×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • কার বাপের কী?

    বিতান ঘোষ | 15-06-2021

    কার বাপের কী?

    দেশের শাসক বর্গের বৌদ্ধিক গুরুদের অনুসরণ করেই কি আমরা বৈদিক যুগের সময়ে ফিরে যাচ্ছি? নগর-সভ্যতার ভদ্রজনেরা যেভাবে সম্ভাব্য গর্ভবতী এক মহিলার সম্ভাব্য সন্তানের সম্ভাব্য পিতার পরিচয় নিয়ে গবেষণায় রত তার থেকে এটা মনে হচ্ছে।

     

     

    সাংসদ নুসরত জাহান তাঁর দু'বছর আগেকার সামাজিক বিয়েকে আইনগতভাবে অস্বীকার করেছেন। তাই নিয়ে তাঁর সঙ্গে তাঁর সদ্য ‘প্রাক্তন’ স্বামীর বাদানুবাদও প্রকাশ্যে এসেছে। নুসরতের বিয়ে আইনগত ভাবে বৈধ কিনা তা বিচার করবে আদালত। কিন্তু নুসরত যদি সন্তানসম্ভবা হয়ে থাকেন, তবে তাঁর গর্ভে কার সন্তান তা বিচার করার মহাভার আমাদের কারও ওপরেই নেই। নুসরত নিজে সেটা প্রকাশ্যে আনেননি। হয়তো ভবিষ্যতে আনবেন, কিংবা আনবেন না। উনি যাই করুন, ওঁর গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারকে আমাদের সম্মান জানানো উচিত।

     

     

    নুসরত জানিয়েছেন তিনি লিভ-ইন সম্পর্কে ছিলেন। অর্থাৎ, আইনি উপায়ে বিয়ে না করে তাঁর পুরুষ সঙ্গীর কাছে কিছুকাল ছিলেন। নুসরত সবাইকে জানিয়েই তুরস্কে গিয়ে ‘বিয়ে’টা করেছিলেন, তাঁর সেই পুরুষ সঙ্গীকে তিনি ‘স্বামী’ বলেই সর্বত্র পরিচয় দিতেন, তিনি নিজেও স্বামীর ধর্ম, হিন্দু ধর্মের আচার আচরণ পালন করতেনএর পর তাঁদের সম্পর্কটা ভারতীয় আইন অনুসারে বিয়ে কিনা তা বিচারের ভার আদালতের। এক ছাদের তলায় দুই প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ উভয়ের সম্মতিক্রমে থাকলে, আর বন্দোবস্তটার নাম লিভ-ইন হলে সমাজের অনেকের ভ্রুকুঞ্চন হয় কেন?

     

     

    সোশ্যাল মিডিয়ায় এখনও ঘুরছে, "নুসরতের সন্তানের বাবা কে, জানতে চাই’আর একটু ‘পরিশীলিতভাবে’ কেউ কেউ বিদ্রুপ করে জানতে চেয়েছেন, ‘নুসরতের পেট ফোলাল কে?’ জগৎজোড়া মহামারীর এত বড় সংকটেও এমন উৎকৃষ্ট ভাবনার জন্য যে অবসর মেলে, তা জানা ছিল না। কোন এক পণ্ডিত একবার বলেছিলেন, ‘mysogyny is a weak man's crutch’. এই সব চর্চাই কি যৌন ঈর্ষার ফল? নাকি যে ভাবেই হোক, রাজনৈতিক-সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত একজন ‘সেলেব্রিটি’ মেয়েকে যথাসম্ভব টেনে নিচে নামানোর প্রয়াস? ঠিক এক বছর আগেও এমনই ঘটেছিল প্রয়াত অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের বান্ধবী রিয়া চক্রবর্তীর সঙ্গে। তিনি তো খুব কেউকেটা ধরনের কেউ ছিলেন না তাঁকেও তো এদিক থেকে কিছুমাত্র অনুকম্পা করা হয়নি। তাঁকে সোশাল মিডিয়ার খাপ পঞ্চায়েতে সুশান্তের খুনি বলে যখন প্রতিপন্ন করা গেল না, তখন তাঁর বক্ষবিভাজিকার চুলচেরা বিশ্লেষণে বসলেন অনেকে। পরে রিয়া অবশ্য lets smash the patriarchy লেখা টি-শার্ট পরে সেই বক্ষবিভাজিকাকে ঢেকে আদালতে গিয়েছিলেন।

     

    আরও পড়ুন: বড় মাঠে খেলার প্রস্তুতি তৃণমূলে

     

    কোনও নারী পুরুষের সঙ্গে সহবাস করলে গর্ভবতী হতেই পারেন। এর মধ্যে তো কৃষ্ণ-গহ্বর রহস্য নেই। নেট-নাগরিকরা এতে রহস্যটা খুঁজছেন কোথায়? খবরে যখন অমুক হলিউড অভিনেতার কিংবা অমুক ফুটবলারের একাধিক বান্ধবী ও সন্তানের কথা বড় করে প্রকাশ করা হয়, তখন তো আমরা প্রশ্ন করি না, সন্তানটির মা কে? সন্তানটি কোন নারীর গর্ভজাত? আসলে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একটা সুপ্ত পুরুষত্ব তখন আমাদের মধ্যে জেগে ওঠে। বহু মেয়েকেও বলতে শোনা যায়, ‘পুরুষ মানুষ অমন তো একটু হবেই’!

     

     

    অবশ্য এই সব কিছুই আমাদের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। আমাদের সামাজিক উত্তরাধিকার, রাজনৈতিক উত্তরাধিকার। পুরাণ ও মহাকাব্যগুলিতে এমন নজির অনেক খুঁজে পাওয়া যাবে। মহাভারতেই দেখুন, ধৃতরাষ্ট্র, পান্ডু, বিদুরের জৈবিক পিতা হিসাবে বেদব্যাস যতটা পরিচিতি পেয়েছেন, বিদুরের পরিচারিকা মা কি সেই স্বীকৃতি কখনও পেয়েছেন? বহু নারীর সঙ্গে রতিক্রিয়ায় মগ্ন অর্জুনের পুরুষত্বের গুণগান গেয়েছে মহাভারত, অথচ কুন্তীকে বিবাহ-পূর্ব সঙ্গমে প্রাপ্ত কর্ণকে সঙ্গোপনে জলে ভাসিয়ে দিতে হয়েছে। নারী বিবাহ করবেন, স্বামী সোহাগী হবেন, স্বামীর নির্দেশমতো তাঁর সঙ্গে মিলিত হবেন—মনুসংহিতায় মনুর আদর্শ নারী চরিত্রটিকে তো এভাবেই বুনন করা হয়েছে।

     

    আরও পড়ুন: এবং সাংসদ নুসরত জাহান

     

    নুসরত সমাজের উচ্চকোটির মানুষ। তাঁকে যদি এতটা জবাবদিহি করতে বাধ্য করা হয়, তবে সমাজের অন্যত্র মেয়েদের কতটা দুরবস্থার মুখে পড়তে হয়? নুসরতের বিয়ে বৈধ না অবৈধ, নুসরত একজন জনপ্রতিনিধি হিসাবে তাঁর সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করছেন কিনা, তাই নিয়ে বিতর্ক করার মধ্যে কোনও অযৌক্তিকতা নেই, বরং প্রয়োজন আছে সেটার। কিন্তু নুসরত কার অঙ্কশায়িনী হয়েছেন, নুসরত কার সন্তানের জননী, তা জানাতে নুসরত বাধ্য নন। আরও স্পষ্ট ভাবে বললে কোনও মেয়েই বাধ্য নয়আজকের সমাজে নারী একাই তার মাতৃত্বকে উদযাপন করতে পারে। তার জন্য তাকে কোনও পুরুষের পরিচয়কে সামনে রাখতেই হবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। দেশের আইনও এখন এই কথাই বলে। নেট-দুনিয়ার পাঁকে অজাত সন্তানের পিতৃপরিচয় নিয়ে যাদের এত কৌতূহল, তারা কি জানেন যে দেশের সবচেয়ে নামডাকওয়ালা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে এখন আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্রছাত্রীদের শুধু মায়ের নামই জানাতে হয়? এমনকি আধার কার্ডেও তাই!


    বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    যারা ছিন্নমূল তাদের ভালবেসে ফেরানো হোক, হিংসার প্ররোচনায় আরও মানুষকে গৃহান্তরী করা শাসকের কাজ নয়।

    ক্রমশ ছোট হতে থাকা পৃথিবীটা যেন হঠাৎই আবার বিশাল বড় হয়ে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফিরে যাচ্ছে

    লকডাউনে ছাত্রছাত্রীদের কাছে পাঠ্যবস্তু পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারেও তাঁর সমান চিন্তা ছিল

    আইনি ফয়সালা আদালতের অপেক্ষায়, কিন্তু নৈতিকতার পাঠ অসম্পূর্ণ রেখে কোন শিক্ষা দেবেন অঙ্কিতা

    শিল্পীর শিল্পে সমকাল ধরা পড়লে, শাসক সর্বদাই ভয়ে থাকে।

    স্বাধীনতার রক্তাক্ত ইতিহাস পদ্মফুল আর লেজার শো দিয়ে তারাই ঢাকতে পারে, যারা সেই সংগ্রামের শরিক নয়।

    কার বাপের কী?-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested