×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • রাজনৈতিক উড়ানে পাইলটদের ধৈর্য রাখা জরুরি

    বিতান ঘোষ | 18-07-2020

    তখন পাশাপাশি

    মরুরাজ্যের বালুকারাশির মতোই ক্রমশ তপ্ত হয়ে উঠেছে সে রাজ্যের রাজনীতি। মানিকবাবু বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই গোরস্থানের পর রাজস্থানেও 'সাবধান' হতে বলতেন। সুদীর্ঘ করোনাপর্ব আর লকডাউনে দেশের রাজনীতিতে উত্তাপ-উত্তেজনার বড়ই অভাব দেখা দিচ্ছিল। রাজস্থানের রাজনৈতিক রঙ্গ আপাতত সেই স্থবিরতায় রাশ টেনেছে বলা চলে। সে রাজ্যে কংগ্রেসের প্রবীণ আর নবীন নেতার ব্যক্তিগত রেষারেষি আর ক্ষমতার লড়াই এক টানটান চিত্রনাট্য রচনা করেছে। এমনিতে সারা দেশে কংগ্রেসের রাজনৈতিক অস্তিত্বই সংকটের মুখে, তার ওপর গত ভোটে মরুরাজ্যে যাও বা মরূদ্যানের দেখা মিলেছিল, সেটাও বোধহয় মরীচিকা হয়ে মিলিয়ে যেতে চলেছে। সৌজন্যে যুব নেতা, রাজ্যের সদ্য প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী তথা প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সচিন পাইলটের 'বিদ্রোহ'। তাঁর বিদ্রোহের লক্ষ্য মূলত দলের প্রবীণ নেতা অশোক গেহলোট আর তাঁর পরিচালিত সরকারের দিকে। এখন জাতীয় রাজনীতিতে গুঞ্জন, সচিনের বিদ্রোহে কি বিজেপিই প্রণোদনা জোগাচ্ছে?

     

    2018 সালে রাজস্থানে কংগ্রেস ক্ষমতায় আসা ইস্তক পাইলট এবং গেহলোটের তাল ঠোকাঠুকির শুরু। পাইলট ঘনিষ্ঠমহলে প্রথম দিন থেকে দাবি করে এসেছেন যে, রাজস্থানে কংগ্রেসের সাফল্যে দলের রাজ্য সভাপতি হিসাবে তাঁর অবদানই ষোলো আনা। তাই তাঁকেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী করা হোক। সেই সময় রাহুল গান্ধী দলে বৃদ্ধতন্ত্রকে নিষ্ক্রিয় করে ইয়ং ব্রিগেডকে নিয়ে এগোতে চাইছিলেন। তাই তখন অনেকেই ভেবেছিলেন, সচিনই হয়তো রাজস্থানে দলের সম্ভাব্য মুখ্যমন্ত্রী হতে চলেছেন। শেষমেশ অবশ্য দলের প্রবীণ, পোড়খাওয়া নেতা অশোক গেহলোটকেই মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে বেছে নেয় কংগ্রেস হাইকম্যান্ড। নাকের বদলে নরুণের মতো সচিনের কপালে জোটে উপমুখ্যমন্ত্রীত্ব।

     

    বায়ুসেনার জনৈক কম্যান্ডার রাজশ্বর প্রসাদকে প্রায় নিজে হাতে রাজনীতিতে টেনে এনেছিলেন রাজীব গান্ধী। রাজনীতিতে রাজেশ পাইলট হিসাবে পরে খ্যাতিলাভ করা রাজেশ্বর কেন্দ্রের মন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর বিশেষ আস্থাভাজন হয়ে উঠেছিলেন। সেই রাজেশ পাইলটেরই 'সুযোগ্য' পুত্র সচিন। 2000 সালে গাড়ি দুর্ঘটনায় রাজেশের আকস্মিক প্রয়াণের পর রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করেন সচিন। তারপর কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের স্নেহ ও প্রশ্রয়ে মাত্র 26 বছর বয়সেই সাংসদ, 32 বছর বয়সে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। 40 বছর বয়সে এসে উপমুখ্যমন্ত্রীত্ব এবং তার আগেই রাজ্যের সাংগঠনিক মাথা হয়ে ওঠা। সেই সচিন হঠাৎ নিজেকে 'বঞ্চিত গোবিন্দদাস' মনে করছেন কেন, সেটাই এখন প্রশ্ন। রাজনীতিতে প্রত্যেকটা মানুষেরই কমবেশি উচ্চাকাঙ্খা থাকে। কিন্তু নিজের রাজনৈতিক ওজন এবং কর্তৃত্বের সঙ্গে এই উচ্চাকাঙ্খার তালমিল না থাকলে পপাত ধরণীতল হতে হয়। এমন বহু উদাহরণ দেশের রাজনীতিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।

     

    জাতপাতের দ্বারা বিভক্ত রাজস্থানে প্রায় 89 শতাংশ হিন্দুর বাস। 9 শতাংশ মুসলিম। 89 শতাংশ হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে কৃষক সম্প্রদায় জাঠেরা 18 শতাংশ, গুজ্জর এবং রাজপুতরা মিলে 9 শতাংশ, তফশিলি জাতি এবং উপজাতিরা যথাক্রমে 18 শতাংশ ও 12 শতাংশ। ব্রাহ্মণ এবং মিনারা জনসংখ্যার নিরিখে এদের তুলনায় কিছুটা অকিঞ্চিৎকর। দুই সম্প্রদায়েরই 7 শতাংশ মানুষ এই রাজ্যে বসবাস করেন। রাজস্থানে জাঠ এবং রাজপুত, অন্যদিকে গুর্জর এবং মিনাদের চিরন্তন গোষ্ঠীগত কোন্দল ভোট বাক্সেও প্রভাব ফেলে। বিগত দুই দশকে এই পরস্পরবিরোধী গোষ্ঠীগুলো একটা রাজনৈতিক দলকেই সমর্থন করেছে, এমনটা কখনও হয়নি। মূলত ব্রাহ্মণ, জাঠ ও কিছু দলিত ভোটের জোরে এতকাল রাজস্থানের সাফল্য পাওয়া কংগ্রেস, 1998 সালে প্রথম একজন পিছড়েবর্গ গোষ্ঠী (OBC), মালি সম্প্রদায়ের অশোক গেহলোটকে জয়পুরের কুর্সিতে বসায়। এতে জাঠেরা অত্যন্ত ক্ষুণ্ণ হয়েছিল, এবং সেই সময় থেকেই জাঠ ভোটের একটা বড় অংশ কংগ্রেসের প্রতি বিমুখ হয়ে বিজেপির দিকে ঢলে পড়ে। কিন্তু অশোক গেহলোটের সাংগঠনিক দক্ষতায় 1998, 2003 এবং সর্বশেষ 2018— ক্ষমতায় ফেরে কংগ্রেসই। রাজস্থানিরা অবশ্য প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সরকারের পরিবর্তন ঘটান। সেখানকার স্থানীয় একটা প্রবাদই হল, 'রুটির একটা দিক বেশি পুড়ে যাওয়ার আগেই তাকে উল্টে দিতে হয়।' এসব সত্ত্বেও গেহলোটের কৃতিত্বকে কোনওভাবেই খাটো করা যায় না।

     

    আটের দশকের জয়পুরে স্কুল কলেজের পড়ুয়ারা লক্ষ্মণ সিং গেহলোটকে এক নামে চিনতেন। কেননা তিনি রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ম্যাজিক দেখিয়ে তাদের আনন্দ দিতেন। সেই স্বল্পখ্যাত এক ম্যাজিশিয়ানেরই পুত্র অশোক গেহলোট, যার বিশেষ কোনও রাজনৈতিক অতীত ছিল না। তবে মনেপ্রাণে গান্ধীবাদী এই নেতা যখন 1971 সালের যুদ্ধে পূর্ব বাংলা থেকে আসা শরণার্থী স্রোতকে দেখভাল করার জন্য কংগ্রেসের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে নাম লেখালেন, তখন তাঁর কাজের প্রতি নিষ্ঠা অনেককেই মুগ্ধ করেছিল। যুবক গেহলোট নজরে পড়ে গেলেন স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধীর। রাজস্থানে কংগ্রেসের সংগঠনকে নতুন করে তৈরি করার মহাভার দিয়ে রাজস্থানে পাঠানো হল তাঁকে। নিরাশ করেননি গেহলোট। রাজ্যে জাতপাতের সমীকরণকে সহজে বুঝে নিয়ে, বিজেপির পাল্টা সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিং তৈরি করে রাজস্থানে সাফল্য এনে দিয়েছিলেন কংগ্রেসকে।

     

    অন্যদিকে সচিনের যাবতীয় পরিচিতি লুকিয়ে রাজেশ পাইলটের ছেলে হিসাবেই। 2013-তে মাত্র 21টি আসন পাওয়া কংগ্রেসকে ক্ষমতায় আনতে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হিসাবে তিনি হয়তো চেষ্টার কসুর করেননি। 2018-তে 200 আসন বিশিষ্ট রাজস্থান বিধানসভায় কংগ্রেস 100টি আসন পায়, যা সংখ্যাগরিষ্ঠতার থেকে একটি আসন কম। গেহলোট তখন দিল্লির রাজনীতিতে ব্যস্ত। কিন্তু গেহলোট শিবিরের দাবি, বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়ার বিরুদ্ধে রাজ্যে যে ক্ষোভের বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল, তা সঠিকভাবে কাজে লাগালে কংগ্রেস আরও অনেক ভাল ফল করতে পারত। বোঝাই যাচ্ছে, ইঙ্গিতটা সরাসরি পাইলটের দিকে। পাইলট-গেহলোট দ্বৈরথে কংগ্রেস দিল্লি এবং রাজ্যদুই ক্ষেত্রে তাদের ক্ষমতা বন্টন করে দিয়েছিল। কিন্তু রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর দিল্লি থেকে সেই গেহলোটকেই মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার জন্য ডেকে পাঠানো হল। পোড়খাওয়া গেহলোট কংগ্রেসের অন্যতম ক্রাইসিস ম্যানেজার। নিজের রাজ্যকে হাতের তালুর মতোই চেনেন। তাই দলের দুঃসময়ে ম্যাজিশিয়ান-পুত্রের ম্যাজিকেই ভরসা রাখতে চেয়েছিল 24, আকবর রোড। উল্টোদিকে, পাইলট বর্তমান জেন-ওয়াই সমাজের প্রতিনিধি। কর্পোরেট স্টাইলে গেহলোটদের মতো প্রবীণ রাজনীতিকদের মেঠো রাজনীতিকে অপ্রাসঙ্গিক প্রমাণ করতে চান। পাইলটের আর একটা মুশকিল হল, তিনি নিজে গুর্জর। কিন্তু রাজ্যের গুর্জর সমাজের মধ্যে তাঁর নিজের তেমন কোনও প্রভাবই নেই। তাছাড়া এতকাল কংগ্রেসের সংগঠনে থেকেও তিনি নিজের অনুকূলে সাকুল্যে 17জন বিধায়কের সমর্থন আদায় করতে পেরেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সির স্বপ্ন দেখা যুব আইকনের স্তাবককূল সংখ্যায় এত অল্প হলে তো তাঁর বিড়ম্বনা বাড়ারই কথা। তাই হয়তো পাইলট বিদ্রোহের পথে দু-ধাপ এগিয়ে গিয়েও, একধাপ করে পিছিয়ে আসার বার্তা দিচ্ছেন।

     

    রাজস্থানের পাইলট কিংবা মধ্যপ্রদেশের জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়াস্পটলাইটে থাকা কংগ্রেসের একদা যুব আইকনদের মধ্যে লক্ষণীয় একটা মিল হল, তাঁদের ওজনদার পদবী এবং জমকালো বংশপরিচয়। স্বাভাবিকভাবেই এই দু'টো জিনিসকে পুঁজি করে কংগ্রেসের সংগঠনে চকিত উত্থান ঘটেছিল এনাদের। অচিরেই গান্ধী পরিবার এবং প্রচারমাধ্যমের নয়নের মণি হয়ে উঠেছিলেন তাঁরা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক সাফল্য পেতে হলে যে ধৈর্য ও নিষ্ঠার প্রয়োজন হয়, তা তাঁদের কণামাত্র নেই। তৃণমূল স্থর থেকে সংগঠন গড়ার কাজেও এঁরা কখনওই হাত পাকাননি। সুবেশ, সুস্বাস্থ্য দিয়ে হালের রাজনীতিকে অনেকে ধরতে চাইলেও, মাঠ-ঘাটের রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা এখনও পুরোপুরি ফুরিয়ে যায়নি। কংগ্রেসের শীর্ষমহলও জানে মধ্যপ্রদেশের কমলনাথ কিংবা রাজস্থানের গেহলোটের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দলের এখনও ভীষণ প্রয়োজন। এই প্রবীণদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা পাইলট-সিন্ধিয়াদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খাকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাচ্ছে বিজেপি। ভবিষ্যতে আরও লাগাবে। কংগ্রেসের ভেতরকার অতৃপ্ত আত্মারা বিজেপিকে রাজনৈতিক সুবিধা পাইয়ে দেবে, যেমন গত মার্চে মধ্যপ্রদেশে হল। এতকাল দিল্লির ক্ষমতায় থাকার জন্য নানা উপায়ে কংগ্রেস এই উপদলীয় কোন্দলগুলোর মীমাংসা করে এসেছে। কংগ্রেসের নির্বাচনী সাফল্যের গ্রাফ যত নিম্নমুখী হচ্ছে, ততই দলের যুব 'অপোরচুনিস্ট'রা নিজেদের ভাগ্যান্বেষণে অন্য পথ ধরছেন। কিন্তু কংগ্রেসে থেকে এনারা যে কদর পেতেন, সেটা তাঁরা অন্য দলে পাবেন কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়ে যায়। একক ক্যারিশ্মায় নতুন দল গড়ে প্রবীণদের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো সাংগঠনিক জোর বা জনপ্রিয়তাও তাঁদের নেই। কংগ্রেসের যে প্রবীণরা বহু যুদ্ধের সাক্ষী থেকে এই জায়গায় পৌঁছেছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা বা শিক্ষা থেকে কি সমৃদ্ধ হতে পারতেন না পাইলট বা সিন্ধিয়ারা? ইন্দিরাও তো দলের পুরোনো সিন্ডিকেটের সঙ্গে দ্বৈরথে বেশ কিছু প্রবীণ ও অভিজ্ঞ কংগ্রেসিকে নিজের পাশে নিয়েছিলেন। তবে কি দলের অভ্যন্তরে প্রবীণ বনাম নবীন লড়াইয়ে মদত জুগিয়েই মারাত্মক ভুল করেছিলেন রাহুল গান্ধী এবং কংগ্রেস হাইকমান্ড? বিষয়টি যাই হোক, পাইলটদেরও বুঝতে হবে রাজনৈতিক উড়ানকে মধ্যগগনে নিয়ে যেতে হলে ধৈর্য রাখতে হয়। সহসা জরুরি অবতরণে আখেরে নিজের রাজনৈতিক কেরিয়ারের প্রতিই অবিচার করা হয়।

     

     

     


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    বোম্বে বন্দর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে স্প্যানিশ ফ্লু যা পরে বোম্বে ফ্লু নামে পরিচিত হয়।

    অমুকের ‘দ্যাশ’, তমুকের ‘ভিটে’ নিয়ে এই ‘দেশ’, তাকে অস্বীকার করাই শাসকের মূর্খামি।

    কুচক্রীরা সারাক্ষণ গুজরাত মডেলকে গাল পাড়লেই বা, উন্নয়ন বলতে দেশবাসী তো গুজরাতকেই বোঝে!

    মানুষের অন্তঃস্থলে বহমান যমুনায় প্রভু প্রকট হয়েছেন, তোমরা খুঁজে নিও।

    আমাদের 70 লক্ষ হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ আছে। তাই, আমরা যে কোনও মিথ্যা খবরকে সত্য করতে পারি

    এই দ্বীপভূমি ডুবলে ক্ষমতা ও আভিজাত্যের সাতমহলাও সুরক্ষিত থাকবে না।

    রাজনৈতিক উড়ানে পাইলটদের ধৈর্য রাখা জরুরি-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested