×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • অহোম জাতীয়তাবাদের সঞ্জীবনী ‘অনুপ্রবেশ’!

    বিতান ঘোষ | 28-09-2021

    বরাবরই অহোম জাতীয়তাবাদের চাঁদমারি হয়েছেন বাঙালি মুসলিমরা।

    ‘যথা কাম বধ্য’, ‘যথা কাম প্রেশ্য’যার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, যখন ইচ্ছা বধ করা যায়, যখন ইচ্ছা পীড়ন করা যায়। পরবর্তী বৈদিক যুগে বর্ণব্যবস্থা যখন আরও জটিল হয়ে উঠছে, তখন শূদ্রদের প্রতি অন্য তিন বর্ণের মানুষের কেমন ব্যবহার করা উচিত, তা বোঝাতেই এগুলি বলা হত। আজকের অসম রাজ্যের দিকে ফিরে তাকালে মনে হয় অ-অহমিয়া মানুষজনকে রাজ্যের সরকার, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ অনেকটা সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই দেখে। অ-অহমিয়া মানুষটি যদি ধর্মপরিচয়ে মুসলমান হন, তা হলে তো কথাই নেই। ‘বাংলাদেশি’ তকমা নিয়ে সন্দেহভাজন নাগরিক হিসাবেই তাকে কালাতিপাত করতে হবে। অন্য ঝুটঝামেলা তো আছেই। আছে জীবন ও সম্পত্তির অস্তিত্বে প্রশ্নও।

     

     

    গত 20 ও 23 সেপ্টেম্বর অসম পুলিশ দরং জেলার সিপাঝার অঞ্চলের 4500 বিঘা জমি থেকে ‘অবৈধ’ বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করে। ঘটনাচক্রে এই অঞ্চলের প্রত্যেক বাসিন্দাই বাঙালি মুসলিম— অসমের উগ্র বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতি যাদের বিরুদ্ধে বারবার চাকরি, জমি দখলের অভিযোগ এনেছে। 20 সেপ্টেম্বরের উচ্ছেদ অভিযান তুলনায় শান্তিপূর্ণ হলেও, 23 সেপ্টেম্বরের উচ্ছেদ অভিযান রক্তক্ষয়ী হয়ে ওঠে। পুলিশের গুলিতে মারা যান 2জন বাসিন্দা। ইতিমধ্যেই ভাইরাল ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, ভিটেমাটি বাঁচাতে সশস্ত্র পুলিশবাহিনীর সামনে সামান্য একটি লাঠি হাতে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেছিলেন যে মানুষটি, তাঁকেই নির্বিচারে গুলি করে খুন করা হয়।

     

     

    হাসিনা বানুর 12 বছরের কিশোর পুত্রও পুলিশের গুলিতে ‘খুন’ হয়েছেন 23 সেপ্টেম্বরের সংঘর্ষে। পুলিশের তরফে যদিও এই মৃত্যুর কথা স্বীকার করা হয়নি। হাসিনা বানুর ছেলের পকেট থেকে একটি নতুন আধার কার্ড পাওয়া গেছে, যাতে জ্বলজ্বল করছে 12 সংখ্যার আইডেন্টিটি নাম্বার। অসমে সন্দেহভাজন নাগরিক কিংবা অবৈধ বাসিন্দাদের পক্ষে আধার কার্ড পাওয়া সম্ভব নয়। তাহলে কীভাবে হাসিনা বানুরা আজ অবৈধ বাসিন্দা হয়ে গেলেন?

     

     

    কিন্তু এইসব গরিবগুর্বো মানুষরা ছিন্নমূল হলেন কী করে? সত্যিই কি এরা অবৈধ বাসিন্দা, জবরদখলকারী? গ্রামের জনৈক বাসিন্দা দূরে বয়ে চলা ব্রহ্মপুত্রের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেন, কিছু বছর আগে ওই ব্রহ্মপুত্রের মাঝে জেগে ওঠা বালির চরেই তাদের সংসার ছিল। প্রতিবছরের বন্যায় সেই চর ডুবেছে, তাদেরও মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে হয়েছে অন্যত্র। যে ব্যক্তি সেদিন পুলিশের গুলিতে নিহত হলেন, তাঁর বৃদ্ধ বাবা বলছিলেন, প্রায় 70 বছর ধরে তাঁরা অসমের বাসিন্দা। তবু তারা অবৈধ নাগরিক, কারণ তাঁরা বাঙালি এবং মুসলমান। কিন্তু নয়া মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা যে বলেছেন, একটানা তিন বছর কোনও সরকারি জমিতে বসবাস করলেই সরকার পাট্টা দেবে?

