×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • দেশভাগের খণ্ডিত ইতিহাস বিজেপির নতুন হাতিয়ার

    বিতান ঘোষ | 19-08-2021

    মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে আলোচনায় জহরলাল নেহরু এবং মহম্মদ আলি জিন্না।

    বাংলায় 16 অগস্টের পুনরাবিষ্কার হল 75 বছর পর। এক পক্ষের ‘খেলা হবে’ দিবস, অন্যের ‘কালো দিন’। ইতিহাস থেকে বাঙালি কিছুই শেখেনি, আপাতত ইতিহাসের সার শিক্ষা এটাই।

     

     

    রাজ্যের তৃণমূল সরকার ঘোষণা করেছে, এবার থেকে 16 অগস্ট দিনটি সারা রাজ্যে ‘খেলা দিবস’ হিসাবে পালিত হবে। এমনিতে খেলা দিবসের বিশেষ কোনও ঐতিহাসিক তাৎপর্য নেই। 1980 সালের এই দিনটিতে ইডেন গার্ডেনসে একটি দুর্ঘটনায় 16 জন মারা যান। চার দশক পর সেই ঘটনাকে স্মরণ করে রাজ্য প্রশাসন এমন একটি উদ্যোগ নিয়েছে, এমনটাও মনে হয় না। তাছাড়া আজকালকার অগুন্তি দিবসের প্রত্যেকটিরই কোনও ঐতিহাসিক তাৎপর্য থাকবে, এমন তো কথা নেই। সরকারের ইচ্ছায় কর্ম যখন, সরকার চাইলেই এমন খান পাঁচেক দিবস তৈরি করতে পারে। বিরোধীরা তা নিয়ে প্রশ্নও তুলতে পারে। সংসদীয় রাজনীতিতে এটাই দস্তুর।

     

     

    রাজ্যের অধুনা বিরোধী দল বিজেপির আপত্তির জায়গা অবশ্য অন্য। তাদের কাছে 16 অগস্ট দিনটি ‘কালো দিন’, কারণ 1946 সালের এই দিনটিতে কলকাতা শহরে একটা মারাত্মক জাতিদাঙ্গা ঘটে। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি আগাগোড়া এই ঘটনাকে মুসলিম লিগ কর্তৃক ‘হিন্দু-নিধন যজ্ঞ’ বলে দাবি করে এসেছে। সেই সব সংগঠনেরই রাজনৈতিক উত্তরাধিকার, বিজেপির অভিযোগ, ওই ‘হিন্দু নিধন দিবস’কে উদযাপন করতে এবং বিশেষ এক ধর্মের প্রতি নরম অবস্থান নেওয়ার জন্যই নাকি রাজ্য সরকার এমন একটা দিনকে ‘খেলার দিন’ হিসাবে বেছে নিয়েছে। বিজেপির কাছে এটা জীবন নিয়ে খেলার সমতুল।

     

     

    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে তখন অর্থনৈতিক ভাবে বিপর্যস্ত ইংল্যান্ড। ক্ষমতায় এল লেবার পার্টি। প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলি চাইলেন দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিপুল অর্থনৈতিক বোঝা থেকে দেশবাসীকে মুক্ত করতে। কিন্তু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই গরিব আর বহুলাংশে নিরক্ষর দেশটার জন্য তো একটা আদর্শ সংবিধান রচনা করা প্রয়োজন। এই সংবিধানের নীতি ও পদ্ধতি নির্ধারণ করতেই ভারতে তিন সদস্য বিশিষ্ট ক্রিপস মিশন পাঠানো হল। এই মিশনের সদস্যরা ছিলেন ভারত সচিব স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস, এভি আলেকজান্ডার এবং পেথিক লরেন্স। ক্রিপস চেয়েছিলেন ভারতের রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠা করে দ্রুত অন্তবর্তী সরকার গঠন করতে। কিন্তু দুই যুযুধান রাজনৈতিক দলের মতের ফারাক ক্রিপস দৌত্যেও সামাল দেওয়া যায়নি। মুসলিম লিগ চেয়েছিল ব্রিটিশ সরকার সুস্পষ্ট ভাবে স্বতন্ত্র পাকিস্তানের কথা ঘোষণা করুক। কংগ্রেস চেয়েছিল ঐক্যবদ্ধ ভারত। ক্রিপস প্রস্তাবে অবশ্য দেশভাগের কোনও ইঙ্গিত ছিল না। প্রদেশ এবং স্বাধীন এলাকা হিসাবে মাথা তুলে থাকা দেশীয় রাজ্যগুলিকে বেশ কিছু অধিকার দেওয়া হলেও স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়, তারা ভারতীয় ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারবে না।

     

     

    এত কিছুর পরেও মুসলিম লিগ গোড়ায় এই প্রস্তাবে সম্মত হয়েছিল। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, তারা কি জানত না যে, ক্রিপস প্রস্তাবে দেশভাগের কোনও আশ্বাস দেওয়া হয়নি? উপমহাদেশের ইতিহাসচর্চায় জিন্নাকে নিয়ে নিবিড়তম চর্চা যিনি করেছেন, সেই আয়েশা জালাল মনে করেন, প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম প্রধান রাজ্যগুলিতেও কংগ্রেস সাফল্য পাচ্ছিল। এই পরিস্থিতিতে উন্মত্ত জনতার আবেগে রাশ টানতে না পারলেও জিন্না অল্পতেই সন্তুষ্ট হতে চেয়েছিলেন। পাকিস্তান প্রস্তাব নিয়ে শোরগোল তোলাটা ছিল তাঁর রাজনৈতিক দায়। তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ দাঁড়িয়ে ছিল এর ওপর। তাই 1946 সালের 16 অগস্ট তিনি সারা দেশে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের ডাক দিয়ে (Direct Action Day) মুসলিমদের কর্মবিরতি নিতে বললেন এবং পাকিস্তান গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা মানুষকে জানাতে বললেন। কলকাতায় তখন হোসেন শাহিদ সুরাবর্দির নেতৃত্বাধীন মুসলিম লিগের সরকার। কংগ্রেসের রাজনৈতিক অবিমৃষ্যকারিতায় কংগ্রেস এবং ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির জোট সরকার গঠন সম্ভব হয়নি আগেইএকক বৃহত্তম দল হিসাবে বাংলায় ক্ষমতাসীন হল মুসলিম লিগ।

     

    আরও পড়ুন: তপস্বিনী আদি ভারতমাতা তেজস্বিনী রণরঙ্গিনী নন

     

    1946 সালের 16 অগস্ট থেকে 19 অগস্ট চারদিন ধরে চলল নারকীয় হত্যালীলা। প্রথমে উন্মত্ত মুসলিম জনতা হিন্দু বাড়ি ও দোকানঘরগুলিতে ব্যাপক লুঠতরাজ চালাল, তারপর হিন্দু মহল্লাগুলো থেকে প্রতিরোধ ও পালটা আক্রমণ শুরু হল। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সোরাবর্দি যেন সবকিছুই হতে দিলেন, স্বাধীনতা-উত্তর ভারতেও যেমন সংখ্যাগুরু প্রশাসক সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার হলে অন্ধ, নির্লিপ্ত হয়ে বসে থাকে। কলকাতার পর দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল বোম্বাই, বিহার, যুক্তপ্রদেশেও। ব্রিটিশ সরকারের ধৈর্যচ্যুতি ঘটছিল৷ ঘটনার বীভৎসতা প্রত্যক্ষ করে নেহরুও হাল ছেড়ে দিলেন। আর গান্ধী যেন তখন আধুনিক মহাভারতের কর্ণ, যাঁর অহিংসা আর সত্যাগ্রহের চাকা ক্ষমতার পাঁকে বসে গেছে। একসময় তিনি বলেছিলেন দেশভাগ হলে তাঁর বুকের ওপর দিয়ে করতে হবে। কলকাতা দাঙ্গার পর তিনি ভাষা হারালেন, বিবিসি-র সাংবাদিক সাক্ষাৎকার নিতে এসে দেখলেন, প্রায়োন্ধকার ঘরে কুপি জ্বালিয়ে গান্ধী গীতা পড়ছেন। অশ্রুধারা তাঁর গাল বেয়ে নীচের দিকে নেমে আসছে। কথা বলার অবস্থায় তিনি নেই। যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন ভারতের ললাটলিখন।

     

     

    সেই সময়ে ঢাকার হিন্দুপ্রধান অঞ্চলে যেমন ব্যাপক মুসলিম নিধন হয়েছে, তেমনই ত্রিপুরা ও নোয়াখালিতে অবস্থাপন্ন মুসলিম কৃষকরা বহু হিন্দুকে নিকেশ করেছে। সেই তুলনায় কলকাতা দাঙ্গায় কেউই কাউকে জমি ছেড়ে দেয়নি। উপমহাদেশের অধিকাংশ দাঙ্গাতেই ধর্ম মুখ্য ভূমিকা নিলেও অন্যান্য অনেক আর্থ-সামাজিক কারণও এর মধ্যে লুকিয়ে ছিল। ঐতিহাসিক জোয়া চ্যাটার্জি দেখিয়েছেন, বাঙালি ভদ্রবিত্ত শ্রেণি স্রেফ নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখতেই দেশভাগ চেয়েছিল। এই সময়ে উত্তর ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ঢেউ বাংলাতেও এসেছিল। হিন্দু মহাসভার শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি, এনসি চ্যাটার্জিরা (সোমনাথ চ্যাটার্জির পিতা) হিন্দুদের সংগঠিত করার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। বাংলায় অরবিন্দ ঘোষেরা তার আগেই হিন্দু পুনরুত্থানবাদী রাজনীতির গোড়াপত্তন করে গিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও দেশভাগের আগে ও পরে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি বাংলায় বিশেষ কল্কে পেল না।

     

     

    বামপন্থীরা এই খন্ডিত দেশের স্বাধীনতাকে মানেননি। স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, ভুলো মাৎ’ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠী খুব সুন্দর করে একটা মধ্যপন্থা নিয়েছিলেন। লিখেছিলেন, ‘এই স্বাধীনতা ঝুটা না হলেও জন্মসূত্রে প্রতিবন্ধী’এটাই তো বোধহয় উপমহাদেশের মনের কথা। বুকের পাথর চাপা দিয়েও তো আমরা কাঁটাতার আর ধর্ম দিয়ে ভিন্ন করেছি নিজেদের। ক্রমশ মিলিয়ে আসা এই ক্ষতকে কেন আবার খুঁচিয়ে দিতে চাইছে বিজেপি? ছিন্নমূল হওয়া বাঙালির একাংশের মধ্যে ইসলাম-বিদ্বেষ জাগিয়ে ভোটের বাক্সে ফায়দা তোলাই কি এর লক্ষ্য? আসলে অতীতের বহু ঘটনাতেই আমরা দেখেছি, একটা মৌলবাদকে জনগণের চোখে বৈধতা দিতে গেলে, অন্য একটি মৌলবাদের জুজু দেখাতে হয়। আর আমরা যারা রাজনীতিকদের ক্রীড়ানক মাত্র, তাদের যন্ত্রণা বুকে রেখে একদিন সব ভুলে যাওয়ার ভান করতে হয়। দুই জার্মানিও তো বৈরিতা ভুলে এক হয়েছে, মিশে গেছে দুই ভিয়েতনামও। আমাদের ব্যথার জায়গাতেই এই রাজনৈতিক সুড়সুড়ি কেন? দেশের শাসকদলের রাজনৈতিক দৈন্য কি এতটাই যে তাদের একটা রক্তক্ষয়ী, বিয়োগান্তক ইতিহাসের ভূতকে সামনে নিয়ে আসতে হচ্ছে?

     

    আরও দেখুন: দেশভাগের যন্ত্রণাকে উদযাপন?

     

    বিংশ শতকের গোড়ায় যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সমাজের উচ্চকোটির মানুষদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছিল, চারের দশকের সূচনাকাল থেকে তাই নীচুতলার মানুষকে বিভাজনের রাজনীতিতে প্রণোদিত করে। এই সময় উপমহাদেশের যে অংশে যে ধর্মসম্প্রদায় শক্তিশালী থেকেই, সেই সম্প্রদায়ই অন্য সম্প্রদায়ের সংহারক হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। তাই এখানে কেউই শুধু ‘আক্রমণকারী’ আর ‘আক্রান্ত’ নয়। খণ্ড ইতিহাসকে সামগ্রিক ইতিহাস বলে স্বীকার করলে বড় ভুল হয়ে যাবে। ধর্মের মোহে গত শতাব্দী জুড়ে আমরা বহু মানুষকে মেরেছি, নিজেরাও মরেছি। এই তিক্ত অতীতকে ইছামতী আর সিন্ধুর পাড়ে ফেলে, সবকিছু নতুন করে গুছিয়ে আমরা এগোতে চেয়েছি। শাসক কখনও বাংলার নাম পরিবর্তনের প্রশ্নে, কখনও দেশভাগকে উদযাপনের নামে এই ব্যথাকে জাগিয়ে দিতে চেয়েছে। পুরনো ব্যথা চাগাড় দিলে যদি কোনও ভাব-প্রতিক্রিয়া হয় তাহলে বুঝি শাসকের লাভ হবে। কিন্তু মাননীয় শাসক, প্রতিক্রিয়া বলতে তো একরাশ ঘৃণা। আমরা কেন এই নিয়ে আমাদের পড়শি ভাইবোনেদের দুষব? আমরা তো ভুলিনি হিন্দু মহাসভা, গোলওয়ারকররা মহম্মদ আলি জিন্নার মতোই ধর্মের ভিত্তিতে দু'টো স্বতন্ত্র দেশ চেয়েছিলেন। রাজনৈতিক কারণে পুরনো ব্যথা জাগিয়ে তুলতে গিয়ে, নিজেদের কৃতকর্ম ধরা পড়ে গেলে বড় শাসককেই বড় বিড়ম্বনায় পড়তে হবে যে!


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    মুখ্যমন্ত্রী হয়েও নারীবিদ্বেষী কদর্য আক্রমণের শিকার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

    বাংলার ভোটের ফল বিজেপি বিরোধী শিবিরে আশা জাগালেও বিরোধী ঐক্য এখনও দূর অস্ত।

    সরকার বিরোধী মত উঠে আসাতেই কি মন্ত্রীর কাছে ‘সাম্রাজ্যবাদী’ ইন্টারনেট?

    তোমার শিল্প নেই, সংস্কৃতিও ঘুচতে বসেছে, ভদ্রজন, তাই কি তোমার এই কৌলীন্য রাখার দায়?

    সন্তানের বাবার নাম জানতে সমাজের যতই নোলা ছকছক করুক, মা তা জানাতে বাধ্য নন।

    ধর্ম যাদের সঞ্জীবনী, সেনাশাসন যাদের গণতান্ত্রিক আভরণ, তাদের পথ আমরা কেন অনুসরণ করব?

    দেশভাগের খণ্ডিত ইতিহাস বিজেপির নতুন হাতিয়ার-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested