আমার বন্ধু সায়ন্তিকা। বয়স 21, আগেই মাতৃহারা, করোনায় অনাথ হল। তবে ঠিক কখন, কীভাবে দত্ত কাকু চলে গেলেন, ও আজও জানে না।
COVID-19 সায়ন্তিকার বাঁচার শেষ অবলম্বনটুকুও কেড়ে নিয়ে নিঃস্ব করে দিয়েছে ওকে। কিন্তু সেই যন্ত্রণা ছাড়াও আরও এক মানসিক যন্ত্রণা, একটা চাপ সহ্য করেছে মেয়েটা, সেটার জবাব কে দেবে? সদ্য প্রকাশ্যে আসা হাওড়ার সলপের অজয় মান্নার ঘটনা রীতিমতো প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে। বিশেষ করে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের এই অমানবিক কাজে ক্ষুব্ধ মানুষ। রোগীর মৃত্যুর পরও পরিবারকে জানানো হচ্ছে সে ভাল আছে, সুস্থ আছে। অথচ বাস্তবে গিয়ে দেখা যাচ্ছে সে পাঁচ দিন আগেই মারা গিয়েছে। এ ঘটনা কিন্তু এই প্রথম নয়।
গত মে মাসে, আমার এক বোন সায়ন্তিকা দত্তের বাবা জ্বরে আক্রান্ত হলে তাঁকে নিয়ে এম আর বাঙ্গুর হাসপাতালে যাওয়া হয়, তারা রেফার করে জোকা শ্রমজীবী হাসপাতালে। সেখানে কাকুর করোনা রিপোর্ট পজিটিভ আসলে তাঁকে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করাতে বলা হয়। সায়ন্তিকা তাতে সম্মতি দেয়, কারণ জোকা শ্রমজীবী হাসপাতাল নন কোভিড হাসপাতাল, সেখানে করোনা আক্রান্ত রোগী তারা রাখবে না।
সায়ন্তিকা বলছে, ‘জানো দিদি ইএসআই থেকে জানায় যে বাবাকে জোকা-র হাসপাতাল থেকে বের করে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু মেডিক্যাল কলেজ কিচ্ছু খবর দেয়নি। কিচ্ছু না। বারবার ফোন করেও বাবার বিষয়ে কিছু জানতে পারিনি। পরে খবর পেলাম যে বিকেল চারটে-পাঁচটার দিকে ভর্তি নিয়েছে।’
কাকুর সুগার ছিল, বয়সও ষাটের বেশি, তার সঙ্গে করোনা সংক্রমণ হওয়ায় অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হয়। ফলে অক্সিজেন দিতে হয় তাঁকে। অথচ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বাড়ির লোকের থেকে রোগীর সম্পর্কে তথ্য জানা তো দূরের কথা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ পর্যন্ত করে না। তারা সেই অসুস্থ রোগীকেই তাঁর নাম, ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে সে তা জানায়। কিন্তু কোনও কারণে তা ভুল লেখা হয়।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ
সায়ন্তিকার মা নেই। কাকিমাও কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। 21 বছরের সদ্য তরুণী মেয়েটা একাই সমস্তটা দেখছিল। হাসপাতাল থেকে কোনও ফোন আসেনি ওর কাছে। বরং ওই বারবার ফোন করে জানতে চায় ‘বাবা কেমন আছে?' কিন্তু কপালে জুটেছে রুক্ষ, দায়সারা খারাপ ব্যবহার। তাতে মেয়েটা দমে যায়নি। যাবেই বা কীভাবে, দায় যে তারই। তারই তো বাবা হাসপাতালে ভর্তি। সে সকলের কাছে প্রার্থনা করেছে, ‘একটু দেখে দেবে, কেউ জেনে দেবে বাবা কেমন আছে, কোথায় আছে? কারও পরিচিতি আছে মেডিক্যাল কলেজে?' একবার একে, একবার তাকে ফোন করে খবর নেওয়ার চেষ্টা চালায় মরিয়া হয়ে।
অবশেষে জানা যায় কাকুকে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের এসএসবি বিল্ডিংয়ের ন'তলায় ভর্তি করা হয়েছে। ফোন করলেই ওপার থেকে ভেসে আসত বিরক্তিমাখা কণ্ঠ:
‘উফ বারবার বিরক্তি করবেন না তো'
‘হ্যাঁ হ্যাঁ উনি ঠিক আছেন'
‘জ্বালাচ্ছেন কেন? রাখুন তো'।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মতে, রোগীর পরিবার তার খোঁজ নিলে সেটা জ্বালানো হয়!
সোমবার থেকে বৃহস্পতিবার হয়ে যায়। মাঝে বুধবার শতাব্দীর বিধ্বংসী ঝড় আমপানে রাজ্যের দক্ষিণাংশ তছনছ হয়ে গেছে। এর মাঝে যতবার হাসপাতালে সায়ন্তিকা খোঁজ নিয়েছে ততবার জানানো হয়েছে ওর বাবা ভাল আছেন। মঙ্গলবার বিকেলে সায়ন্তিকা খবর পায় কাকুর অবস্থা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে। অবস্থার উন্নতি হয়েছে খানিক। শুনে ওর সঙ্গে আমরাও স্বস্তি পাই। বৃহস্পতিবার সকালে ফোন করলে অন্যদিনের মতোই দায়সারা ভাবে ওকে জানানো হয় ‘উনি ঠিক আছেন'।
অথচ আমাদের কাছে খবর আসে কাকু গতকালই (বুধবার) মারা গিয়েছেন। ও আবার ফোন করে এই কথা জানার পর। পাগলের মতো অবস্থা হয়ে যায় ছোট্ট মেয়েটার। কেঁদে কেটে আকুল। বাবা কি সত্যিই নেই? নাকি ঠিক আছে, যেমনটা হাসপাতাল থেকে বলল?
অবশেষে ‘শিল্পী ম্যাডাম' (যিনি মেডিক্যাল কলেজে COVID-এ যারা মারা যাচ্ছে তাদের পরিবারকে খবর দিচ্ছেন এবং পরবর্তী কাজকর্ম দেখছেন) তিনি ফোন করে জানান, গতকাল রাত দশটায় কাকু মারা গেছেন। সায়ন্তিকা-সহ আমরা কেউই ভেবে পাইনা সকালে ওদের কথা মতো যে মানুষটা বেঁচে ছিল সে গতকাল রাতে কীভাবে মারা যেতে পারে? তার মানে কি এভাবেই বারবার বাড়ির লোকের কাছে রোগীর সম্বন্ধে ভুল তথ্য যাচ্ছে? কিন্তু কেন?
এই কেন-এর উত্তর পাওয়া যায়নি। কিন্তু এরপরও লড়াইটা থামেনি ওর। সায়ন্তিকা সমানে তাদের কাছে কাকুতি মিনতি করে, একটিবার যেন তার বাবার ছবি তাকে দেখানো হয়। কাকু যতদিন ভর্তি ছিলেন তার মধ্যে না তাঁর সঙ্গে সায়ন্তিকার কথা বলানো হয়েছে, না ভিডিও কলে দেখানো হয়েছে, আর না মৃত্যুর পর ছবি দেওয়া হয়েছে। সে জানলই না, যার মারা যাওয়ার কথা জানানো হয়েছে সে আদৌ ওর বাবা কিনা। মনে দ্বিধা নিয়েও মেনে নেয়, বাধ্য করা হয় মেনে নিতে নইলে যে ডেথ সার্টফিকেট পাবে না!
নিরুপায় হয়ে সে অনুমতি দেয় মেডিক্যাল কলেজকে তার বাবার শেষকৃত্য করতে। কিন্তু তা কবে হয়? কাকু মারা যাওয়ার 4 দিন পর। রবিবার হাসপাতালের তরফে সায়ন্তিকাকে জানানো হয় সেদিন ওর বাবার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে। একা, অসহায় মেয়েটা শেষবারের মতো তার বাবাকে তো দেখতে পেলই না, উল্টে তার কাজে এত দেরি হল। ডেথ সার্টিফিকেট পেল, তাও কী? "ক্রপড ডেথ সার্টফিকেট'। অরিজিনাল ডেথ সার্টফিকেট আজও হাতে পায়নি সে। সার্টফিকেটের অর্ধেক ছবি তুলে দেওয়া হয়েছে, তাতে আবার রোগীর ঠিকানা ভুল!
রাজ্যের এক নম্বর COVID হাসপাতালের ছবিটাই যদি এমন হয়, রোগীর স্বাস্থ্য এবং তার মৃত্যুর পর এমন অবহেলা যদি চলে তবে রোগীর বাড়ির লোক কী করবে? তাদের যে ভয়ানক কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে, যে মানসিক চাপে তারা রয়েছে সেটা কে বুঝবে?
আজ সায়ন্তিকা একা, সঙ্গে একটা আফসোস, বাবাকে শেষবারের মতো না দেখার আর কিছু প্রশ্ন, কেন ওর বাবার মৃত্যুর পরও মিথ্যা খবর দিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ? কেন এতদিন দেরি করল ওরা বাবার শেষকৃত্য করতে? জানা নেই। উত্তরটা আজও মেয়েটা পায়নি। শুধু জানে এই মারণ রোগ তার একমাত্র ভরসা, একমাত্র অবলম্বনকে কেড়ে নিয়ে তাকে একদম একা করে দিয়েছে।
সায়ন্তিকার পাশে আজ কেউ নেই!
29 জুন ভারতীয় সরকার 59টি চিনা অ্যাপের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করল, কিন্তু এতে কার কতটা লাভ আর ক্ষতি
জুজু’র মতো করোনার ভয়কে নস্যাৎ করে বাঙালি বেরিয়ে পড়ছে আবারও ‘অজানারে জানতে’
একদিকে বিশ্ব উষ্ণায়ন, অতিরিক্ত জলের চাহিদা আরেকদিকে বাঁধ নির্মাণ, সবের চাপে পড়ে ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্
2040এর মধ্যে ভয়ানক পরিবেশজনিত বিপদ আছড়ে পড়তে পারে ভারতে এখনই যদি সরকার ও সাধারণ মানুষ সচেতন না হয়
বরাবর যে বর্ণবৈষম্য চলে আসছে তার ছাপ করোনা সংক্রমণের হারেও পড়েছে এবং ফল হিসেবে প্রাণ হারিয়েছেন বহু
ভদ্রস্থ চাকরি পাওয়ার নিরিখে কলকাতা রয়েছে সবার শেষে।