     

     

    পরিচয় গোপন রাখা সরকারের উচ্চপদস্থ এক আধিকারিকের কথায়, ‘ওসব কথার কথা। আপনার নাম এবং পদবী যদি অহমিয়াদের মতো শুনতে লাগে, তাহলেই কিছু সুযোগসুবিধা মিলতে পারে। সেটা না হলে পাট্টা পাওয়া দূরস্থান, উচ্ছেদের আগে কিংবা পরে পুনর্বাসনটুকুও জুটবে না।' হিমন্ত বিশ্বশর্মা তাই এতকিছুর পরেও অবস্থানে অনড় থেকে বলেছেন, ‘জবরদখলকারীদের হটাতে উচ্ছে অভিযান চলবেই।'

     

    আরও পড়ুন: দেশভাগের খণ্ডিত ইতিহাস বিজেপির নতুন হাতিয়ার

     

    এখানেই চলে আসে অসম রাজনীতির প্রসঙ্গ। মুঘলদের নাস্তানাবুদ করে অহোম রাজারা যে ঐক্যবদ্ধ অসম গড়ে তুললেন, তারপর থেকেই অহোম জাতীয়তাবাদ সেখানকার আঞ্চলিক রাজনীতির ভিত্তিস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তারই ফলশ্রুতিতে পরবর্তীকালে অসম গণপরিষদ তৈরি হয়, ক্রমে আসে আসু, আলফাদের জঙ্গি আন্দোলন এবং অসম চুক্তি ও NRC অসমের রাজনীতি, স্থানীয় জনবিন্যাস ও সংস্কৃতিতে ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠা বাঙালিরা ক্রমশ পিছোতে পিছোতে এখন বরাক উপত্যকার ছোট একটা অংশে এসে টিকে রয়েছে। এখন প্রশ্ন হল, অসম জাতীয়তাবাদের কাছে নতজানু হয়ে প্রথমে কংগ্রেস এবং পরে বিজেপি তো তাদের প্রায় সব দাবিই মেনে নিয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে কোটি কোটি টাকা খরচ করে, হাজার দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী (NRC)-র তালিকা বার করা হল। সেই তালিকা মোতাবেক 19 লক্ষ মানুষকে অবৈধ নাগরিক বলে ঘোষণা করে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো হল। তারপরে দেখা গেল এতে বিজেপি তথা রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদীদের লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে না। কারণ বাদ যাওয়া নামের তালিকায় দু তৃতীয়াংশই প্রায় হিন্দু, যেখানে তাদের আশা ছিল মুসলমানদের নামই শুধু বাদ যাবে। ফলে রাজ্যের বিজেপি সরকার এই NRC তালিকাকে মান্যতা দিচ্ছে না এখনতাদের দাবি, নতুন করে NRC করতে হবে (যদিও সম্প্রতি ফরেনার্স ট্রাইবুনাল রায় দিয়েছে যে, ওই NRC-কেই চূড়ান্ত বলে গ্রহণ করতে হবে)। এই স্বার্থান্বেষী রাজনীতির যূপকাষ্ঠে বলি হল সাধারণ মানুষ আর NRC-র কো-অর্ডিনেটর প্রতীক হাজেলা। কিন্তু এরপরেও কি অসম জাতীয়তাবাদ তৃপ্ত নয়? নাকি অসম জাতীয়তাবাদকে সেখালকার রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক করে রাখতে হলে এই অবৈধ অনুপ্রবেশের গল্পটা বারবার বলে যেতেই হবে?

     

     

    নয়া নাগরিকত্ব আইন (CAA)-এ হিন্দুদের পুনরায় নাগরিক হওয়ার কিছু সংস্থান রেখেছে বিজেপি সরকার। কিন্তু মুসলমান, তাও আবার বাঙালি, তাদের কী হবে? অনেক কসমোপলিটান মানুষজন তো এখনও মনে করেন, বাঙালি আর মুসলমান আলাদা দু’টো সত্তা, মানে একটা হলে অন্যটা হওয়া যায় না। তবে কি প্রজন্মের পর প্রজন্ম শতেকবার নিজেদের নাগরিক হিসাবে প্রমাণ করেও অহোম-ভূমে অকিঞ্চিৎকর জবরদখলকারী হয়েই থাকতে হবে হাসিনা বানুদের? বিরস হেসে পাশে বসা একজন বলে ওঠেন, ‘ব্রহ্মপুত্র আর সরকার তাড়া করলেই আমাদের হাতে প্রাণ নিয়ে এভাবে দৌড়তে হবে, তারপর মরতে হবে। এটাই আমাদের ভবিতব্য।'


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    এই সঙ্কটে দেশের তাবড় রাষ্ট্রপ্রধানরা কে, কেমন ভূমিকা নিচ্ছেন

    মুসলমানরা মিমকে এককাট্টা ভোট দিলে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির কোনও গুরুত্ব থাকবে না।

    বন্‌ধ হরতালময় শহরে এমন দিনগুলোয় সচরাচর ছেলেরা পথে ক্রিকেট খেলে, স্থানীয় চায়ের ঠেকে আড্ডা জমে।

    ঈশান কোণে মেঘ থাকলেও বিসমিল্লার সুরে, ফৈয়জের কবিতায় এই দেশ বেঁচে থাকবে।

    আজকের দিল্লিকে দেখলে গালিব কী লিখতেন জানা নেই। কিন্তু সমকালীন ঘটনার অভিঘাত যদি কবিমানসকে বিষণ্ণ করে

    বিপদের সম্মুখে অসহায় মানুষের আপাত দুর্বল জায়গাগুলো এইভাবেই বুঝি বেআব্রু হয়ে পড়ে।

    অহোম জাতীয়তাবাদের সঞ্জীবনী ‘অনুপ্রবেশ’!-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested