×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • কাজের চাপে বাড়ছে অবসাদ

    শুভস্মিতা কাঞ্জী | 27-05-2022

    নিজস্ব ছবি

    সাইকোলজিক্যাল হেলথ প্ল্যাটফর্ম ইনার আওয়ার’-এর মতে করোনাকালের আগে যত সংখ্যক ফোন আসত কাউন্সেলিংয়ের জন্য এখন তার ছয় সাতগুন ফোন আসে সাহায্য চেয়ে। একই বক্তব্য ওয়ান টু হেল্প ডট নেট’-এর। তারাও মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে মানুষকে সাহায্য করে থাকে। তাদের বক্তব্য 2020 সালে যে সংখ্যক ফোন আসত কাজের কারণে স্ট্রেস, ডিপ্রেসন হচ্ছে বলে, করোনার সময় থেকে সেই ধরনের ফোনের সংখ্যা 20 শতাংশ বেড়েছে। 

     

    টাইমস জবস সার্ভে ভারতের 1500জন কর্পোরেট কর্মীর সঙ্গে কথা বলে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে যেখানে বলা হয়েছে অতিরিক্ত কাজের চাপ, খারাপ কাজ করার পরিবেশ, অত্যাচারী বস, তাঁদের অন্যায্য দাবি এবং চাহিদার কারণে কর্মীদের মধ্যে হতাশা, অবসাদ দিন দিন বেড়েই চলেছে। সেই রাগ ভিতর ভিতর জমতে থাকে। সেই রাগ, ক্ষোভ প্রকাশ পাচ্ছে পরিবার, প্রিয়জনের উপর। কর্মজগতের প্রভাব সরাসরি পড়ছে ব্যক্তিগত জীবনে। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সম্পর্ক। এবং সেটা চরম সীমায় পৌঁছলে ভিতরের অবসাদ আর বের করতে না পারলে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন কেউ কেউআর এই ছবিটা দিন দিন ভয়াবহ হয়ে উঠছে। এই সমীক্ষার মতে, 60 শতাংশ কর্মীই তাঁদের বসেদের অত্যাচারে তিতিবিরক্ত। তাঁদের মতে বসেদের দূরদর্শিতার অভাব আছে, এবং তাঁরা কর্মক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব করে থাকেন।

     

    সপ্তর্ষি দাশগুপ্ত কলকাতার এক নামকরা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করেন, পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তিনি বলেন, "কী বলব আর! ব্যক্তিগত জীবন বলতে আর কিছুই বাকি নেই। চব্বিশ ঘণ্টাই ল্যাপটপ মুখে নিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে। না মা বাবাকে সময় দিতে পারি, না প্রিয় মানুষকে। ইদানিং তো বাড়িতে থেকেও কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। বিরক্ত লাগে। নেহাত মাস গেলে টাকাটা একাউন্টে ঢোকে, ইএমআই, বিল, অন্যান্য খরচ মেটাতে হয় বলে এখনও দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। নইলে কবেই.... ' সপ্তর্ষি কথাটা শেষ না করলেও বাকিটা সকলেরই অনুমেয়। সপ্তর্ষির মতো এমন আরও অনেকে আছেন যাঁরা একটু একটু করে এভাবেই ভিতর ভিতর গুমরে মরছে। 

     

    একটি সফটওয়্যার কোম্পানির এইচ.আর সুনেত্রা রায় বলেন, "ইন্ডাস্ট্রিতে চাপ আছে, কিন্তু ব্যাপারটা যতটা সহজ করে দেখানো হচ্ছে ততটা সহজ নয়। এখানে প্রতিমুহূর্ত লড়াই করে যেতে হয় প্রজেক্ট পাওয়ার জন্য যে যত কম সময়ে কাজ করতে পারবে প্রজেক্ট সেই পাবে। আর এই কম সময়ে প্রজেক্ট শেষ করতে গিয়ে চাপে পড়ে যায় কর্মীরা। আমরা নানান সময় অভিযোগ পাই কর্মীদের তরফে, কিন্তু কী করব? এই চাপ উপর থেকে নিচুতলার কর্মী সবারই আছে। কিন্তু কিছু করার নেই আমি চাপ না নিলে অন্য কেউ সেই কাজ করে নেবে। ফলে না চাইতেও নিজের চাকরি বাঁচাতে, সংসার চালানোর তাগিদে এই ইঁদুর দৌড়ে সামিল হতেই হয় আমাদের। ছোট কোম্পানিগুলোতে চাপ আরও বেশি কারণ সেখানে কর্মী সংখ্যা কম। আর তাছাড়া এই ইন্ডাস্ট্রিতে মূলত ব্রিটেন বা আমেরিকা থেকে কাজ আসে। ফলে আমাদের যখন কাজ শেষ করার সময় তখন ওদের দেশ কাজ শুরু হয়। আর তখন যদি ক্লায়েন্ট বলে দু তিন ঘণ্টায় কাজ চাই তখন সেটা করতেই হয়। ফলে কাজ করার সময় বেড়ে যায়।'

     

    এই অতিরিক্ত চাপ নেওয়ার ফলে, বেশি সময় ধরে কাজ করা এবং ল্যাপটপের সামনে বসে থাকার দরুন বিরক্তি আসছে। ছোটখাটো কথায় রাগ হয়ে যাচ্ছে। কর্ম এবং ব্যক্তিজীবনের ভারসাম্য হারাচ্ছে। আর এটা আরও বেড়েছে শেষ দুবছরে ওয়ার্ক ফ্রম হোম চলার কারণে। 

     

    মনোসমাজকর্মী মোহিত রণদীপ বলেন, "সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিতে কাজের সময়ের কোনও ঠিক ঠিকানা থাকে না। 8ঘণ্টা কাজ করার বদলে কখনও 12-16 ঘণ্টাও কাজ করতে হয়। আর এখন ওয়ার্ক ফ্রম হোম হওয়ার কারণে 24 ঘণ্টাই সজাগ থাকতে হয়, কাজ করতে হয়। অনিশ্চয়তাময় জীবন। কোনদিন কাজ থেকে বসিয়ে দেবে কেউ জানে না। এভাবে চাপ নিয়ে কাজ করার ফলে ঘুম ঠিক করে হচ্ছে না। ঘুম হলেও তার মধ্যে মানুষ কাজ নিয়ে ভাবছে। বা কাজের পর অনেকটা সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যয় করছে, ফলে ঘুম কমছে। আর ঘুম ঠিকঠাক হচ্ছে না বলে নানান সমস্যা দেখা দিচ্ছে, মাথা ঠিক করে কাজ করতে পারছে না, মনঃসংযোগ কমছে। সাইকোলজিক্যাল, নিউরোলজিক্যাল সমস্যা দেখা দিচ্ছে।' এই দিকগুলো ছাড়াও মোহিত রণদীপ আরও একটি দিক তুলে ধরেন। তিনি বলেন, "যাঁরা আইটিতে কাজ করেন তাঁরা একটা মোটা অঙ্কের টাকা মাইনে হিসেবে পায়। এবং তার একটা বড় অংশ তাঁরা মদ কিংবা নেশায় খরচ করেন। সে করতেই পারেন, কিন্তু এর সঙ্গে মানসিক এবং শারীরিক সমস্যা জড়িয়ে রয়েছে। অনেকেই ইদানিং মদ বা নেশায় অভ্যস্থ হয়ে উঠছেন চাপ থেকে মুক্তি পেতে। আর এর ফলে সাইকোলজিক্যাল সমস্যা বাড়ছে, সন্দেহ করার প্রবণতা বাড়ছে, বাড়ছে অবসাদ এবং উদ্বেগ।'

     

    আরও পড়ুন:অনলাইন নয়, ক্লাসঘরের শিক্ষাই প্রকৃত লাইন

     

    কিন্তু এখান থেকে মুক্তির উপায় কী? সুনেত্রা রায় বলেন, "আজকাল কম বেশি সব কোম্পানিই কর্মীদের মন ভাল রাখার জন্য নানান অ্যাক্টিভিটির ব্যবস্থা রাখে, মনোরোগ বিশেষজ্ঞকেও রাখা হয় যাতে কারও মনের কথা খুলে বলতে ইচ্ছে হলে তাঁর কাছে যেতে পারে। এছাড়াও আমরা কর্মীদের একটা খোলামেলা পরিবেশ দেওয়ার চেষ্টা করি।' শুধু সুনেত্রা তাঁর অফিসের কর্মীদের জন্য ভাবেন না, অন্যান্য অফিসেও এরম নানান ব্যবস্থা রাখা হয়। কর্মীদের দু তিনদিনের ছুটিও দেওয়া হয়। কিন্তু তারপর আবার সেই একই জিনিস। অতিরিক্ত চাপ, অতিরিক্ত সময় ধরে কাজ। এ যেন এক ভিস্কাস সাইকেল। যার শেষ নেই। সুনেত্রা রায়কে যখন জিজ্ঞেস করা হয় এসব ব্যবস্থার বদলে কেন সরকারের নিয়ম মেনে আট ঘণ্টা কাজ করা হয় না? তিনি বলেন, "সফটওয়্যার বা ইনফরমেশন টেকনোলজি ফ্যাক্টরি রুলসের আওতায় পড়ে না। এখানে চব্বিশ ঘণ্টা কাজ হয়। আমি না করলে আরও দশজন আছে সেই কাজ করার জন্য। ফলে না চাইতেও কাজ করতে হয়। কাজের চাপ তো থাকবেই, সেটাকে ম্যানেজ করতে জানতে হবে। অনেকে পারে অনেকে পারেন না।'

     

    কিন্তু কী করে এই মানসিক চাপ ম্যানেজ করা সম্ভব?  মোহিত রণদীপ বলেন, "সবার আগে এই ব্যবস্থার পরিবর্তন আনতে হবে। কর্মীরা কাজ হারানোর ভয়ে মুখ খুলবে না স্বাভাবিক। আর সরকারও কর্পোরেট হাউজগুলোকে ঘাঁটায় না। ফলে কেউ নেই যে এই বিষয়টার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। এই অবস্থায় নিজের পাশে নিজেকেই দাঁড়াতে হবে। এই চাপকে মন থেকে বের করতে হবে। প্রয়োজনে কারও সঙ্গে কথা বলতে হবে, সেটা কাছের কোনও মানুষ হোক কিংবা কোনও কাউন্সিলর। কথা জমতে থাকলে একসময় সেটা বার্স্ট করবেই, তার আগেই তাকে বের করে দেওয়া উচিত। কোনও কিছু না পারলে অন্তত লিখে সেই কথা মন থেকে বের করতে হবে। আর যাই হয়ে যাক আট ঘণ্টা ঘুমাতে হবেই। ঠিক সময় খাওয়া, স্নান সারতে হবে। জীবনে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।'

     


    শুভস্মিতা কাঞ্জী - এর অন্যান্য লেখা


    নিজেদেরই তৈরি করা সমস্যায় মানুষ এখন নিজেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ছে

    জানকী শিকারী, পশ্চিমবাংলার আদিম জনজাতি বিরহড় গোষ্ঠীর প্রথম মেয়ে, যে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করল।

    মন্দির মসজিদের মতো ঐতিহাসিক স্থাপত্যের গায়েও ধর্মের রং লাগানো হচ্ছে চিহ্ন দেখে।

    এক মহিলার রাজ্যেই অন্য মেয়েরাই নিরাপদ নয়, কারণ তিনি ধর্ষণের অজুহাত দিতে ব্যস্ত! 

    বিধানসভা ভোট এবং করোনার কারণে পিছিয়ে গেছে মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক, কিন্তু রয়ে গিয়েছে অনেকগুলো প্রশ্ন

    বাংলা সিনেমার দর্শক সংখ্যা কী কমছে? নেপথ্যে কী কারণ?

    কাজের চাপে বাড়ছে অবসাদ-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested