুলো হেব্বি হিপোক্রিট। শাসকের কাছে কিছু পাওয়ার আশায় সেই মুঘল আমল থেকেই কর্তাভজা একটা কালচার এই ক্লাসটার ভিতরে ঢুকে গেছে। কিন্তু হিপোক্রেসিটাকে এমন শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে, অন্তরে যতই ওয়ালমার্ট থাক, বহিরঙ্গে গোলা ভরা মাঠ থাকবে। আগে তবু সাধ আর সাধ্যের মধ্যে কিছু ব্যবধান ছিল। নয়ের দশকের উদারীকরণ মধ্যবিত্তের সামনে খুড়োর কল ঝুলিয়ে দিল। তারপর নাকি মধ্যবিত্ত যুধিষ্ঠিরকে যক্ষ প্রশ্ন করেছিলেন, ‘হাই যুধিষ্ঠির, হোয়াট ইজ মোক্ষ?’ যুধিষ্ঠির বলেছিলেন, ‘মাল্টিন্যাশনালে চাকরি, সুন্দরী স্ত্রী, ইএমআই-তে ফ্ল্যাট, আর ইংরেজি কম্যান্ডে ওঠাবসা করতে পারে এমন পোষ্য কেনা।' যক্ষ বললেন, ‘অবসর কী?’ যুধিষ্ঠির বলেছিলেন, কেএফসিতে মুরগির ঠ্যাং চিবোনো আর নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতা পড়া— “বোকা ছেলে পুচু পুচু, কোকাকোলা খায়। ইয়ে বাপ তার পয়সা জোগায়।” যক্ষ বলেন, ‘মিসটেক মিসটেক, ইয়ে আবার কী? ওখানে কী শব্দ ছিল, সেটা বলো।' যুধিষ্ঠির মাথা চুলকে বলে, ‘এসব বললে শহরের সুশীল সমাজে আমার ঠাঁই হবে না। আমার শোষিত মানুষের জন্য লেখা কবিতা কেউ পড়বে না।'
মিডলক্লাস এই বৈচিত্র্যময় ক্লাস। মার্কেট চাঙ্গা করতে, পার্টির বুথ আগলাতে, ফেক নিউজ শেয়ার করতে, জবাব চাই, জবাব দাও বলে ডেমোক্রেটির লড়াই টড়াই করতে মধ্যবিত্তকে প্রয়োজন। কারণ উচ্চবিত্তের এসবের সময় বা ইচ্ছা নেই, আর গরিবদের তো চেতনা ফেতনা নেই। ওরা কি লিড করতে পারবে? ওরা না পড়েছে রক্তকরবী, না পড়েছে মার্কেজ। নিত্যনতুন গ্যাজেটসও ওদের হাতে নেই। সুতরাং রাজদ্বারে, শ্মশানে, ফেসবুকে, হাটে, এটিএম-এর লাইনে মধ্যবিত্তই সংখ্যাগুরু।
আরও পড়ুন: দলন না করেও জয় সম্ভব
বৈচিত্র্যময় ক্লাস বলেই যে কোনও শাসকের পক্ষে এদের বাগে আনা মুশকিল। লাভের কথায় হিসাব না মিললে যদি বাকিদের এরা ক্ষেপিয়ে তোলে? কারণ শিক্ষায়, সামাজিক কৌলীন্যে এই ক্লাসটার হেজিমনি তো সহজে যাওয়ার নয়। তাই, এই ক্লাসটাকে ধনেপ্রাণে মারতে হবে। জ্বালানির দামকে শিখরে পৌঁছতে দিয়ে, ভোজ্য, ভোগ্য যাবতীয় বস্তুর দামকে ক্রমোর্ধ্বমুখী করে, সরকারি চাকরির ভরসায় হাপিত্যেশ করে বসে থাকা ক্লাসটাকে বেকার বানিয়ে, ফিক্সড ডিপোজিটে সুদের হার কমিয়ে মধ্যবিত্ত ক্লাসটাকে হয় হটাতে হবে, নয়তো বাবুরাম সাপুড়ের নির্বিষ সাপের মতো সুবোধ সুশীল করে রেখে দিতে হবে। যাতে প্রতিবাদ কিংবা কাঠি, যে কোনও কিছু করার আগে বুর্জোয়াগুলো বুঝে নেয়, আপনি বাঁচলে তবে বাপের নাম।
অনিল কাকা পার্টিজানদের সখেদে বলেন, জীবনে কী আর করলুম আমরা। মার্ক্স, টলস্তয়, কামু সব পড়ে, পার্টিক্লাস করেও আমরা বুর্জোয়াদের হটাতে পারলাম না। আর মোদীজির সরকার কেমন অক্লেশে বুর্জোয়াদের জব্দ করে ফেলল। সত্যিই তো, একটা পরমাণু চুক্তির জন্য মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ নিয়ে চলা অনিল কাকারা হইহট্টগোল করে ফেললেন। আর আজকের ভারত সরকার পুঁজিপতিদের একটার পর একটা চুক্তি করছে, অথচ মধ্যবিত্ত কেমন মন্ত্রমুগ্ধের মতো তা দেখে যাচ্ছে। এই উপমহাদেশের উমেদার জ্ঞানীগুনীরা অনেক শাসকের মধ্যেই লেনিন, মার্ক্স কিংবা চে'কে দেখতে পান। অনিল কাকা প্রধানমন্ত্রী মোদীর মধ্যে মার্ক্সকে দেখেন, যিনি বুর্জোয়াদের হাতে ও ভাতে মারবেন! তারপরই কি ক্লাস স্ট্রাগল শুরু হবে? মধ্যবিত্ত ফেসবুক পোস্টে তার ইতিবৃত্ত লিখবে?
একের পর এক সিদ্ধান্তে আছড়ে পড়ছে বিতর্কের ঝড়, তবু ‘বিদ্যুৎ’-এর চমকে নীরব সমর্থন জোগাচ্ছেন অনেকে।
সমাজের প্রান্তিক মানুষদের অধিকার রক্ষায় পার্থ সারথি বরাবরই সরব।
শিল্পীর শিল্পে সমকাল ধরা পড়লে, শাসক সর্বদাই ভয়ে থাকে।
বাংলার ভোটের ফল বিজেপি বিরোধী শিবিরে আশা জাগালেও বিরোধী ঐক্য এখনও দূর অস্ত।
বাংলার রাজনীতি ও সংস্কৃতির এই অধোগমনে রবীন্দ্রনাথ ব্যথিতই হতেন।
ক্ষমতা প্রয়োগ করে মহামারীর মোকাবিলার সঙ্গে আইনগত এবং নৈতিক দায়িত্বও পালন করাও উচিত কেন্দ্রের।