×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • দিগ্‌ভ্রান্ত শাসক, দিশাহীন বিরোধীরাও

    বিতান ঘোষ | 27-05-2020

    নরেন্দ্র মোদী ও রাহুল গাঁধী, প্রতীকী ছবি

    এক করোনায় রক্ষে নেই, আবার আমপান-পঙ্গপাল সহচর। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর মোকাবিলায় বাকি বিশ্বের মতোই লড়ছে ভারত। কিন্তু, এই মহামারীর বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে অনেক মূল্যও চোকাতে হচ্ছে দেশকে। দু'মাস অতিক্রান্ত হতে চলা লকডাউনে দেশের অর্থনীতি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কাকে সত্যি করে, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অকপটে স্বীকার করে নিয়েছে দেশের জিডিপি শূন্যের নীচে নামতে চলেছে। এদিকে অর্থনীতির গাড়িতে গতি আনতে কেন্দ্রীয় সরকার ধাপে ধাপে লকডাউন শিথিল করার দিকে এগোচ্ছে। কিন্তু লকডাউন ঘোষণার পর থেকেই ICMR সহ অভিজ্ঞ মহলের পরামর্শ গ্রহণ না করার ফলে, লকডাউন তুলে নেওয়ার উপায়ও খুঁজে পাচ্ছে না সরকার। লকডাউনের তৃতীয় দফা পর্যন্ত এর নিয়মবিধি প্রণয়ন প্রায় এককভাবে করে আসলেও, চতুর্থ দফায় রাজ্যগুলিকেই সেই বিধি প্রণয়ন করতে বলেছে কেন্দ্র। সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পেলে, কিংবা লকডাউনের ব্যর্থতা প্রকট হলে রাজ্যগুলির কোর্টে বল ঠেলতে পারে কেন্দ্র। তাই, নিজেদের কাঁধ থেকে দায়িত্বের বোঝা লাঘব করে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে রাজ্যগুলিকেও অংশীদার করা হচ্ছে।

     

    সুদীর্ঘ লকডাউনেও যখন করোনা সংক্রমণের হার ঊর্দ্ধমুখী, তখন আমপান বিধ্বস্ত করে দিয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গকে। ক্ষয়ক্ষতির চূড়ান্ত হিসেব হলে কেন্দ্র তা খতিয়ে দেখবে। তারপরই বোঝা যাবে ত্রাণ, পুনর্বাসন এবং পুনর্গঠন কতটা কীভাবে হবে। সামনের বছরই পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন। অতীতের অভিজ্ঞতা বলে, নিছক দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থের কারণেই হয়তো বাংলার জন্য কিছু করে দেখানোর তাগিদ থাকবে নরেন্দ্র মোদীর সরকারের। রাজ্যের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আমপানের তাণ্ডবের পর কেন্দ্রের উদাসীনতাকে কটাক্ষ করে যেভাবে তাদের গায়ে ‘বাংলা বিরোধী' ছাপ লাগাতে চাইছে, রাজনৈতিকভাবে তারও মোকাবিলা করতে হবে বিজেপিকে।

     

    এই সবকিছুর সঙ্গেই সম্প্রতি দেশের পশ্চিম ও মধ্য ভাগে নয়া বিপদ হিসাবে হাজির হয়েছে পঙ্গপাল। তাদের হানায় কয়েক লক্ষ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে। অন্যদিকে সীমান্তে চিনের নেপালের সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধ বাড়ছে। দুই দেশই জানে কূটনৈতিক স্তরেই একমাত্র বিবাদের নিষ্পত্তি সম্ভব। কিন্তু দুই দেশেই কিছুটা, ভারতের ক্ষেত্রে অনেকটাই, দেশের ভিতরকার রাজনৈতিক কারণে পেশী আস্ফালন চালিয়ে যেতে হবে সরকারকে। অন্তত যত দিন পর্যন্ত না কূটনৈতিক আলোচনা শুরু হয়। ঘরে বাইরে এই সঙ্কটের মোকাবিলা সরকার কীভাবে করে, সেটাই এখন দেখার। দেশের অর্থমন্ত্রী যতই দাবি করুন, তাঁর সরকার সঙ্কটকে সুযোগ হিসাবে কাজে লাগাতে পারে, আদৌ এই সঙ্কট থেকে বের হওয়ার মতো কোনও দাওয়াই অর্থমন্ত্রী দিতে পারেননি। দিশাহারা অর্থমন্ত্রক দেশের ক্রমবর্দ্ধমান নগদের চাহিদাকে গুরুত্ব না দিয়েই মরিয়া হয়ে বেসরকারিকরণের পথে এগোচ্ছে। দেশের পরিযায়ী শ্রমিক, অসংগঠিত ক্ষেত্রে যুক্ত কোটি কোটি মানুষের জন্য কোনও আশার বাণী শোনাননি অর্থমন্ত্রী। পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে কোনও অভিন্ন নীতিগ্রহণে ব্যর্থ হওয়ায় সরকারকে দুষছেন স্বয়ং নীতি আয়োগের প্রধান!

     

    এরপরেও কিছু সমীক্ষায় দাবি করা হচ্ছে, নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর সরকারের জনপ্রিয়তা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পন্ডিতপ্রবরদের একাংশ দাবি করছেন, পরিযায়ী শ্রমিকরা প্রধানমন্ত্রীর নীরবতায় ব্যথিত, কিন্তু ক্রুদ্ধ নন। তাদের আরও দাবি, সরকার মহামারীর মোকাবিলায় তাদের কাজকে যেভাবে ‘মডেল' হিসাবে তুলে ধরছে, তার সুফল আগামীদিনে ভোটবাক্সে পাওয়া যাবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সরকার দেশের রাজনৈতিক পরিমন্ডল ও চিন্তার জগৎ থেকে অর্থনীতি বিষয়টাকে যত দূরেই সরিয়ে রাখুন না কেন, অদূর ভবিষ্যতে এই অর্থনৈতিক সঙ্কটের মোকাবিলা করাই তাদের কাছে অন্যতম এক চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে। 2008-এ বিশ্বব্যাপী মন্দার পর যে জি-20 সম্মেলন হয়, তার 20 জন কুশীলবের মধ্যে 18 জনই আর ক্ষমতায় নেই। তারা সকলেই যে মন্দা উদ্ভূত অর্থনৈতিক সঙ্কট নিরসনে ব্যর্থ হয়েছিলেন, এমন কিন্তু নয়। ভারতের ক্ষেত্রে দেশের অসংগঠিত অর্থনীতির ওপর বিমুদ্রাকরণের যে ব্যাপক অভিঘাত পড়েছিল, তার প্রতিফলন কিন্তু ভোটবাক্সেই দেখা গিয়েছিল। 2018-তে তিন তিনটি ক্ষমতাসীন রাজ্যে ক্ষমতা হারিয়েছিল বিজেপি। 2017-তে ফিনিশিং টাচে নিজের গড় গুজরাট রক্ষা করেছিলেন মোদী। ভোটের ফলাফল ঘাঁটলে দেখা যাবে, দেশের সংখ্যালঘু শ্রেণী ও নিম্নবর্গের হিন্দুদের বড় অংশ— যারা আবার অধিকাংশই অসংগঠিত ক্ষেত্রে যুক্ত— বিজেপির বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে মোদীকে হিন্দুত্বের পোস্টারবয় হিসাবে তুলে ধরেও বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি বিজেপি। 

     

    কিন্তু, এর এক বছর পরেই মোদীকে কেন বিপুল ভোটে জেতাল দেশবাসী? আসলে দেশের জনগণের মোদী এবং তাঁর সরকারের প্রতি মোহভঙ্গ হলেও, ওদের বিকল্প হিসাবে বিরোধীদের কাউকে তারা মানতে পারেননি। বিরোধীরা এক বছর আগেও যেমন ছন্নছাড়া আর দিশাহীন ছিলেন, এক বছর পরেও তেমনটাই রয়ে গেছেন অনেকাংশে। বিরোধী দলগুলির সঙ্গে সনিয়া গান্ধীর বৈঠক দেশের বিরোধী রাজনীতির পক্ষে নিঃসন্দেহে একটা ইতিবাচক পদক্ষেপ। কিন্তু, দেশের পরিযায়ী শ্রমিকদের দুরবস্থা নিয়ে দেশ বিদেশের প্রচারমাধ্যমে শোরগোল পড়ে গেলেও, লকডাউনের 53 দিন কেটে যাওয়ার পর তাদের সাথে দেখা করতে এলেন রাহুল গান্ধী। গত 13 মে অবধি দিল্লিতে পড়ে থেকেও সেখানে আটকে থাকা বিহারের শ্রমিকদের দেখতে গেলেন না লালু-পুত্র তেজস্বী যাদব। তাদের সাহায্যের জন্য তিনি কিছু ব্যবস্থা করেছেন বলেও শোনা যায়নি। এই শ্রমিকরাই যদি বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির পক্ষে ভোট দেন, তাহলে কি শুধু মোদী-ম্যানিয়া কিংবা সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে দোষ দিয়েই পার পাওয়া যাবে? উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দৃশ্যতই নানা রকম সঙ্কটে কেন্দ্রীয় সরকার। সেই সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ পেতে, বলা ভাল নজর ঘোরাতে, যেভাবে দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ক্রমান্বয়ে দুর্বল করা হচ্ছে, বিধিবহির্ভূতভাবে লকডাউন বিধি রূপায়ন করা হচ্ছে, কিংবা রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ক্ষেত্রে বেসরকারি পুঁজির পথ খুলে দেওয়া হচ্ছে, তা অবশ্যই নিন্দনীয় কাজ। বিরোধীরা কখনও কখনও এগুলোর বিরুদ্ধে টুইট করছেন, বিপর্যয় মোকাবিলায় এই সরকার কতটা খারাপ আর দায়িত্বজ্ঞানহীন, তা জনগণকে বোঝাবারও চেষ্টা করছেন। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে তারা এই সময় কেন্দ্রের শাসন ক্ষমতায় থাকলে কীভাবে এর মোকাবিলা করতেন, সেই বার্তাটি কোথাও মিলছে না। এই উদ্যোগে খামতি থাকলে মোদী-শাহকে ‘অপ্রতিরোধ্য' বলে আমজনতার মনে হতেই পারে। দেশ সঙ্কটে, শাসকও দিগ্‌ভ্রান্ত। এই সময় বিরোধীরাও দেশের জনগণ এবং সরকার পক্ষকে সঠিক দিশা দেখাতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে সঙ্কটে পড়বে ভারতই।

     


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    দুর্বল, প্রায় অনিচ্ছুক নেতৃত্বের পক্ষে নানা রাজ্যের সম্ভাবনাময় তরুণ নেতাদের কংগ্রেসে ধরে রাখা কঠিন।

    গদ্দারদের সঙ্গে কিভাবে ট্রিট করা হয়, তার একটা নমুনা দেখানো হয়েছিল ৩০শে জানুয়ারি, ১৯৪৮-এ।

    ভরসা নেই মূলস্রোতের রাজনৈতিক দলগুলিতে, রাজ্যে বিজেপিকে রুখতে নাগরিক শপথ শহরে।

    কৃষ্ণের মোহনবাঁশিতেই যখন হিরণ্যকশিপুরা পরাভূত, তখন বিষ্ণুর নৃসিংহ অবতারে আসার কীই বা প্রয়োজন?

    গত ভোটে মরুরাজ্যে যাও বা মরূদ্যানের দেখা মিলেছিল, সেটাও বোধহয় মরীচিকা হয়ে মিলিয়ে যেতে চলেছে।

    দলের বাইরে বহু চালচোর ছিলই, ভোটের পর দেখা গেল দলের ভিতরেও বহু চালচোর আছে!

    দিগ্‌ভ্রান্ত শাসক, দিশাহীন বিরোধীরাও -4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested