সৃষ্টির আদিকাল থেকেই সুরাসুরের দ্বন্দ্বে অসুর পরাজিত হন। অসুর মানেই বিসদৃশ চেহারার, ভয়াল দর্শন এক মানুষ বা না-মানুষ। আমাদের জীবনের যা কিছু অপ্রাপ্তি, স্খলন, অন্ধকার তারই যেন মূর্তরূপ ওই সবুজ রঙের অসুর। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী মা দুর্গা এই অসুরকে দলন করছেন। তাই তাঁর আর এক নাম অসুরদলনী।
বীরপুজোর এই দেশে বীররসাত্মক আখ্যানের জনপ্রিয়তা বরাবরই আছে। তাই আসুরিক শক্তির বিনাশ বা আঘাত যত সুতীব্রভাবে হবে, ততই সংশ্লিষ্ট ঘাতক বা পীড়ক বেশি মর্যাদা ও সম্মান পেতে থাকবেন। শিবের নটরাজ রূপ তাঁর পুরুষালি গুণরাজির সম্পূর্ণ বহিঃপ্রকাশ। তাই তাঁর প্রতি সসম্ভ্রমে আমরা প্রণতি জানিয়ে থাকি। কিন্তু মদনদেব ধ্যানমগ্ন মহাদেবের ধ্যানভঙ্গ করে, তাঁর মনে প্রেমের ভাব জাগানোর জন্য মদনবাণ নিক্ষেপ করলে ধিক্কৃত হন। আমাদের এই চোখ দিয়ে আমরা যেমন সমকালকে মাপি, তেমনই পৌরাণিক আখ্যানগুলিকেও আমরা আমাদের চোখ ও মনের উপযোগী করে তোলার চেষ্টা করে এসেছি।
কিন্তু আমরা কি শুধু সুরেরই সাধনা করি? আমাদের মনেও কি তবে কোনও অন্ধকার নেই, স্খলন নেই, অসুর নেই? সবুজ রঙ অসূয়া বা হিংসার প্রতীক। তাই আমরা অসুরকে ওই রঙে রাঙিয়ে তাকে বধ করিয়েছি। কিন্তু এই অসূয়ার সঙ্গে আমাদের নিত্য সহবাস। তাঁকে কি আমরা আমাদের মন থেকে কখনও দলন করতে পেরেছি? তবে কেন এই স্ব-বিরোধ? পীড়ন কিংবা দলন ব্যক্তি-দেবতা সকলকেই মহিমান্বিত করে, সন্দেহ নেই, কিন্তু শুধু ভালবাসা দিয়েই কি যাবতীয় আসুরিক শক্তিকে পরাভূত করা যায় না? লয় মানে ধ্বংস, আবার এই লয় ছাড়া সৃষ্টিও যে খাপছাড়া।
দেশের অন্নদাতা কৃষকদের শরীরের ওপর দিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে দিলেন দেশের মান্যবর মন্ত্রীর সুযোগ্য পুত্র! অর্থাৎ তিনি দলন করেছেন, কিছু অকিঞ্চিৎকরকে— যাদের অস্তিত্ব, যাদের লড়াইয়ের কোনও ঠিকানা রাখতে চায় না তার বাবার মন্ত্রীসভা ও সরকার। জানি না, এখনও অবধি তার নামে কোনও জয়ধ্বনি উঠেছে কিনা, কিংবা মন্দির বা মূর্তি তৈরি হয়েছে কিনা। এর আগে অবশ্য এই দেশেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পীড়ন ও দলন করে নায়কোচিত অভ্যর্থনা পেয়েছেন অনেকে। পীড়ন ও দলন এ'দেশে রাজোচিত শব্দই বটে। যিনি তা করতে পারেন, সে নেতা হন বা দেবতা, তাঁর জনপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়তে থাকে।
আরও পড়ুন: ভিক্ষা নয়, স্বাধিকার
দলনের শিকার যারা হয়, তারা দলিত। এই দেশে সচরাচর তারা হয় কালো, ধর্মীয় ও ভাষিক সংখ্যালঘু, নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর, পরিত্যাজ্য, কখনও বা নারী। মূলস্রোতের ধর্মাচরণে অসুরও তেমনই পরিত্যাজ্য। মাইকেল মধুসূদন যতই তাঁকে নায়ক বানান, দ্রাবিড় নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মানুষ যতই তাঁকে তাদের প্রতিনিধি মনে করুক, দশানন রাবণ তবুও নিন্দিত, ধিক্কৃত, দলনের উপযোগী। অথচ এই অসুরদের যা কিছু বিচ্যুতি— ক্ষমতার আস্ফালন, আমিত্ব, হিংসা— সেই সবগুণকেই তো আমরা করায়ত্ত করে ফেলেছি। তবে ওরাই শুধু ‘দলিত’ হবে কেন?
দলন করে নয়, যদি প্রেম দিয়ে সকল অসুরকে বধ করা যেত, কেমন হত তবে? আমাদের বিশ্বাস অনুযায়ী যিনি সত্যদ্রষ্টা, যিনি দানশীলা, যিনি তাঁর অঞ্চলে ঠাঁই দিয়েছেন এই বিশ্বচরাচরকে— সেই দেবী দুর্গার সামনে অসুর তো এমনিই নতজানু হবেন। তাঁকে আর নতুন করে দলনের কী প্রয়োজন? একইভাবে কৃষ্ণের মোহনবাঁশি দিয়েই যখন হিরণ্যকশিপুদের বধ করা সম্ভব, তখন নৃসিংহ অবতারে বিষ্ণুর আগমনের কীই বা প্রয়োজন? মরমের যে পথ ধরে নিবিড়ভাবে যাওয়া-আসা করা যায়, সেই পথের কোমল দূর্বাদলকে দলন করায় কোনও চমৎকারিত্ব থাকতে পারে না। জগতের সব হৃদয়হীন অসুরের বুকে ত্রিশূল নয়, একটা করে মদনবাণ নিক্ষিপ্ত হোক। তারাও এবার প্রেমের কাব্যি বলুক, গেয়ে উঠুক ‘আরও প্রেমে, আরও প্রেমে, মোর আমি ডুবে যাক নেমে'।
শহরের বৈচিত্র্যময় মিছিলে বিভাজন রোখার ডাক।
শিল্পীর শিল্পে সমকাল ধরা পড়লে, শাসক সর্বদাই ভয়ে থাকে।
আব্বাসের সমর্থকরা কি আব্বাসকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রূপে দেখতে চাইবেন?
আইনি ফয়সালা আদালতের অপেক্ষায়, কিন্তু নৈতিকতার পাঠ অসম্পূর্ণ রেখে কোন শিক্ষা দেবেন অঙ্কিতা
বাংলায় রাজনীতি করে বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিকে নিয়ে এমন সংশয় তৈরি করতে পেরেছেন আর কোন রাজনীতিক?
কুচক্রীরা সারাক্ষণ গুজরাত মডেলকে গাল পাড়লেই বা, উন্নয়ন বলতে দেশবাসী তো গুজরাতকেই বোঝে!